গর্ভাবস্থায় চুলকানি

গর্ভাবস্থায় চুলকানি মা ও গর্ভের শিশুর জন্য তেমন জটিলতা সৃষ্টি না করলেও চুলকানির সাথে বিশেষ কিছু লক্ষণ থাকলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

গর্ভকালীন সময়ে অনেক নারীকে চুলকানির সমস্যায় ভুগতে দেখা যায়। সাধারণত গর্ভকালীন শারীরিক ও হরমোন জনিত নানান পরিবর্তনের কারণে এমন চুলকানি হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পেটে চুলকানি হলেও, পেটের পাশাপাশি শরীরের অন্যান্য স্থানেও চুলকানি হতে পারে।[১]

কিছু সহজ কৌশল অনুসরণ করার মাধ্যমে গর্ভকালীন এই চুলকানি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে চুলকানির সাথে এমন কিছু লক্ষণ থাকতে পারে, যা জটিল কোনো রোগ নির্দেশ করে। সেক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

গর্ভাবস্থায় কখন চুলকানি হয়?

গর্ভাবস্থায় যেকোনো সময়েই আপনার পেট চুলকানির সমস্যা শুরু হতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসে পেট চুলকানির সমস্যা বেশি দেখা যায়।[২]

পেট চুলকানোর পাশাপাশি শরীরের অন্যান্য জায়গাতেও (যেমন: পায়ু বা পায়খানার রাস্তার চারিদিকে, যৌনাঙ্গের আশেপাশে ও স্তনে) চুলকানির সমস্যা হতে পারে। আবার কারও কারও সারা শরীরে চুলকানি থাকতে পারে।

গর্ভাবস্থায় কেন চুলকানি হয়?

গর্ভাবস্থায় মূলত তিনভাবে চুলকানি হতে পারে—

  1. সাধারণত গর্ভকালীন নানান শারীরিক ও হরমোনগত পরিবর্তনের কারণে চুলকানি হতে পারে।
  2. গর্ভধারণের আগে থেকে কোনো চর্মরোগ কিংবা চুলকানির সমস্যা থাকলে গর্ভাবস্থায় সেটা বেড়ে গিয়ে ভোগান্তি সৃষ্টি করতে পারে। যেমন: এটোপিক একজিমা।
  3. গর্ভাবস্থার সাথে সম্পর্কিত বিশেষ কিছু রোগ ও স্বাস্থ্য জটিলতা চুলকানি সৃষ্টি করতে পারে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গর্ভধারণ ছাড়া এই চুলকানির পেছনে নির্দিষ্ট কারণও খুঁজে পাওয়া যায় না। মোটা দাগে ধারণা করা হয় যে, এসময়ে কিছু হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় গর্ভাবস্থায় চুলকানি হয়।

উল্লেখ্য, শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় পেটে চুলকানির সমস্যা বেশি হয়।[৩] গর্ভকাল বাড়ার সাথে সাথে পেটের আকারও বড় হয়। এতে পেটের ত্বক অনেকটা প্রসারিত হয়ে সেখানে টান পড়ে। ফলে সেখানকার নার্ভে কিছু পরিবর্তন হয়ে পেটে চুলকানি হতে পারে।

কিছু ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় চুলকানির সাথে অন্য কোনো চর্মরোগ অথবা লিভারের রোগের সম্পর্ক থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত পেট চুলকানির পাশাপাশি আরও কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। এমন হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হয়। এজন্য চুলকানির সাথে সাথে আপনার অন্য কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না সেদিকে খেয়াল রাখুন। আর্টিকেলের পরবর্তী অংশে এই রোগগুলোর লক্ষণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

গর্ভকালীন চুলকানির কার্যকর ঘরোয়া সমাধান

গর্ভাবস্থায় চুলকানিতে ভোগা ৬০% নারীর ক্ষেত্রেই শরীরে কোনো দানা, র‍্যাশ বা ফুসকুড়ি হয় না। তবে সাধারণ চুলকানি মা ও গর্ভের শিশুর জন্য তেমন জটিলতা সৃষ্টি না করলেও তা অনেক গর্ভবতীর জন্য ভোগান্তি ও বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

নিচে ৮টি কার্যকর সমাধান তুলে ধরা হয়েছে, যা আপনাকে ঘরোয়াভাবেই চুলকানি উপশমে সাহায্য করতে পারে—

১. চুলকানির স্থানে ভেজা কাপড় অথবা বরফ দেওয়া

ভেজা কাপড় ও বরফ চুলকানি কমাতে সাহায্য করতে পারে। এজন্য যে স্থানে চুলকাচ্ছে, তার ওপর একটি ভেজা কাপড় অথবা বরফ মোড়ানো কাপড় দিয়ে রাখতে পারেন। এভাবে ৫–১০ মিনিট আলতো করে চেপে ধরে রাখুন। এতেও কাজ না হলে, চুলকানি না কমা পর্যন্ত এভাবে আরও কিছুক্ষণ ধরে রাখতে পারেন।[৪]

২. নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা

শুষ্ক ত্বকের চুলকানি অনেকটা বাড়িয়ে দিতে পারে।[৫] শরীরে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা ধরে রাখার মাধ্যমে শুষ্কতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। আর্দ্রতা ধরে রাখার জন্য আপনি ভালো ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে পারেন।

ময়েশ্চারাইজিং ক্রিম অথবা অয়েন্টমেন্ট ব্যবহার করতে পারলে বেশি ভালো হয়।[৬] হাতের কাছে না পেলে ময়েশ্চারাইজিং লোশন ব্যবহার করতে পারেন। এক্ষেত্রে সুগন্ধিবিহীন ময়েশ্চারাইজারগুলো বেছে নেওয়ার চেষ্টা করুন। কারণ অনেকসময় সুগন্ধি প্রসাধনসামগ্রী চুলকানি রিঅ্যাকশন ঘটিয়ে চুলকানি বাড়িয়ে দিতে পারে।

গোসল করার পর পরই তোয়ালে দিয়ে হালকা করে শরীর মুছে ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে ফেলুন।[৭] এটি শরীরের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। মুখ ধোয়ার পরেও এভাবে ময়েশ্চাইরাইজার লাগাতে পারেন।

চুলকানি কমাতে দিনে দুইবার ভারী ধরনের ময়েশ্চারাইজার লাগানো ভালো।[৮] সারাদিনে অন্তত গোসলের পরে একবার এবং রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে একবার ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে পারেন।

দামি ময়েশ্চারাইজার হলেই সেটা বেশি কার্যকরী হবে, এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই। আপনি যেকোনো ধরনের ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে পারেন। সেই সাথে ময়েশ্চারাইজার কেনার আগে প্যাকেটের গায়ে লাগানো লোগো, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার তারিখ ও ব্যবহৃত উপাদানগুলোর নাম ভালো করে দেখে কেনার চেষ্টা করুন।

৩. মেনথল অথবা ক্যালামাইনযুক্ত ক্রিম-লোশন লাগানো

চুলকানির স্থানে মেনথল অথবা ক্যালামাইনযুক্ত ক্রিম ব্যবহার করতে পারেন। এগুলো গর্ভাবস্থায় ব্যবহার করা নিরাপদ। এগুলো চুলকানি থেকে কিছুটা আরাম দিতে পারে।

৪. গন্ধহীন ও মৃদু টয়লেট্রিজ ব্যবহার করা

সাবান, বডি ওয়াশ, ক্রিম, লোশন ও ময়েশ্চারাইজারে সাধারণত সুগন্ধি মেশানো থাকে। এসব সুগন্ধিযুক্ত টয়লেট্রিজ ব্যবহারে কারও কারও চুলকানি বেড়ে যেতে পারে তাই গন্ধহীন সাবান, ক্রিম ও লোশন ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। এতে চুলকানির সমস্যা কিছুটা কমতে পারে। সাবান ও বডিওয়াশের ক্ষেত্রে গন্ধহীন এবং মৃদু, কম ক্ষারযুক্ত পণ্যটি বেছে নেওয়ার চেষ্টা করুন।

৫. অতিরিক্ত গরম পানির ব্যবহার এড়িয়ে চলা

বেশি গরম পানি ত্বককে শুষ্ক করে ফেলে, যা থেকে চুলকানি হতে পারে। এজন্য গোসলের সময়ে বেশি গরম পানির ব্যবহার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। খুব গরম পানির পরিবর্তে কুসুম গরম পানি বেছে নিন। চেষ্টা করুন ১০ মিনিটের মধ্যে গোসল সেরে ফেলতে।[৯]

গরম পানির পাশাপাশি খুব গরম, খুব ঠাণ্ডা কিংবা খুব শুষ্ক আবহাওয়া এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। এগুলো চুলকানি কমাতে সাহায্য করতে পারে।

৬. সুতি কাপড়ের ঢিলেঢালা পোশাক পরা

জামা-কাপড়ের সাথে বারবার ত্বকের ঘষা লাগলে ত্বকে জ্বালাপোড়া হয়ে চুলকানি বেড়ে যেতে পারে। এজন্য এমন কোনো ঢিলেঢালা ও আরামদায়ক পোশাক বেছে নিন, যেটা পরলে ত্বকের সাথে কম ঘষা লাগবে।

সিনথেটিক কাপড়ের তৈরি পোশাকের পরিবর্তে সুতির পোশাক বেছে নিন। সুতি কাপড়ের ভেতর দিয়ে বাতাস চলাচল করতে পারে। ফলে আপনার শরীরে ভালোমতো বাতাস লাগবে। এতে আপনি বেশি আরাম পেতে পারেন।

৭. ওটস মেশানো পানি ব্যবহার করা

চুলকানি নিয়ন্ত্রণের একটি ভালো পদ্ধতি হচ্ছে ওটস মেশানো মিশ্রণ দিয়ে গোসল করা।[১০] একে ইংরেজিতে ‘ওটমিল বাথ’ বলা হয়। বিদেশে দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। আপনি নিচের পদ্ধতি অনুসরণ করে বাড়িতেও বানিয়ে নিতে পারেন—

  1. প্রথমে ওটস খুব মিহি গুঁড়া করুন। গুঁড়া করার জন্য ব্লেন্ডার, গ্রাইন্ডার, কফি গুঁড়া করার মেশিন অথবা এই ধরনের যেকোনো মেশিন ব্যবহার করতে পারেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে মিহি গুঁড়া বানানোর সেটিং বেছে নিন।

ওটস ভালোভাবে গুঁড়া হয়েছে কি না সেটি পরীক্ষা করে দেখুন। এজন্য এক টেবিল চামচ ওটস গুঁড়া নিয়ে তা এক গ্লাস গরম পানিতে মেশান। পানিতে ভালোভাবে মিশে দেখতে দুধের মতো তরল তৈরি হয়ে গেলে বোঝা যাবে যে, ওটসগুলো ভালোভাবে গুঁড়া হয়েছে।

  1. যদি পানি দুধের মতো না হয়ে যায়, তাহলে ওটস আরও ভালোভাবে গুঁড়া করুন। তারপর আবার ভালোভাবে গুঁড়া হয়েছে কি না সেটি পরীক্ষা করার জন্য পানিতে মেশান। এভাবে যখন ওটস সাথে সাথে পানি শুষে নিয়ে দেখতে দুধের মতো হয়ে যাবে, তখন বুঝতে হবে যে ওটস ব্যবহারের জন্য তৈরি।

যদি বাথটাব থাকে: ওটসগুলো বাথটাবের কুসুম গরম পানিতে ঢেলে দিন। খেয়াল রাখবেন, ওটস পানিতে ঢালার সময়ে যেন কল বা ট্যাপ থেকে চলন্ত পানি বাথটাবে পড়তে থাকে। এতে করে ওটসের গুঁড়া পানির সাথে ভালোভাবে মিশে যাবে। পানি ভালোভাবে নাড়িয়ে ওটসের গুঁড়া পুরো পানিতে মিশিয়ে দিন। কোনো দলা ছাড়া পুরোপুরি মিশে গেলেই এই ওটস মেশানো পানি গোসলের উপযোগী হয়ে যাবে। এতে সাবান, শাওয়ার জেল অথবা বডি ওয়াশ ব্যবহার করার কোনো প্রয়োজন নেই।

এরপর বাথটাবে ওটস মেশানো পানিতে ১৫–২০ মিনিট শরীর ডুবিয়ে রাখতে হবে। ওটস মেশানো পানিতে শরীর বেশিক্ষণ ডুবিয়ে রাখলে ত্বক কিছুটা শুষ্ক হয়ে যায়। তাই এই পানি দিয়ে বেশিক্ষণ ধরে শরীর ভিজিয়ে রাখবেন না। সবশেষে ওটস মেশানো পানি থেকে উঠে শরীরের যেসব স্থানে চুলকানি হয় সেসব স্থান হাত দিয়ে আলতো করে ঘষে নিতে পারেন। উল্লেখ্য, ওটস মেশানো পানি থেকে উঠে আলাদা করে সারা শরীর ধুয়ে ফেলার প্রয়োজন নেই। তবে আপনি চাইলে বা অস্বস্তি লাগলে কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে পারেন।

যদি বাথটাব না থাকে: যদি আপনার বাসায় বাথটাব না থাকে, তাহলে একটি পাত্রে কুসুম গরম পানির সাথে মিহি ওটস গুঁড়া একটু ঘন করে মেশান। এরপর মিশ্রণটি একটি মসলিন জাতীয় কাপড়ে নিয়ে তা দিয়ে আপনার চুলকানির স্থানে আলতোভাবে স্পর্শ করুন। এভাবেই ৩০ মিনিট মিশ্রণটি ত্বকের ওপর রেখে দিন। এরপর আলাদা করে শরীর ধুয়ে ফেলার প্রয়োজন নেই। তবে আপনি চাইলে বা অস্বস্তি লাগলে একটি পরিষ্কার কাপড় ও কুসুম গরম পানি দিয়ে ওটস এর গুঁড়াগুলো মুছে ফেলতে পারেন।

৮. চুলকানোর পরিবর্তে বিশেষ নিয়ম মেনে চলা

চুলকানির তাড়না আসলে সেটি দমিয়ে রাখা কঠিন। কিন্তু চুলকানি ওঠা স্থানে চুলকালে কয়েক মুহূর্ত আরাম লাগলেও তা চুলকানির তাড়নাকে বাড়িয়ে দেয়। এরপর আবার চুলকাতে ইচ্ছে করে। এভাবে অনেক ক্ষেত্রেই চুলকানি একটা চক্রের মতো চলতে থাকে।[১১] তা ছাড়া চুলকানোর ফলে ত্বকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষত সৃষ্টি হয়। এসবের ভেতর দিয়ে জীবাণু ঢুকে ত্বকে ইনফেকশন ঘটাতে পারে।

তাই চুলকানি উঠলেও ত্বক না চুলকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন। চুলকানোর পরিবর্তে আঙুলের ত্বক দিয়ে চুলকানি ওঠা স্থানটি আলতো করে চেপে চেপে নিন। ত্বকে আঘাত ও ইনফেকশন এড়াতে নখ ছোটো করে কেটে নিন এবং সবসময় মসৃণ ও পরিষ্কার রাখুন।

৯. মানসিক চাপ মোকাবেলা

মানসিক চাপ এড়িয়ে চলুন। মানসিক চাপ চুলকানি বাড়িয়ে দিতে পারে।

কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?

গর্ভাবস্থায় পেটে বা শরীরে হালকা চুলকানি হলে তা সাধারণত আপনার কিংবা গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে নিচের লক্ষণগুলোর কোনোটি দেখা গেলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাওয়া জরুরি—

  • একটা নির্দিষ্ট সময়ে (সন্ধ্যার পরে) চুলকানি বেড়ে গেলে
  • চুলকানির কারণে অনেক অস্বস্তি হলে
  • শরীরের অন্যান্য জায়গায় চুলকানি হলেও হাত ও পায়ের তালুতে বেশি চুলকালে
  • চুলকানির সাথে অন্য কিছু লক্ষণ দেখা গেলে
  • একটানা অনেকদিন ধরে চুলকানি থাকলে

এর কারণ হলো, এগুলো গর্ভাবস্থার বিশেষ লিভারের রোগ অথবা অন্য কোনো চর্মরোগের লক্ষণ হতে পারে। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না করালে তা মা ও গর্ভের শিশুর জন্য মারাত্মক হতে পারে।

গর্ভাবস্থার বিশেষ লিভারের রোগ

এই রোগের লক্ষণের মধ্যে রয়েছে[১২]

  • অনেক বেশি চুলকানি হওয়া, বিশেষ করে হাতের তালু ও পায়ের পাতায়। তবে পুরো শরীরেও এমন চুলকানি হতে পারে
  • সন্ধ্যায় ও রাতে চুলকানি বেড়ে যাওয়া। অতিরিক্ত চুলকানির ফলে চামড়া উঠে যেতে পারে
  • গাঢ় রঙের প্রস্রাব এবং ফ্যাকাসে পায়খানা হওয়া
  • কিছু ক্ষেত্রে জন্ডিস হওয়া, অর্থাৎ ত্বক ও চোখের সাদা অংশ হলুদাভ হয়ে যাওয়া

ডাক্তারি ভাষায় একে বলা হয় ‘ইন্ট্রাহেপাটিক কোলেস্ট্যাসিস’। এই রোগটি কেবল গর্ভাবস্থাতেই হয়। লিভারের এই রোগ খুব গুরুতর রূপ ধারণ করতে পারে। এতে অকাল প্রসব ও মৃতপ্রসবের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।

গর্ভকালীন বিশেষ চর্মরোগ

গর্ভাবস্থায় এমন কিছু নির্দিষ্ট চর্মরোগ হতে পারে, যা সাধারণ অবস্থায় দেখা দেয় না। এসব চর্মরোগের লক্ষণগুলোর মধ্যে কিছু মিল থাকলেও র‍্যাশ ও রোগের ধরনে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। কমন লক্ষণের মধ্যে রয়েছে চুলকানির সাথে লাল লাল ফুসকুড়ি বা র‍্যাশ হওয়া।

এমন হলে দ্রুত ডাক্তার দেখিয়ে তার পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন। কেননা এসবের মধ্যে কিছু রোগ থেকে মা ও বিশেষ করে গর্ভের শিশুর মারাত্মক জটিলতায় ভোগার সম্ভাবনা রয়েছে।

চুলকানির সাথে সৃষ্টি হওয়া অন্য উপসর্গগুলো কোন রোগের কারণে হতে পারে এবং তাতে মা ও গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি কেমন, তা জানতে নিচের ছকটি দেখুন[১৩]

গর্ভকালীন পেমফিগয়েড

লক্ষণ

  • বুকে-পেটে অথবা নাভির চারপাশে ছোটো ছোটো লাল র‍্যাশ, ফোসকা বা ফুসকুড়ি সৃষ্টি হয়
  • পরবর্তীতে এসব র‍্যাশ ও ফুসকুড়ি সারা দেহে ছড়িয়ে যায়।
  • পরবর্তীতে ফোসকাগুলো তরলে ভরে গিয়ে টানটান হয়ে উঠতে পারে

ঝুঁকি

শিশুর সময়ের আগেই জন্মগ্রহণ করার ও আকারে ছোটো হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। মায়ের পরবর্তী গর্ভাবস্থাতেও গর্ভকালীন পেমফিগয়েড হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

পলিমরফিক ইরাপশন অফ প্রেগন্যান্সি

লক্ষণ

  • পেটের ফাটা দাগের ওপরে খুব চুলকায় এমন লাল লাল, ছোটো র‍্যাশ হয়। তবে নাভির চারপাশের ত্বকে সাধারণত কোনো র‍্যাশ থাকে না।
  • ১–২ দিন পরে র‍্যাশগুলো হাতে-পায়ে, বুকে-পিঠে ছড়িয়ে যায়। এরপর একত্র হয় উঁচু উঁচু র‍্যাশ তৈরি করে
  • ত্বক ফর্সা হলে লাল ফুসকুড়ির চারপাশ দিয়ে সাদা রিংয়ের মতো দাগ তৈরি হয়

ঝুঁকি

মায়ের চুলকানি ছাড়া মা ও শিশুর তেমন সমস্যা হয় না।

পাস্টুলার সোরিয়াসিস অফ প্রেগন্যান্সি

লক্ষণ

  • লাল লাল র‍্যাশ হয়, র‍্যাশের মধ্যে পুঁজ থাকে। সাধারণত বুক-পেট, হাত ও পায়ে এমন ফুসকুড়ি হয়।
  • নখ তার নিচের চামড়া থেকে কিছুটা উঠে উঠে যেতে পারে। কারও কারও নখ সামান্য দেবেও যেতে পারে

ঝুঁকি

গর্ভপাত, মৃতপ্রসব, সময়ের আগেই জন্মগ্রহণ করার এবং আকারে ছোটো সম্ভাবনা থাকে। প্রসবের পরে মায়ের এই রোগের তীব্রতা বেড়ে যেতে পারে।

অ্যাটোপিক ইরাপশন অফ প্রেগন্যান্সি

লক্ষণ

  • মুখে, ঘাড়ে, বুকের ওপরের অংশে, কনুইয়ে, হাতে ও পায়ে একজিমার মতো র‍্যাশ হয়
  • কখনো কখনো ত্বক অনেক বেশি শুষ্ক হয়ে পড়ে

ঝুঁকি

গর্ভের শিশুর তেমন সমস্যা হয় না। মায়ের পরবর্তী গর্ভাবস্থাতেও এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

চুলকানির ঔষধ

ঘরোয়া সমাধানগুলো অনুসরণের পরেও চুলকানির সমস্যা না কমলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করে লক্ষণ অনুযায়ী উপযুক্ত পরামর্শ ও ঔষধ দিয়ে সাহায্য করবেন। চুলকানির সমস্যায় সাধারণত যেসব ঔষধ ব্যবহার হয়, সেগুলো হলো—

  • এমোলিয়েন্ট অয়েন্টমেন্ট, ক্রিম ও লোশন
  • অ্যান্টিহিস্টামিন ট্যাবলেট
  • স্টেরয়েড মলম ও ট্যাবলেট

এসবের মধ্যে এমোলিয়েন্ট ছাড়া কোনো ঔষধ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনোক্রমেই ব্যবহার করবেন না। কেননা এসব ঔষধের বিভিন্ন ধরন ও ডোজ থাকে, যার মধ্যে অনেকগুলো গর্ভাবস্থার জন্য নিরাপদ নয়। তা ছাড়া স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ প্রয়োজনের চেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে এবং অতিরিক্ত ডোজে ব্যবহার করলে সেটি আপনার ও গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।[১৪]

সাধারণ জিজ্ঞাসা

গর্ভাবস্থায় পেটে নখ দিয়ে চুলকালে গর্ভের বাচ্চার কোনো সমস্যা হবে?

গর্ভাবস্থায় আপনি পেটে নখ দিয়ে চুলকালে বাচ্চার কোনো সমস্যা হবে না। তবে নখ দিয়ে চুলকানোর ফলে ত্বকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষত সৃষ্টি হয়। এসবের ভেতর দিয়ে জীবাণু ঢুকে ত্বকে ইনফেকশন ঘটাতে পারে, সঠিক চিকিৎসার অভাবে মারাত্মক রূপ নিতে পারে।
তাই চুলকানি উঠলেও ত্বক না চুলকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন। চুলকানোর পরিবর্তে আঙুলের ত্বক দিয়ে চুলকানি ওঠা স্থানটি আলতো করে চেপে চেপে নিন। ত্বকে আঘাত ও ইনফেকশন এড়াতে নখ ছোটো করে কেটে নিন এবং সবসময় মসৃণ ও পরিষ্কার রাখুন।

গর্ভাবস্থায় চুলকানি দূর করার জন্য কোনো মলম অথবা ক্রিম ব্যবহার করলে বাচ্চার ক্ষতি হবে?

গর্ভাবস্থার পেটের চুলকানি কমাতে ঘরোয়া সমাধান অনুসরণ করতে পারেন। এতেও চুলকানি না কমলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ডাক্তার উপসর্গ অনুযায়ী উপযুক্ত ও নিরাপদ ক্রিম অথবা মলম ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারবেন। তবে এমন অনেক ঔষধ আছে, যা সাধারণ অবস্থায় ব্যবহারের জন্য নিরাপদ হলেও গর্ভাবস্থায় ব্যবহার করা নিরাপদ না-ও হতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া চুলকানির ক্রিম অথবা মলম ব্যবহার করবেন না।
তবে চুলকানির স্থানে ঘরোয়াভাবে মেনথলযুক্ত অথবা ক্যালামাইনযুক্ত ক্রিম অথবা লোশন ব্যবহার করতে পারেন। এগুলো গর্ভাবস্থায় ব্যবহার করা নিরাপদ। এগুলো চুলকানি থেকে কিছুটা আরাম দিতে পারে।

গর্ভাবস্থায় পেটের চুলকানি থেকে ঘা হলে গর্ভের বাচ্চার কোনো ক্ষতি হবে?

গর্ভকালীন সময়ে আপনার ঘা আসলে ঠিক কোন কারণে হয়েছে, তার ওপর নির্ভর করবে যে আপনার বাচ্চার আদৌ কোনো ক্ষতি হবে না কি হবে না। সাধারণ চুলকানির কারণে নখের আঁচড় লেগে ঘা হয়ে থাকলে, সময়মতও ডাক্তারের পরামর্শ মেনে ঔষধ সেবন করলে এবং চুলকানো থেকে বিরত থাকলে সেটা সাধারণত ভালো হয়ে যায়।
তবে কোনো নির্দিষ্ট রোগের কারণে ঘা হলে সেই রোগের ওপর নির্ভর করে গর্ভবতী মা ও তার শিশুর নানান ধরনের জটিল সমস্যা হতে পারে। তাই কোথাও ঘা হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন। সেই সাথে চুলকানি হলেও নখ দিয়ে ত্বক চুলকানো থেকে বিরত থাকুন।

(১৪)

  1. Pomeranz, Miriam Keltz. “Maternal Adaptations to Pregnancy: Skin and Related Structures.” UpToDate, edited by Charles J Lockwood, 2022, https://www.uptodate.com/contents/maternal-adaptations-to-pregnancy-skin-and-related-structures. Accessed 5 Jan. 2023.
  2. Szczęch, Justyna, et al. “Prevalence and Relevance of Pruritus in Pregnancy.” BioMed Research International, vol. 2017, 2017, pp. 1–6.
  3. Szczęch, Justyna, et al. “Prevalence and Relevance of Pruritus in Pregnancy.” BioMed Research International, vol. 2017, 2017, pp. 1–6.
  4. American Academy of Dermatology. “How to Relieve Itchy Skin.” AAD, https://www.aad.org/public/everyday-care/itchy-skin/itch-relief/relieve-itchy-skin. Accessed 5 Jan. 2023.
  5. Tivoli, Yvette A., and Richard M. Rubenstein. “Pruritus: An Updated Look at an Old Problem.” The Journal of Clinical and Aesthetic Dermatology, vol. 2, no. 7, July 2009.
  6. American Academy of Dermatology. “Dermatologists’ Top Tips for Relieving Dry Skin.” AAD, https://www.aad.org/public/everyday-care/skin-care-basics/dry/dermatologists-tips-relieve-dry-skin. Accessed 5 Jan. 2023.
  7. American Academy of Dermatology. “Dermatologists’ Top Tips for Relieving Dry Skin.” AAD, https://www.aad.org/public/everyday-care/skin-care-basics/dry/dermatologists-tips-relieve-dry-skin. Accessed 5 Jan. 2023.
  8. American College of Obstetricians and Gynecologists. “Skin Conditions During Pregnancy.” ACOG, https://www.acog.org/womens-health/faqs/skin-conditions-during-pregnancy. Accessed 5 Jan. 2023.
  9. American Academy of Dermatology. “How to Relieve Itchy Skin.” AAD, https://www.aad.org/public/everyday-care/itchy-skin/itch-relief/relieve-itchy-skin. Accessed 5 Jan. 2023.
  10. Pomeranz, Miriam Keltz. “Maternal Adaptations to Pregnancy: Skin and Related Structures.” UpToDate, edited by Charles J Lockwood, 2022, https://www.uptodate.com/contents/maternal-adaptations-to-pregnancy-skin-and-related-structures. Accessed 5 Jan. 2023.
  11. Rinaldi, Giulia. “The Itch-Scratch Cycle: A Review of the Mechanisms.” Dermatology Practical & Conceptual, vol. 9, no. 2, Apr. 2019, pp. 90–97.
  12. Pomeranz, Miriam Keltz. “Dermatoses of Pregnancy.” UpToDate, edited by Charles J Lockwood, https://www.uptodate.com/contents/dermatoses-of-pregnancy. Accessed 5 Jan. 2023.
  13. Pomeranz, Miriam Keltz. “Dermatoses of Pregnancy.” UpToDate, edited by Charles J Lockwood, https://www.uptodate.com/contents/dermatoses-of-pregnancy. Accessed 5 Jan. 2023.
  14. Schnopp, Christina, and Johannes Ring. “Atopic Eczema and Itch in Pregnancy: Therapeutic Considerations.” Current Dermatology Reports, vol. 1, no. 4, Oct. 2012, pp. 203–08.