নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক

নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক (Non-steroidal Anti-inflammatory Drugs—NSAIDs) ঔষধগুলোকে সচরাচর ব্যথার ঔষধ বা ব্যথানাশক বলা হয়। এই ঔষধগুলো ব্যথা সারাতে, জ্বালাপোড়া কমাতে ও জ্বর বা উচ্চ তাপমাত্রার চিকিৎসায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

দীর্ঘমেয়াদী ব্যথাসহ বিভিন্ন রোগের লক্ষণ উপশমে এসব ঔষধ প্রায়ই ব্যবহার করা হয়। যেমন—

নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশকগুলো সচরাচর বিভিন্ন কারণে ব্যবহার করা হলেও এগুলো সবার জন্য উপযুক্ত নয়। কখনো কখনো এসব ঔষধ ব্যবহারের ফলে পীড়াদায়ক নানান পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক এর প্রকারভেদ

নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশকগুলো বিভিন্নরূপে ফার্মেসিতে পাওয়া যায়। যেমন: ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, ক্রিম, জেল, ইনজেকশন ও সাপোজিটরি (পায়খানার রাস্তা দিয়ে ঢোকাতে হয় এমন ছোটো কাঠি আকৃতির ঔষধ)।

নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক গ্রুপের প্রধান ঔষধগুলো হলো—

  • আইবুপ্রোফেন
  • ন্যাপ্রোক্সেন
  • ডাইক্লোফেনাক
  • এসিক্লোফেনাক
  • সেলেকক্সিব
  • মেফেনামিক এসিড
  • ইটোরিকক্সিব
  • ইন্ডোমেথাসিন
  • অ্যাসপিরিন

উল্লেখ্য, এখানে অ্যাসপিরিন বলতে উচ্চ ডোজের অ্যাসপিরিনকে বোঝানো হয়েছে। লো-ডোজ বা স্বল্প ডোজের অ্যাসপিরিন সাধারণত নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক হিসেবে বিবেচিত হয় না। যেমন: ৭৫ মিলিগ্রাম অ্যাসপিরিন। লো-ডোজ অ্যাসপিরিন রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশকগুলোর কার্যকারিতা প্রায় একই রকম। তবে ব্যক্তি ও রোগভেদে একেক ক্ষেত্রে একেক ধরনের ঔষধ সবচেয়ে ভালো কাজ করে। 

নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক যারা সেবন করতে পারবেন

বেশিরভাগ মানুষই নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক কোনো বিশেষ বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছাড়াই সেবন করতে পারেন। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে এই জাতীয় ঔষধ সেবনের বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

কিছু ক্ষেত্রে নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক সেবনের পূর্বে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যেমন—

  • বয়স ৬৫ বছরের বেশি হলে
  • ঔষধ সেবনকারী গর্ভবতী হলে অথবা গর্ভধারণের চেষ্টা করলে
  • শিশুকে বুকের দুধ পান করালে
  • অ্যাজমা বা হাঁপানি রোগে ভুগলে
  • অতীতে নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক সেবনের ফলে অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন হয়ে থাকলে
  • অতীতে অথবা বর্তমানে পাকস্থলীর আলসার হয়ে থাকলে
  • হার্ট, লিভার, কিডনি, রক্তচাপ, রক্ত চলাচল অথবা পরিপাকতন্ত্রের কোনো সমস্যা থাকলে
  • নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক ছাড়া অন্য কোনো ঔষধ সেবন করলে
  • ১৬ বছরের কম বয়সীদের চিকিৎসায় ব্যথানাশক প্রয়োজন হলে

১৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের অ্যাসপিরিন আছে এমন কোনো ঔষধ দেওয়া যাবে না।

এসব ক্ষেত্রে নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক যে একেবারেই সেবন করা যাবে না এমনটি নয়। তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে বলে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এসব ঔষধ সেবন করা ঠিক নয়।

রোগীর জন্য নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক উপযুক্ত না হলে ডাক্তার বিকল্প কোনো ঔষধ সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন। যেমন: প্যারাসিটামল।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

সব ঔষধের মতোই নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক ঔষধ সেবনের ফলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। সাধারণত দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ ডোজে নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক সেবন করলে এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া বয়স্ক রোগীর ক্ষেত্রে অথবা দুর্বল স্বাস্থ্য থাকলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক জাতীয় ঔষধের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে রয়েছে—

তাই নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক সেবনের ফলে এমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

অন্যান্য ঔষধের সাথে সেবনের ক্ষেত্রে সতর্কতা

কিছু নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক অন্যান্য ঔষধের সাথে বিরূপ প্রতিক্রিয়া করতে পারে। ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে অথবা কোনো একটি ঔষধের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে।

নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশকের সাথে বিক্রিয়া ‌করতে পারে এমন কিছু ঔষধের তালিকা নিচে তুলে ধরা হয়েছে। ইতোমধ্যে এসব ঔষধ সেবন করতে থাকলে নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক খাওয়া শুরু করার আগে ডাক্তারকে বিষয়টি জানাতে হবে। এসব ঔষধের মধ্যে রয়েছে—

  • ভিন্ন একটি নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক ঔষধ
  • লো-ডোজ অ্যাসপিরিন অথবা ওয়ারফারিন: এই ঔষধগুলো রক্ত ​​জমাট বাঁধা প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়।
  • সাইক্লোস্পোরিন: ঔষধটি আরথ্রাইটিস ও আলসারেটিভ কোলাইটিস এর মতো অটোইমিউন রোগের (Autoimmune Disease) চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
  • ডাইইউরেটিক ঔষধ: উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় মাঝে মাঝে এসব ঔষধ ব্যবহৃত হয়।
  • লিথিয়াম: ঔষধটি বাইপোলার ডিজঅর্ডার ও গুরুতর ডিপ্রেশনসহ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
  • মেথোট্রেক্সেট: রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস (Rheumatoid Arthritis) এর চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধ।
  • সিটালোপ্রাম ও ফ্লুওক্সেটিন: এগুলো সিলেক্টেড সেরোটোনিন রিআপটেক ইনহিবিটর (এসএসআরআই) গ্রুপের ঔষধ। এগুলো ডিপ্রেশনের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক এর সাথে ভিন্ন আরেকটি ঔষধ সেবন করা নিরাপদ কি না সেটি জানা গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য ঔষধের সাথে থাকা নির্দেশিকা পড়ুন। প্রয়োজনে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

খাবার ও পানীয়ের সাথে সম্পর্ক

নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক সেবন চলাকালে কোনো নির্দিষ্ট খাবার অথবা পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে কি না সেটি সাধারণত ঔষধের সাথে থাকা নির্দেশিকায় উল্লেখ করা থাকে। এজন্য ঔষধের সাথে থাকা কাগজটি পড়ে নিশ্চিত হয়ে নিন। প্রয়োজনে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

সাধারণত নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক সেবন চলাকালে কোনো নির্দিষ্ট খাবার এড়িয়ে চলার প্রয়োজন হয় না।

উল্লেখ্য, ট্যাবলেট অথবা ক্যাপসুল সাধারণত পানি অথবা খাবারের সাহায্যে একেবারে গিলে ফেলতে হয়। স্পষ্ট নির্দেশনা না থাকলে এগুলো চিবিয়ে খাওয়া থেকে একেবারে বিরত থাকা উচিত। আস্ত গিলে ফেলার বদলে চিবিয়ে খাওয়ার কারণে পেট খারাপ হতে পারে। 

মদপান করলে পেটে জ্বালাপোড়া হতে পারে। নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক সেবন করলেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে পেটে জ্বালাপোড়া ও পেটের অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই মদপান করা থেকে বিরত থাকা উচিত।

অতিরিক্ত ডোজের ফলাফল

অত্যধিক মাত্রায় নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক সেবনের ফলাফল মারাত্মক হতে পারে। এই ঘটনাকে ‘ওভারডোজ’ বলা হয়। এক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন হয়।

অতিরিক্ত মাত্রায় ঔষধ সেবনের ফলে নিচের লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজনে ১৬২৬৩ নাম্বারে ফোন করে পরামর্শ নিতে পারেন। লক্ষণগুলো হলো—

  •  বমি বমি ভাব অথবা বমি হওয়া
  • পেট খারাপ হওয়া
  • ঝিমুনি বা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া

বিশেষ দ্রষ্টব্য: সরকারি মোবাইল স্বাস্থ্যসেবা ‘স্বাস্থ্য বাতায়ন’ এর হেল্পলাইন ১৬২৬৩ নম্বরে ফোন করে দিনরাত ২৪ ঘন্টা চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে সরাসরি ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া যায়। এ ছাড়া নিকটস্থ সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক তথ্য (যেমন: ফোন নম্বর) জানা যাবে।

জরুরি তথ্য

 ওভারডোজ হলে আরও কিছু মারাত্মক লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন— 

  • খিঁচুনি
  • শ্বাসকষ্ট
  • জ্ঞান হারিয়ে ফেলা

 এসব লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে রোগীকে নিকটস্থ হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। 

নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশকের বিকল্প

নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশকগুলো নানান ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। একারণে চিকিৎসার শুরুতে সাধারণত বিকল্প ঔষধ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়।

ব্যথার চিকিৎসায় নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক ঔষধের প্রধান বিকল্প হলো প্যারাসিটামল। বেশিরভাগ মানুষই নিরাপদে প্যারাসিটামল সেবন করতে পারেন। এমনকি গর্ভবতী ও বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের জন্যও এটি নিরাপদ।

নন-স্টেরয়ডাল প্রদাহনাশক গ্রুপের কিছু ঔষধ মলমের মতো ক্রিম অথবা জেল হিসেবে পাওয়া যায়। শরীরের কোনো অংশের জয়েন্ট অথবা পেশিতে ব্যথা হলে প্রথমে এসব ক্রিম বা জেল সেই স্থানের ত্বকে আলতোভাবে ঘষে ঘষে লাগানো যায়।

এসব ক্রিম ও জেল ব্যথা কমাতে কার্যকর। এ ছাড়া ট্যাবলেট অথবা ক্যাপসুলের তুলনায় এসব মলম ব্যবহারে কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ব্যবহারের পূর্বে প্যাকেটের ভেতরে থাকা কাগজ/লিফলেটের নির্দেশনা ভালোভাবে পড়ে নিতে হবে।

এ ছাড়া রোগীর স্বাস্থ্য সমস্যার ওপর ভিত্তি করে ডাক্তার অন্য ঔষধ ও থেরাপি নেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। যেমন, কিছু রোগীর পেশি অথবা জয়েন্টের ব্যথা কমাতে ফিজিওথেরাপির মতো একটি থেরাপি সহায়ক হতে পারে।