একজন নারীর শরীরে যোনি ও পায়ুপথের অন্তর্বর্তী অংশটিকে ডাক্তারি ভাষায় ‘পেরিনিয়াম’ বলে। এই অংশটি ত্বক ও পেশি দিয়ে গঠিত। নরমাল ডেলিভারিতে যোনিপথে সন্তান প্রসবের সময় স্বাভাবিকভাবেই পেরিনিয়ামে চাপ পড়ে, যার ফলে অনেকসময় জায়গাটি ছিঁড়ে যায়।
পেরিনিয়াল ম্যাসাজ হলো মালিশের মাধ্যমে পেরিনিয়ামকে স্ট্রেচ বা টানটান করার একটি উপায়। গর্ভাবস্থার শেষের দিকে নিয়ম মেনে পেরিনিয়াল ম্যাসাজ করা যায়। আবার প্রসবের সময় যখন মা পুশ করে বা ধাক্কা দিয়ে সন্তান নিচে নামানোর চেষ্টা করে তখনও এই ম্যাসাজটি করা যেতে পারে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, এই ম্যাসাজ ডেলিভারি জনিত যোনিপথের ব্যথা, পেরিনিয়ামের ক্ষত ও যোনিপথে সেলাইয়ের প্রয়োজনীয়তা কমাতে সাহায্য করতে পারে।[১]
পেরিনিয়ামের ক্ষত বলতে কী বুঝায়?
যোনিপথে প্রসবের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পেরিনিয়াম, যোনি অথবা বাইরের যৌনাঙ্গে ক্ষত হওয়া অথবা ছিঁড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব ক্ষত বা ছেড়া পুরোপুরি শুকিয়ে যায় এবং দীর্ঘমেয়াদী কোনো জটিলতা তৈরি করে না।
তবে পেরিনিয়ামে বড়ো কোনো ক্ষত হলে তা বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি করতে পারে।[২] যেমন—
- প্রসবের পরও দীর্ঘদিন পর্যন্ত পেরিনিয়ামে ব্যথা হতে থাকা
- সহবাসের সময় যৌনাঙ্গে ব্যথা হওয়া
- প্রস্রাবের সমস্যা
- পায়খানা ধরে রাখতে সমস্যা হওয়া
এসব সমস্যা এড়ানোর জন্য যখন ডাক্তাররা মনে করেন বড় রকমের ক্ষত তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তারা প্রসবের সময় যোনিপথে ছোটো একটি সাইড কাটা দেন, যার নাম এপিসিওটমি। এর ফলে প্রসবের রাস্তা প্রশস্ত হয়, যাতে শিশু সহজে বের হয়ে আসতে পারে। তবে এপিসিওটমিও পুরোপুরি জটিলতা মুক্ত নয়। এটি থেকে কখনো কখনো জটিলতা তৈরি হতে পারে।
যোনিপথে প্রসবের ক্ষেত্রে পেরিনিয়ামের ক্ষত বলতে সন্তানের যোনিপথ দিয়ে বের হওয়ার ফলে তৈরি ক্ষত এবং প্রয়োজনে কাটা এপিসিওটমি দুইটাই বোঝায়।[৩]
পেরিনিয়াল ম্যাসাজ কেন করা উচিৎ?
পেরিনিয়াম মালিশের উদ্দেশ্য হলো প্রসবের জন্য পেরিনিয়ামকে প্রস্তুত করে তোলা, যাতে প্রসবের সময় যোনিপথ, পেরিনিয়াম ও পায়ুপথের ওপর যেই অতিরিক্ত চাপ পড়ে তার সাথে পেরিনিয়াম মানিয়ে নিতে পারে এবং অতিরিক্ত সাইড কাটারও প্রয়োজন না পড়ে।
গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় পেরিনিয়াল ম্যাসাজ করা হলে প্রসবের সময় এপিসিওটমির প্রয়োজনীয়তা কমে যায়।[৪] অর্থাৎ ম্যাসাজ করে প্রসব পথ টানটান করার ফলে প্রসবের রাস্তা সন্তানকে বের করে আনার চাপ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। যার ফলে বড় রকমের ক্ষত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় এবং পেরিনিয়ামে আলাদা করে সাইড কাটার প্রয়োজন পড়ে না।
কাদের ক্ষত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে?[৫]
- প্রথমবার যোনিপথে সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে[৬]
- গর্ভের শিশু যদি আকারে বড়ো হয়। সাধারণত ৪ কেজি বা ৯ পাউন্ডের বেশি হলে[৭][৮]
- ডেলিভারির সময় ফোরসেপ বা ভেনটুস জাতীয় কোনো যন্ত্র বা ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহারের প্রয়োজন হয়
- গর্ভের ভেতরে শিশু লম্বালম্বি না থেকে আড়াআড়ি থাকলে কিংবা মুখ সামনের দিকে না থেকে পেছনের দিকে ঘুরানো থাকলে[৯]
- প্রসবের সময় মায়ের পজিশন যদি এমন হয় যাতে পেরিনিয়ামে অতিরিক্ত চাপ পড়ে
- যদি প্রসবের সময় বাচ্চাকে চাপ দিয়ে বা পুশ করে নিচে নামাতে অনেক বেশি সময় লাগে
- প্রসূতি মায়ের বয়স ৩০ বছর বা এর বেশি হলে[১০]
- এর আগে কখনো এপিসিওটোমি বা সাইড কাটার প্রয়োজন হয়ে থাকলে[১১]
- এর আগে সিজার হয়েছে কিন্তু এবার নরমাল ডেলিভারি করাতে চাচ্ছেন এমন মায়েদের ক্ষেত্রে[১২][১৩]
- মা যদি অপুষ্টিতে ভুগে থাকেন
- মায়ের শরীরে কোলাজেন এর ঘাটতি থাকলে কিংবা ঠিকমতো কোলাজেন তৈরি না হলে
এসব ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় নিয়মিত পেরিনিয়াল ম্যাসাজ নিলে বিশেষ লাভ হতে পারে। এ ছাড়া প্রসবের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে এই ম্যাসাজ আপনাকে সহায়তা করবে।
প্রসবের সময় সন্তান যোনিপথ দিয়ে নেমে আসার সময় কী রকম অনুভূতি হয় পেরিনিয়াল ম্যাসাজের ফলে সেই বিষয়ে আপনি একটি ধারণা পাবেন। ম্যাসাজে যেমন করে আপনার পেরিনিয়ামের পেশি টানটান করা হয় সন্তান প্রসব পথে বের হয়ে আসার সময় প্রায় একই রকম একটা টান অনুভব করবেন।
পেরিনিয়াল ম্যাসাজ কখন করা উচিত
গর্ভাবস্থার ৩৫তম সপ্তাহ থেকে নিয়মিত পেরিনিয়াল ম্যাসাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।[১৪][১৫][১৬] সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ বার করে ম্যাসাজ করুন এবং প্রতিবার কমপক্ষে ৫ মিনিট ম্যাসাজ করার চেষ্টা করুন। যদি সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ বার করা কষ্টকর মনে হয় তাহলে সপ্তাহে এক অথবা দুই বার করেও কিছুটা লাভ পেতে পারেন।
পেরিনিয়াল ম্যাসাজের কীভাবে করতে হয়
ম্যাসাজের প্রস্তুতি
পেরিনিয়াল মালিশ শুরু করার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমন—
১. সঠিক দেহভঙ্গি: মালিশের সময় এমনভাবে বসবেন বা দাঁড়াবেন যাতে আপনি স্বচ্ছন্দে ম্যাসাজের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেন। গর্ভবতী নারীরা বিভিন্ন ভঙ্গীতে বসে অথবা দাড়িয়ে ম্যাসাজ করতে পারবেন। যেমন—
- বিছানা অথবা সোফায় বসে, বালিশে পিঠ হেলান দিয়ে
- বাথরুমের কমোডে বসে
- দাঁড়িয়ে, এক পা লম্বা করে টুলের ওপর রেখে। এ ক্ষেত্রে কিছু সময় পর পর টুলের ওপর থেকে এক পা নামিয়ে অন্য পা সোজা করে রাখবেন
- বাথ টাবে বসে। হেলান দিয়ে, এক পা বাথ টাবের পাশ দিয়ে ঝুলিয়ে। এ ক্ষেত্রেও কিছু সময় এক পা বাথ টাবের পাশ দিয়ে ঝুলাবেন এবং কিছু সময় পর অন্য পা ঝুলাবেন
আপনার জন্য যেটা সবচেয়ে আরামদায়ক মনে হয় আপনি সেই ভঙ্গীটি বেছে নিবেন। মালিশ শুরুর আগে আপনার প্রস্রাবের চাপ নেই তা নিশ্চিত করুন। প্রস্রাবের চাপ থাকলে প্রস্রাব করে নিন।
২. পরিষ্কার হাত: ম্যাসাজ শুরু করার আগে দুই হাত ভালো করে ধুয়ে নিন।
৩. মালিশের জন্য তেল: ম্যাসাজটি সহজ হওয়ার জন্য পেরিনিয়ামের ওপর মসৃণভাবে আঙ্গুল চালিয়ে যেতে হবে। সেজন্য আঙ্গুলে তেল মেখে মালিশ করতে পারেন। আপনি মালিশের জন্য যেই দুই আঙ্গুল ব্যবহার করবেন সেগুলো ভালোভাবে তেলতেলে করতে যতটুকু তেল প্রয়োজন ততটুকু তেল ব্যবহার করুন।
মালিশের জন্য অলিভ অয়েল বা জলপাইয়ের তেল, ভিটামিন ই তেল, আমন্ড অয়েল বা কাঠবাদামের তেল ব্যবহার করতে পারেন।
তবে এই ম্যাসাজের জন্য বাজারের বেবি অয়েল, খনিজ তেল (যেমন: প্যারাফিন, লিকুইড প্যারাফিন, ওয়াক্স) অথবা ঠোঁটে মাখার পেট্রোলিয়াম জেলি (যেমন: ভ্যাসলিন অথবা মেরিল পেট্রোলিয়াম জেলি) ব্যবহার করবেন না। এগুলো শুধু বাহ্যিক ব্যবহারের জন্য উপযোগী করে তৈরি করা হয়ে থাকে।
৩. নখ ছোটো রাখা: আপনার যোনি ও পেরিনিয়াম গঠনগত ভাবে খুবই কোমল। নখ লম্বা থাকলে মালিশের সময় নখ দিয়ে এই জায়গাগুলোতে আঘাত লাগতে পারে। আবার, নখ লম্বা থাকলে মালিশের সময় খোঁচা লেগে পুরো প্রক্রিয়াটি অস্বস্তিকর হয়ে পড়তে পারে। তাই মালিশের আগে নখ কেটে ছোটো করে নিতে হবে।
৪. গরম পানিতে গোসল: ম্যাসাজের আগে আগে কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করে নিতে পারেন। এতে করে আপনি মানসিকভাবে স্বস্তিতে থাকতে পারবেন। একই সাথে, গরম পানি দিয়ে গোসল করার কারণে আপনার পেরিনিয়ামের পেশীগুলো কিছুটা শিথিল আর নমনীয় হবে যার ফলে মালিশের মাধ্যমে এদের স্ট্রেচ বা টানটান করা সহজ হতে পারে।[১৭]
ম্যাসাজের পদ্ধতি
পেরিনিয়াম ম্যাসাজের জন্য নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করুন[১৮]—
ধাপ ১: মালিশের জন্য আপনার দুই বৃদ্ধাঙ্গুলি আপনার যোনির ভেতর প্রবেশ করবেন। আপনার সুবিধার জন্য আপনার দুই তর্জনীও (index finger) ব্যবহার করতে পারেন। আঙ্গুলের দ্বিতীয় গিট পর্যন্ত প্রবেশ করবেন।
ধাপ ২: এবার যোনির ভেতরে প্রবেশ করা দুই আঙ্গুল দিয়ে নিচের দিক, অর্থাৎ আপনার পায়ুর দিকে চাপ দিন। ততটুকু চাপ দিন যতটুকুতে আপনি যোনির চারপাশে টানটান অনুভব করবেন।
ধাপ ৩: এই চাপ প্রয়োগ করে ফেলতে পারলে এবার আঙ্গুল দুইটি ডান থেকে বাম পাশে, অথবা বাম থেকে ডান পাশে নিয়ে যোনিপথ মালিশ করুন। আপনার আঙ্গুল এমনভাবে নাড়বেন যেন আপনি ইংরেজি বর্ণ U বানাচ্ছেন।
চেষ্টা করবেন এসময়ে পেরিনিয়াম, অর্থাৎ যোনির চারপাশের এই পেশীগুলো যেন নরম করে রাখা যায়। এই পর্যায়ে আপনি নিজের প্রসব প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ধীরে ধীরে, লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে পারেন। সন্তান প্রসবের সময়ও এক পর্যায়ে চিকিৎসক আপনাকে এরকম লম্বা শ্বাস নিতে বলবেন।
২ থেকে ৩ মিনিট এভাবে মালিশ করুন। আপনি পেরিনিয়ামের বাইরের ত্বকও মালিশ করতে পারেন। পুরো প্রক্রিয়াটি ২ থেকে ৩ বার করতে পারেন। মালিশের শুরুতে পেরিনিয়াম এর জায়গাটি খুব টাইট হয়ে আছে বলে মনে হতে পারে কিন্তু মালিশ করার সাথে সাথে জায়গাটি আস্তে আস্তে নরম ও রিল্যাক্সড হয়ে আসবে।
এই মালিশটি করার সময় সাধারণত কোনো রকম ব্যথা পাওয়ার কথা নয়, যদি কোনো ধরনের ব্যথা অনুভব হয় সাথে সাথে মালিশ বন্ধ করে দিন এবং পরবর্তীতে সাবধানতার সাথে আবার চেষ্টা করুন।
নিজে নিজে মালিশ করা অস্বস্তিকর অথবা কঠিন মনে হলে আপনি আপনার সঙ্গীর সাহায্য নিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে পুরো প্রক্রিয়াটি একই রকম, শুধু আপনার পরিবর্তে আপনার সঙ্গী তার আঙুল যোনিতে প্রবেশ করিয়ে পেরিনিয়াম মালিশ করবেন। তবে মালিশের আগে হাত ও নখ পরিষ্কার রাখার সতর্কতাটি অবশ্যই যেন মেনে চলা হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
প্রসবের সময় পেরিনিয়ামের সুরক্ষা
পেরিনিয়াম মালিশের পাশাপাশি পেরিনিয়ামে বড়ো রকমের ক্ষত তৈরি না হতে দেওয়ার জন্য প্রসবের সময় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে[১৯]—
১. প্রসবের পজিশন: সাধারণত যোনিপথে প্রসবের জন্য মাকে চিৎ করে শুইয়ে, দুই পা ফাকা করে ও হাঁটুতে ভাঁজ করে দুই পাশে উঁচু করে রাখা হয়। তবে ধারণা করা হয় এক পাশে কাত হয়ে শুয়ে কিংবা হাঁটু গেরে সামনে দুই হাতে ভর করে (all-fours) প্রসব করলে পেরিনিয়ামে ভয়াবহ ক্ষত তৈরি হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।
২. গরম সেক: সন্তানের নিচে নেমে আসার সময় যদি চিকিৎসক অথবা কোনো স্বাস্থ্যকর্মী আপনার পেরিনিয়ামে প্যাড অথবা গজ দিয়ে গরম সেক দেন, সেক্ষেত্রেও ক্ষত তৈরি হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।[২০]
৩. হাত দিয়ে পেরিনিয়াম ধরে রাখা: সন্তান নিচে নেমে আসার সময় চিকিৎসক আপনার পেরিনিয়ামে এক হাত চেপে পেরিনিয়ামকে আগলে ধরে রাখতে পারেন। একে বলে ম্যানুয়াল সাপোর্ট অফ পেরিনিয়াম। এতে করে ভয়াবহ ক্ষত তৈরি হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।