গর্ভাবস্থায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়া

গর্ভাবস্থায় কখনো কখনো আপনি জ্ঞান হারাতে পারেন কিংবা জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা অনুভব করতে পারেন। বিশেষ করে বসা থেকে হুট করে উঠে দাঁড়ালে অথবা চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলে এমনটা হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় জ্ঞান হারানো সাধারণত দুশ্চিন্তার কিছু না হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে এর জন্য চিকিৎসা নিতে হবে তা জেনে রাখা জরুরি।

গর্ভাবস্থায় অজ্ঞান হওয়ার কারণ

আপনার ব্রেইনে যখন পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্ত পৌঁছায় না, তখন অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। এটি থেকে আপনি অজ্ঞান হতে পারেন। গর্ভাবস্থায় যেসকল কারণে আপনি জ্ঞান হারাতে পারেন সেগুলো হচ্ছে—

  • ব্লাড প্রেশার বা রক্তচাপ কমে গেলে
  • অতিরিক্ত গরম থেকে
  • রক্তে সুগার বা গ্লুকোজের পরিমাণ হঠাৎ কমে গেলে
  • রক্তশূন্যতা থাকলে
  • চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলে

এ ছাড়া পেটের আকার বেড়ে গেলে তা রক্তনালীর উপর চাপ দেয়। ফলে রক্ত সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন।

অজ্ঞান হওয়ার পূর্বলক্ষণ

জ্ঞান হারানোর ঠিক আগ মুহূর্তে আপনার যে লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে—

  • মাথা ঘুরানো
  • স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত অথবা গভীর শ্বাস নেওয়া
  • হঠাৎ করে অনেক বেশি ঘাম হওয়া এবং হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসা
  • কানে  ঝিঁঝিঁ করা বা চিকন বাঁশির মতো শব্দ শোনা
  • চোখে ঝাপসা দেখা অথবা চোখের সামনে দাগের ন্যায় দেখা
  • বমি বমি ভাব বা অসুস্থ বোধ করা
  • বারবার হাই তোলা
  • মাথা হালকা লাগা

অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলে ব্রেইন ও হার্ট একই লেভেলে থাকে। তাই হার্টকে ব্রেইন পর্যন্ত রক্ত পাম্প করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। ফলে ২০ সেকেন্ডের মধ্যেই সাধারণত জ্ঞান ফিরে আসে।

জ্ঞান ফিরে আসার পর কিছুক্ষণ পর্যন্ত বিভ্রান্ত লাগাটা স্বাভাবিক। এ ছাড়া ৩০ মিনিট পর্যন্ত আপনার দুর্বল ও ক্লান্ত লাগতে পারে। এমনকি অজ্ঞান হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে আপনি কী করছিলেন তাও মনে না থাকতে পারে।

এক্ষেত্রে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে এটি ঠিক হয়ে যায়। তবে পরবর্তী চেকআপে আপনার চিকিৎসককে অজ্ঞান হওয়ার ঘটনার সম্পর্কে জানাতে হবে।

অজ্ঞান হচ্ছেন মনে হলে করণীয়

আপনার মাথা ঘুরালে অথবা অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা হচ্ছে বুঝতে পারলে নিচের পরামর্শগুলো মেনে চলুন—

  • আপনার যদি দাঁড়ানো অবস্থায় এমনটা হয়, তাহলে কোথাও বসে পড়ুন।
  • বসার পরেও যদি অবস্থার উন্নতি না হয় তাহলে আশেপাশে বিছানা বা সোফা থাকলে একদিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়ুন।
  • আশেপাশের কাউকে জানিয়ে রাখুন যাতে প্রয়োজনে তারা আপনাকে সাহায্য করতে পারে।
  • আঁটসাঁট বা গরম কাপড় পরা থাকলে খুলে ফেলুন অথবা আলগা করুন যাতে বাতাস চলাচল করতে পারে।
  • আপনি যেই ঘরে আছেন সেখানটায় বাতাসের চলাচল নিশ্চিত করুন। আপনি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন মনে হলে নিজে বেশি হাঁটাহাঁটি না করে অন্য কাউকে ঘরের দরজা-জানালা খুলে দিতে বলুন।
  • পানি পান করুন এবং হালকা নাস্তা জাতীয় খাবার খান।

পড়ে যাওয়া থেকে সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি

অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলে দুর্ঘটনাবশত আপনি আঘাত পেতে পারেন। আঘাত গুরুতর হলে তা থেকে অনেকসময় মা ও শিশুর জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। সেক্ষেত্রে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যেতে হবে।

এ ছাড়া গর্ভাবস্থায় জ্ঞান হারানোর সাথে মা ও গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্পর্ক পাওয়া যায়। যেমন: গর্ভাবস্থায় জ্ঞান হারিয়েছেন এমন মায়েদের ক্ষেত্রে অকাল প্রসব ও শিশুর জন্মগত ত্রুটি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা বেশি থাকতে পারে।[১] সন্তান জন্মদানের পরবর্তী বছরে মায়ের হার্টবিট অনিয়মিত হওয়া কিংবা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার সমস্যাও কিছুটা বেড়ে যেতে পারে।

এজন্য যেসব মায়ের গর্ভকালীন সময়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে তাদেরকে গর্ভকালে এবং সন্তান জন্মদানের পর—উভয় সময়েই নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তবে গর্ভকালে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বেশিরভাগ মা-ই সাধারণত সুস্থ সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকেন।

কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে

অজ্ঞান কিংবা অজ্ঞান ভাব হওয়ার পাশাপাশি নিচের লক্ষণগুলোর কোনোটি থাকলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি—

  1. যোনিপথ দিয়ে রক্তপাত হলে
  2. তলপেটে ব্যথা হলে
  3. বুকে ব্যথা হলে
  4. শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হলে
  5. বুক ধড়ফড় করলে
  6. চোখে ঝাপসা দেখলে কিংবা দৃষ্টিশক্তিতে পরিবর্তন আসলে
  7. মাথা ব্যথা হলে
  8. মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গিয়ে মাথা অথবা পেটে আঘাত পেলে, কিংবা ১ মিনিটের বেশি সময় ধরে অজ্ঞান থাকলে

অজ্ঞান হওয়া প্রতিরোধের উপায়

আপনি যেভাবে অজ্ঞান হওয়া অথবা অজ্ঞানবোধ করা থেকে বাঁচতে পারেন—

  • বিছানা থেকে ধীরে-সুস্থে নামুন। উঠে দাঁড়ানোর আগে বিছানার সাইডে কিছুক্ষণ বসে নিন।
  • বসা অবস্থা থেকে উঠতে গেলেও আস্তে ধীরে উঠুন।
  • খুব গরম পানিতে গোসল করবেন না।
  • গোসলখানা থেকে ধীরে-সুস্থে ও সতর্কতার সাথে বের হোন।
  • অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকবেন না
  • প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন।
  • নিয়মিত ব্যায়াম করার চেষ্টা করুন। এতে শরীর ও ব্রেইনে রক্ত চলাচল ভালো হয়।[২]
  • চিৎ হয়ে শুয়ে থাকবেন না। বিশেষ করে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক থেকে চিৎ হয়ে শোয়া পরিহার করুন।

একজন সুস্থ-স্বাভাবিক গর্ভবতী নারীর প্রতিদিন গড়ে ২–৩ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। কাপ কিংবা গ্লাসের হিসাবে আপনাকে সারাদিনে মোট ৮–১২ গ্লাস পানি পান করতে হবে।[৩] তবে এই বিষয়ে কখনো যদি ডাক্তার কোনো বিশেষ পরামর্শ দিয়ে থাকেন তাহলে সেটিই অনুসরণ করবেন।

গর্ভকালীন সময়ের শেষের দিকে এবং প্রসববেদনার সময় পিঠে হেলান দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে থাকা ঠিক নয়। গর্ভধারণের ২৮ সপ্তাহ পর ঘুমানোর সময়েও পিঠে হেলান দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে থাকা থেকে বিরত থাকবেন। কেননা এভাবে শুয়ে থাকলে মৃত শিশু জন্মানোর সম্ভাবনা বাড়তে পারে।[৪]

এসবের পাশাপাশি কখনোই কোনো বেলার খাবার বাদ দিবেন না—এমনকি যদি আপনার মর্নিং সিকনেস থাকে তাহলেও অল্প অল্প করে নিয়মিত খেয়ে নিন। এতে আপনার রক্তে সুগার লেভেল নেমে যাবে না।

গর্ভবতীর পরিবার ও কাছের মানুষদের জন্য পরামর্শ

আপনি যদি একজন গর্ভবতী নারীকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে দেখেন তাহলে তাকে নিচে আলতো করে বামদিকে কাত করে শুইয়ে দিন। তার বাম পা এসময় বুকের দিকে ভাজ করে রাখুন। (ছবিতে দেখুন)

রিকভারি পজিশন
ছবি: রিকভারি পজিশন

নিচের লক্ষণগুলো উপস্থিত থাকলে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন—

  • এক মিনিট ধরে ছবিতে দেখানো পজিশনে রাখার পরেও যদি তার জ্ঞান না ফেরে
  • রোগীর খিঁচুনি হয় অথবা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে
  • অজ্ঞান হয়ে পড়ার সময় গুরুতর জখমের শিকার হয় (বিশেষ করে মাথায়)
  • এটিই তার প্রথম অজ্ঞান হওয়ার ঘটনা হয়
  • রোগী উচ্চ রক্তচাপের জন্য আগে থেকেই ঔষধ নিয়ে থাকলে

এম্বুলেন্স না আসা অথবা জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত রোগীর সাথেই থাকুন।

সাধারণ জিজ্ঞাসা

গর্ভাবস্থায় কোন সময়ে মাথা ঘোরা স্বাভাবিক?

সাধারণত গর্ভাবস্থার প্রথম তিনমাসে মাথা ঘুরানোর সমস্যাটি বেশি দেখা যায়। তবে অনেকে পুরো গর্ভাবস্থা জুড়েই কমবেশি এই সমস্যায় ভুগতে পারেন।

গর্ভাবস্থায় মাথা ঘোরার সাথে মাথা প্রচুর গরম হয় কেন?

গর্ভকালীন প্রথম ত্রৈমাসিকের শেষের দিকে আপনার শরীরে রক্ত চলাচল প্রায় দেড়গুণ বেড়ে যায়। একারণে অতিরিক্ত গরম লাগা ও ঘাম হওয়ার পাশাপাশি মাথা ঘুরাতে পারে।

গর্ভাবস্থায় মাথা ঘোরার পরে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া কি স্বাভাবিক এবং এক্ষেত্রে করণীয় কী?

শতকরা প্রায় ৪.৬ জন নারী গর্ভাবস্থায় অজ্ঞান হওয়ার সমস্যায় ভুগে থাকেন।[৫] এটি একটি সাধারণ উপসর্গ, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করে না। তবে গর্ভাবস্থায় অজ্ঞান হওয়ার সাথে মা ও শিশুর কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক থাকতে পারে। আবার এটি অন্য কোনো গুরুতর রোগের লক্ষণ হিসেবেও দেখা দেখা দিতে পারে।
এজন্য অজ্ঞান হওয়ার ঘটনাটি আপনার চিকিৎসককে জানাতে হবে, প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতে হবে এবং অজ্ঞান হওয়ার পাশাপাশি আর কোনো লক্ষণ আছে কি না তা খেয়াল রাখতে হবে।

মানসিক চাপ থেকে কি গর্ভবতী নারী অজ্ঞান হতে পারেন?

অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে গর্ভবতী নারী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন। যেমন: খুব বেশি মানসিক কষ্ট পেলে কিংবা অনেক রেগে গেলে তা থেকে অজ্ঞান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।