গর্ভাবস্থায় রক্ত পরীক্ষা

গর্ভবতী নারীর শারীরিক অবস্থার সঠিক ও বিশদ ধারণা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে কিছু রক্ত পরীক্ষা, যেগুলো গর্ভাবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সাধারণ একটি রক্ত পরীক্ষা থেকেই আপনার ও আপনার গর্ভের সন্তানের সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য পাওয়া যায়। পরীক্ষাগুলো বিভিন্ন রোগ নির্ণয় এবং যথাসময়ে চিকিৎসা শুরু করতে সাহায্য করতে পারে।

রক্ত পরীক্ষায় যেসব বিষয় দেখা হয়

গর্ভাবস্থায় সাধারণত নিচের রক্ত পরীক্ষাগুলো করাতে হয়—

  • রক্তের গ্রুপ
  • রক্তের হিমোগ্লোবিন ও বিভিন্ন রক্ত কণিকার সংখ্যা
  • ইনফেকশনের অস্তিত্ব। যেমন: হেপাটাইটিস বি ও সিফিলিস
  • রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা
  • থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা

রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা

রক্তের গ্রুপ সাধারণত এ (A), বি (B), এবি (AB) অথবা ও (O)—এই ৪টি গ্রুপের মধ্যে যেকোনো একটি হয়। গ্রুপ পরীক্ষা করার মাধ্যমে আপনার রক্তের গ্রুপ কোনটি এবং তা পজিটিভ নাকি নেগেটিভ, সেটা নির্ণয় করা যায়।

সময়মতো সঠিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য আপনার রক্তের সঠিক গ্রুপ জানা থাকা জরুরি। কেননা গর্ভাবস্থায় অথবা প্রসবের সময়ে যেকোনো কারণে রক্তক্ষরণ হলে আপনাকে দ্রুত রক্তপ্রদানের প্রয়োজন হতে পারে।

জরুরি অবস্থায় রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করতে হলে আপনার চিকিৎসায় বিলম্ব হতে পারে, যার ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। তাই আগে থেকে রক্তের গ্রুপিং করে রাখুন এবং এর রিপোর্ট যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করুন। প্রতি চেকআপে ও ডেলিভারির সময়ে কাগজটি মনে করে নিয়ে যাবেন।

উল্লেখ্য, কিছু বিরল ক্ষেত্রে রক্তের গ্রুপ পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। তাই সতর্কতাবশত ডেলিভারির সম্ভাব্য তারিখের ২-৩ সপ্তাহ আগে রক্তের গ্রুপ আবারও পরীক্ষা করিয়ে নিন।

পজিটিভ বনাম নেগেটিভ রক্তের গ্রুপ

রক্তের গ্রুপ পরীক্ষার সময়ে যদি আপনার রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ দেখা যায়, অর্থাৎ নিচের যেকোনো গ্রুপের হয়, তাহলে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে—

  1. এ নেগেটিভ (A -ve)
  2. বি নেগেটিভ (B -ve)
  3. এবি নেগেটিভ (AB -ve)
  4. ও নেগেটিভ (O -ve)

এর কারণ হলো, শিশুর রক্তের গ্রুপ মা ও বাবার রক্তের গ্রুপের ওপর নির্ভর করে পজিটিভ অথবা নেগেটিভ হতে পারে। যদি গর্ভের সন্তানের রক্ত পজিটিভ গ্রুপের হয় (যেমন: এ পজিটিভ) কিন্তু মায়ের রক্ত নেগেটিভ গ্রুপের হয় (যেমন: এ নেগেটিভ), তখন  গর্ভের শিশুর মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতার—এমনকি মৃত্যুবরণ করার আশংকা থাকে। ডাক্তারি ভাষায় একে ‘আরএইচ (Rh) ইনকম্প্যাটিবিলিটি’ বলা হয়।

এক্ষেত্রে গর্ভের শিশুর ‘পজিটিভ’ গ্রুপের রক্ত মায়ের শরীরের কাছে অপরিচিত হয়ে থাকে। এর ফলে মায়ের রক্তে শিশুর অপরিচিত রক্তের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এই অ্যান্টিবডি ‘পজিটিভ’ রক্তকে শরীর থেকে দূর করার জন্য শিশুর রক্ত কণিকা ধ্বংস করে।

আগে কখনো গর্ভপাত না হলে অথবা গর্ভাবস্থায় জরায়ুর ভেতরে রক্তপাত না হলে, সাধারণত গর্ভের প্রথম শিশুর ওপর আরএইচ ইনকম্প্যাটিবিলিটি এর কোনো প্রভাব পড়ে না। তবে পরবর্তীতে পজিটিভ রক্তের অধিকারী শিশু গর্ভে আসলে, শিশুর নানান স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দিতে পারে।

এক্ষেত্রে গর্ভের শিশুর রক্তশূন্যতা হতে পারে, যা থেকে শিশুর অক্সিজেনের মারাত্মক অভাব সৃষ্টি হতে পারে। আরও কিছু জটিলতা (যেমন: জন্মের পর সন্তানের রক্ত কণিকা ভেঙ্গে রক্তশূন্যতা হওয়া, নবজাতক শিশুর জন্ডিস হওয়া) দেখা দিতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে শিশু গর্ভেই অথবা জন্মগ্রহণের পর পরই মারা যায়।

আরএইচ ইনকম্প্যাটিবিলিটি প্রতিরোধ করতে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করা গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত মায়ের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ হলে প্রথম সন্তান গর্ভে থাকাকালেই মাকে ‘অ্যান্টি ডি’ ইনজেকশন বা আরএইচ ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়া হবে। এটি সাধারণত গর্ভাবস্থার ২৮তম সপ্তাহে দেওয়া হয়।[১] অনেকসময় ৩৪তম সপ্তাহেও আরেকবার ইনজেকশন দেওয়া হয়।

সেই সাথে প্রতিবার পজিটিভ রক্তের গ্রুপের সন্তান ডেলিভারির প্রথম ৭২ ঘন্টার মধ্যে আরেকবার ‘অ্যান্টি ডি’ ইনজেকশন নিতে হবে। গর্ভবতীর যদি কোনো রক্তক্ষরণ, পেটে আঘাত লাগা অথবা গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে থাকে, সেক্ষেত্রেও ‘অ্যান্টি ডি’ ইনজেকশন নিতে হবে।

সিবিসি পরীক্ষা

সিবিসি (CBC) পরীক্ষায় মূলত রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ দেখা হয়। এই পরিমাণ দেখে আপনার রক্তশূন্যতা আছে কি না সেটা নির্ণয় করা যায়। সিবিসিতে হিমোগ্লোবিনের পাশাপাশি রক্তের লোহিত কণিকার পরিমাণ ও আকার সম্পর্কিত তথ্যও উঠে আসে। এসব তথ্য থেকে আপনার রক্তশূন্যতার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে সেটা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—আয়রনের অভাব, ভিটামিনের অভাব ও থ্যালাসেমিয়া নামক বংশগত রোগ।

রক্তশূন্যতা ধরা পড়লে তার পেছনের কারণ নির্ণয়ের জন্য ডাক্তার আরও কিছু পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিবেন। যেমন: আয়রন প্রোফাইল, পিবিএফ (PBF), হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস, ভিটামিন বি১২ ও ফোলেট লেভেল। এরপর ফলাফল অনুযায়ী চিকিৎসা সংক্রান্ত উপদেশ দিবেন।

এমন উপদেশের মধ্যে থাকতে পারে খাবার তালিকায় নির্দিষ্ট কিছু খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া, বাড়তি আয়রনযুক্ত ট্যাবলেট সেবন করা, শিশুর ব্রেইনের ত্রুটি প্রতিরোধে অধিক ডোজে ফলিক এসিড খাওয়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে গর্ভবতীকে রক্তপ্রদান করা।

গর্ভাবস্থায় আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা

গর্ভকালীন সময়ে আপনার শরীরে আয়রনের চাহিদা অনেকটা বেড়ে যায়। গর্ভের শিশুর সঠিক বিকাশ ও সুস্থ প্রসবের জন্য গর্ভবতীর আয়রনের চাহিদা মেটানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ করতে না পারলে গর্ভবতী মায়ের আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা হতে পারে। সেই সাথে গর্ভের শিশুর নানান স্বাস্থ্য জটিলতা তৈরি হতে পারে।

পড়ুন: গর্ভাবস্থায় আয়রন

উল্লেখ্য, সিবিসি পরীক্ষায় রক্তের অন্যান্য কণিকা (যেমন: শ্বেত রক্তকণিকা ও প্লেইটলেট) সম্পর্কিত তথ্যও উঠে আসে। শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা ইনফেকশন চিহ্নিত করতে এবং প্লেটলেটের সংখ্যা রক্ত জমাটের সমস্যা চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।

হেপাটাইটিস বি পরীক্ষা

এই পরীক্ষাটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে HBsAg নামে পরিচিত। এর সাহায্যে শরীরে হেপাটাইটিস বি ইনফেকশনের উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়। HBsAg যদি পজিটিভ আসে, তার অর্থ আপনি হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত।

হেপাটাইটিস বি ভাইরাস লিভারের প্রদাহ থেকে শুরু করে বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা, এমনকি লিভার ক্যান্সার ঘটাতে পারে। এই ইনফেকশন আপনার কাছ থেকে গর্ভের সন্তানে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমন শিশুদের আজীবন এই ইনফেকশনে ভোগার সম্ভাবনা অনেক বেশি।[২] কিন্তু শিশুকে যদি সঠিকভাবে প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন দেওয়া হয়, তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ঘটনা প্রতিরোধ করা যায়।[৩]

আপনার হেপাটাইটিস বি পরীক্ষার ফলাফল যদি পজিটিভ আসে, তাহলে আপনাকে গর্ভাবস্থায় বিশেষ তত্ত্বাবধানে রাখা হবে। প্রসবের সময়েও বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। আপনার শিশুকে জন্মের পর পর হেপাটাইটিস বি এর প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন ও ইনজেকশন দেওয়া হবে। এতে শিশুর হেপাটাইটিস বি জনিত দীর্ঘমেয়াদি জটিলতায় ভোগার সম্ভাবনা কমে আসবে।

সিফিলিস পরীক্ষা

এই পরীক্ষার নাম ভিডিআরএল টেস্ট। এই পরীক্ষায় আপনার সিফিলিস নামক রোগ আছে কি না তা পরীক্ষা করা হয়। গর্ভবতী নারী সিফিলিসে আক্রান্ত হলে এর জীবাণু তার গর্ভের সন্তানে ছড়িয়ে পড়ার আশংকা থাকে।

সিফিলিস একটি যৌনবাহিত রোগ। এটি অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য জটিলতা তৈরি করতে পারে। শিশুর শরীরে ছড়িয়ে পড়লে তা থেকে নানান মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতা হতে পারে। এমনকি গর্ভপাত অথবা শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

পেনিসিলিন নামক একটি সহজলভ্য অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশনের সাহায্যে গর্ভের শিশুর সিফিলিসের প্রতিরোধ করা যায়। যত তাড়াতাড়ি এর চিকিৎসা শুরু করা হবে, গর্ভের শিশুর মাঝে এটি ছড়িয়ে পড়ার আশংকা তত কমবে। তাই সময়মতো পরীক্ষা করে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী শিশুর চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন।

রক্তের সুগার পরীক্ষা

রক্তের সুগার পরীক্ষা করার বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। আমাদের দেশে ওজিটিটি (OGTT) বা ‘ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট’ নামক বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভবতীর রক্তে সুগারের লেভেল পরিমাপ করা হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভবতীর ডায়াবেটিস আছে কি না তা নির্ণয় করা হয়।

গর্ভাবস্থায় প্রথমবারের মতো ডায়াবেটিস ধরা পড়লে একে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলে। এটি সাধারণত প্রসবের পর নিজেই সেরে যায়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে একদিকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নির্ণয় করা যায়, অন্যদিকে গর্ভধারণের আগে থেকে ডায়াবেটিক—এমন নারীদের রক্তের সুগারের লেভেল সম্পর্কেও জানা যায়।[৪]

গর্ভবতীর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে মা ও শিশুর গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী বিভিন্ন গুরুতর জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। তাই আগে থেকে ডায়াবেটিস থাকলে কিংবা গর্ভাবস্থায় প্রথমবারের মতো ডায়াবেটিস ধরা পড়লে, উভয় ক্ষেত্রেই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে। এসময়ে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়াদাওয়া, ব্যায়াম ও ডায়াবেটিসের ঔষধ সংক্রান্ত নির্দেশনা মেনে চলা এবং নিয়মিত রক্তের সুগার পর্যবেক্ষণে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশে সাধারণত অন্তত দুইবার ওজিটিটি পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রথম ওজিটিটি পরীক্ষা প্রথম গর্ভকালীন চেকআপের সময়ে অন্যান্য রক্ত পরীক্ষার সাথে একসঙ্গে করে ফেলা হয়। এরপর গর্ভাবস্থার ২৪তম–২৮তম সপ্তাহের ভেতরে আরেকবার ওজিটিটি পরীক্ষা করাতে হয়। এ ছাড়া গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকলে ২৪তম–২৮তম সপ্তাহের আগেই ওজিটিটি করানোর পরামর্শ দেওয়া হতে পারে। উল্লেখ্য, ওজিটিটি পরীক্ষার বিশেষ নিয়ম রয়েছে। তাই পরীক্ষার আগে সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে।

থাইরয়েড পরীক্ষা

থাইরয়েড আমাদের গলায় থাকা একটি গ্রন্থি, যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ হরমোন তৈরি করে। এই হরমোনগুলো আমাদের দেহের প্রায় সব কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

থাইরয়েডের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে টিএসএইচ (TSH) বা ‘থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন’। রক্তে এর পরিমাণ বেশি হলে ডাক্তারি ভাষায় তাকে ‘হাইপোথাইরয়েডিজম’ বলে। আর মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলে তাকে ‘হাইপারথাইরয়েডিজম’ বলে।

চিকিৎসার অভাবে দুটি রোগই শিশুর বিভিন্ন স্বাস্থ্য জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই থাইরয়েড পরীক্ষা করে আগেভাগে রোগ ধরে ফেলে সঠিক চিকিৎসা শুরু করা যায়।

থাইরয়েডের সমস্যার ধরনের ওপর নির্ভর করে ডাক্তার আপনাকে ঔষধ সেবনের পরামর্শ দিবেন। আগে থেকে থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে তিনি ঔষধের ডোজ পরিবর্তন করে দিতে পারেন। কিছু ক্ষেত্রে আবার চলমান ঔষধের ডোজ সাময়িকভাবে বন্ধ করতে পারেন।

এ ছাড়া তিনি গর্ভাবস্থায় ও প্রসবের পরে আপনাকে নির্দিষ্ট সময় পর পর থাইরয়েড হরমোনের পরীক্ষা করার পরামর্শ দিবেন। সেই সাথে শিশুর জন্মের পর তার রক্ত নিয়েও থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণ কম-বেশি আছে কি না নির্ণয়ের পরীক্ষা করা হবে।

কখন রক্ত পরীক্ষা করা হয়

গর্ভাবস্থার বিভিন্ন সময়ে রক্ত পরীক্ষা করে রক্তের বিভিন্ন উপাদান থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত নিচের সময়কাল অনুযায়ী এসব রক্ত পরীক্ষা করানো হয়—

গর্ভধারণের পর যত দ্রুত সম্ভব

গর্ভধারণের পর প্রথম সাক্ষাতেই ডাক্তার আপনাকে রক্ত পরীক্ষা, প্রস্রাব পরীক্ষা ও আলট্রাসনোগ্রাফি করানোর পরামর্শ দিবেন। এসময়ে আপনার রক্ত নিয়ে এ পর্যন্ত আলোচনা করা সব রক্ত পরীক্ষাই করানো হবে। কোন পরীক্ষা কখন ও কীভাবে করাতে হবে, সেই সম্পর্কিত তথ্যগুলো চেকআপের সময়ে ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নিন।

গর্ভধারণের পর যত দ্রুত সম্ভব প্রথম চেকআপে যাওয়া জরুরি। যত দ্রুত গর্ভকালীন চেকআপ শুরু করবেন, তত দ্রুত আপনার ও গর্ভের শিশুর জন্য সঠিক পদক্ষেপগুলো নিতে পারবেন। তবে প্রথম চেকআপে যেতে যেন গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসের বেশি সময় পার হয়ে না যায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

গর্ভাবস্থার ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের ভেতর

এসময়ে আপনার রক্তের হিমোগ্লোবিন আবার পরীক্ষা করা হবে। সেই সাথে প্রস্রাবও পরীক্ষা করা হবে।

কিছু ক্ষেত্রে প্রথম ওজিটিটি ফলাফল স্বাভাবিক হওয়া সত্ত্বেও ২৪–২৮ সপ্তাহের মধ্যে আবারও পরীক্ষা করতে হতে পারে। যেমন—

  • যদি আপনার গর্ভাবস্থা সংক্রান্ত বাড়তি ঝুঁকি থাকে
  • যদি পূর্বের কোনো গর্ভাবস্থায় আপনার গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয়ে থাকে
  • যদি আপনার পরিবারে কারোর ডায়াবেটিস থেকে থাকে
  • যদি আপনি স্থুলতায় ভুগেন

গর্ভাবস্থার ৩২ সপ্তাহ

এসময়ে আবারও আপনার রক্তের হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করা হবে। সেই সাথে প্রস্রাবও পরীক্ষা করা হবে।

গর্ভাবস্থার ৩৬ থেকে ৩৮ সপ্তাহের ভেতর

সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে গর্ভাবস্থার এই সময়ে শেষবারের মতো আপনার রক্তের হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করা হবে। গর্ভবতী নারীদের রক্তশূন্যতা দেখা দেওয়া খুব কমন বলে এই পরীক্ষাটি বার বার করা হয়ে থাকে। এই সময়ের মধ্যে আপনার প্রস্রাব পরীক্ষা ও আলট্রাসনোগ্রাফিও করানো হবে।

ব্যতিক্রম

কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তার আপনাকে এই সময়কালের বাইরে ভিন্ন শিডিউলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিতে পারেন। এমনকি কিছু পরীক্ষা পুনরায় করার পরামর্শও দিতে পারেন। এমন ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে—

  • গর্ভকালীন কোনো পরীক্ষার ফলাফল অস্বাভাবিক আসা
  • গর্ভাবস্থায় নতুন করে কোনো রোগ ধরা পড়া
  • আগে থেকে কোনো স্বাস্থ্য জটিলতা থাকা

এ ছাড়া প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে কিছু বিশেষ পরীক্ষা করা হতে পারে। যেমন: লিভারের রোগ নির্ণয়ের জন্য এসজিপিটি/এএলটি (SGPT/ALT), কিডনির রোগ নির্ণয়ের জন্য সিরাম ক্রিয়েটিনিন, এইচবিএ১সি (HbA1C) এবং রক্ত জমাট বাঁধার ব্লিডিং টাইম, ক্লটিং টাইম ও প্রোথ্রমবিন টাইম পরীক্ষা।

রক্ত পরীক্ষার প্রক্রিয়া

রক্ত পরীক্ষা করার আগে

রক্ত পরীক্ষার আগে কিছু প্রস্তুতি নিতে হয়। যেমন—

  • যদি ওজিটিটি আপনার রক্ত পরীক্ষার অংশ হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই পরীক্ষার জন্য রক্ত দেওয়ার আগে ৮–১৪ ঘণ্টা আপনাকে খালি পেটে থাকতে হবে। পানি ছাড়া অন্য কোনো খাবার বা পানীয় এই সময়ে খাওয়া যাবে না। এর কারণ হলো, এই পরীক্ষার একটি অংশে খালি পেটে আপনার রক্তে সুগারের মাত্রা দেখা হয়।
  • যদি আপনি অ্যাসপিরিন অথবা রক্ত পাতলা করার কোনো ঔষধ খেয়ে থাকেন, তবে রক্ত সংগ্রহের আগে সেটা স্বাস্থ্যকর্মীকে জানাবেন। সুঁই ঢুকিয়ে রক্ত সংগ্রহের পর বেশিক্ষণ যাবত রক্তক্ষরণ হয় কি না সেদিকে তিনি নজর রাখতে পারবেন।
  • প্রচুর পরিমাণ পানি পান করবেন। এটি আপনার রক্তের পরিমাণ বাড়াতে এবং আপনার শিরা-উপশিরা স্পষ্ট করতে সাহায্য করতে পারে। ফলে সহজেই রক্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হতে পারে।
  • ঢিলে হাতা বা ছোটো হাতার পোশাক পরে যাবেন। আপনি বোরখা পরলে হাতা সহজেই কনুইয়ের ওপর পর্যন্ত ওঠানো যায় এমন বোরখা পরে যাবেন। এতে রক্ত সংগ্রহ করা সহজ হবে এবং অযাচিত ঝামেলা এড়ানো সহজ হবে।
  • রক্ত দেওয়া অথবা শরীরে সুঁই ফুটানো নিয়ে কোনো ভীতি থাকলে পরিবারের কোনো সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে যান। লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করুন। রক্ত সংগ্রহের সময় সুঁইয়ের দিকে না তাকানোর চেষ্টা করতে পারেন।

রক্ত পরীক্ষার মূল প্রক্রিয়া

রক্ত পরীক্ষায় সাধারণত হাতের শিরা থেকে রক্ত সংগ্রহ করা হয়।

  • প্রথমে আপনার হাতের ওপরের অংশে দড়ির মতো একটি টার্নিকেট শক্ত করে বাঁধা হবে। এর ফলে টার্নিকেটের নিচের শিরায় রক্ত প্রবাহ সাময়িকভাবে বাধা পাবে এবং শিরাগুলো ফুলে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। শিরা স্পষ্ট হলে সেখান থেকে সহজে ও সঠিকভাবে রক্ত সংগ্রহ করা যাবে।
  • এবার যেই অংশে সুঁই ঢুকানো হবে, সেই অংশ অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া হবে। তারপর সিরিঞ্জের সাথে সংযুক্ত একটি সুঁই অথবা বাটারফ্লাই সুঁই ত্বকের ভেতর দিয়ে শিরায় ঢুকিয়ে রক্ত নেওয়া হবে। এসময়ে আপনি সামান্য খোঁচা অনুভব করতে পারেন, তবে খুব বেশি ব্যথা হওয়ার কথা না।
  • রক্ত সংগ্রহ করা হয়ে গেলে টার্নিকেট খুলে দেওয়া হবে। এরপর এক টুকরা জীবাণুমুক্ত তুলা দিয়ে সুঁই ফুটানোর স্থানটি চেপে ধরে রাখতে হবে কয়েক মিনিট। তারপর এর ওপর একটি সার্জিক্যাল টেপ অথবা ব্যান্ডএইড বসিয়ে দেওয়া হবে।

রক্ত সংগ্রহের পর

রক্ত সংগ্রহের পর রক্তপাত সাধারণত কয়েক মিনিটের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক ঘণ্টা পর ব্যান্ডএইড বা তুলা নিজে নিজেই সরিয়ে ফেলতে পারেন।

রক্ত পরীক্ষার জন্য রক্ত দেওয়ার পর সাধারণত রোগীদের কোনো সমস্যা হয় না। তবে কারও কারও মাথা ঘুরাতে পারে। 

যদি আগে কখনো রক্ত পরীক্ষার পর আপনার মাথা ঘুরে থাকে তা আগেই রক্ত সংগ্রহকারী স্বাস্থ্যকর্মীকে জানিয়ে দিন। তিনি আপনাকে আশ্বস্ত থাকতে সাহায্য করতে পারেন। রক্ত দিতে যাওয়ার সময়ে সাথে পানির বোতল রাখতে পারেন। পরীক্ষার পর পানি পান করলে আপনি ভালো অনুভব করতে পারেন।

এ ছাড়া সুঁই ঢুকানোর পর সেই স্থানে সামান্য ক্ষত হতে পারে। জায়গাটি নীলচে এবং আশেপাশে সামান্য লালচে আভা থাকতে পারে। এটি দুয়েকদিনের মাঝে নিজেই মিলিয়ে যাবে।

ফলাফল

রক্ত পরীক্ষার একেক উপাদানের ফলাফল আসতে একেক রকম সময় লাগে। যেমন: সিবিসি টেস্টের ফলাফল ১ দিনের মধ্যেই তৈরি হয়ে যেতে পারে। আবার টিএসএইচ এর ফলাফল তৈরি হতে ১ সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। সিফিলিসের পরীক্ষার ফলাফল পেতে ১–২ সপ্তাহ সময় লেগে যায়।

বিপত্তি এড়াতে রক্ত পরীক্ষার পর রিপোর্ট সংগ্রহ করতে কবে, কখন ও হাসপাতালের কোন বিভাগে যেতে হবে তা পরীক্ষা শেষেই কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জেনে নিন।

রক্ত পরীক্ষার খরচ

রক্ত পরীক্ষার বিভিন্ন উপাদানের খরচ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যখন যেই উপাদান পরীক্ষা করাতে হবে সেগুলোর খরচ যোগ করে আপনার মোট খরচের বিলটি তৈরি করা হবে। খরচ কেমন হতে পারে তার ধারণার পাওয়ার জন্য পরীক্ষাগুলোর আনুমানিক খরচ এখানে তুলে ধরা হয়েছে—

পরীক্ষার নামখরচ
সিবিসি (ইএসআর সহ)৩৫০–৫০০ টাকা
রক্তের গ্রুপিং৫০–২৫০ টাকা
ওজিটিটি১০০–৩৫০ টাকা
এইচবিএসএজি৪০০–৮০০ টাকা
ভিডিআরএল১০০–৩০০ টাকা
টিএসএইচ৫০০–৭০০ টাকা

উল্লেখ্য, হাসপাতালভেদে খরচ অন্যরকম হতে পারে। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতালে এবং বিভিন্ন এনজিওতে (যেমন: সূর্যের হাসি ক্লিনিক) তুলনামূলকভাবে খরচ কম হয়। বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারভেদে প্রতিটি পরীক্ষার খরচ বেশি হতে পারে।

জটিলতা

রক্ত পরীক্ষা খুবই নিরাপদ একটি পরীক্ষা। শুধু গর্ভাবস্থাতেই নয়, সাধারণ সময়েও বিভিন্ন কারণে রক্ত পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। সাধারণত রক্ত পরীক্ষার পর কারোরই তেমন কোনো সমস্যা হয় না। তবে সামান্য কিছু ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন—

  • সুঁই ফুটানোর স্থানে ব্যথা
  • মাথা ঘুরানো
  • অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ
  • সুঁই ফুটানোর স্থানে ইনফেকশন
  • এলার্জি
  • বিরল ক্ষেত্রে সুঁই, সিরিঞ্জ বা ল্যান্সেটের মাধ্যমে ভাইরাসের সংক্রমণ—এটি প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে সবসময় স্টেরাইল সুঁই-সিরিঞ্জের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। রক্ত সংগ্রহ করার পদ্ধতি যথাসম্ভব জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে

রক্ত পরীক্ষা থেকে যেসব তথ্য সংগ্রহ করা হয় তা আপনার ও আপনার সন্তানের সুস্থতা নিশ্চিত করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই যথাসময়ে এসব পরীক্ষা করে ফেলাই ভালো।

সাধারণ জিজ্ঞাসা

গর্ভাবস্থায় কখন ব্লাড টেস্ট করতে হবে?

গর্ভাবস্থায় সাধারণত মোট ৪ বার রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। গর্ভধারণের পর যত দ্রুত সম্ভব প্রথম ধাপের সবগুলো পরীক্ষা করাতে হয়। এরপর গর্ভাবস্থার ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের ভেতর দ্বিতীয়বার, ৩২ সপ্তাহে তৃতীয়বার এবং ৩৬–৩৮ সপ্তাহের ভেতর শেষবার রক্ত পরীক্ষা করা হয়।
তবে কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হতে পারে। চেকআপের সময়ে ডাক্তার আপনাকে এই সংক্রান্ত নির্দেশনা জানিয়ে দিবেন।

গর্ভাবস্থায় রক্ত পরীক্ষা কতবার করতে হবে?

গর্ভাবস্থায় সাধারণত ৪ বার রক্ত পরীক্ষা করা হয়। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী আরও বেশি বার রক্ত পরীক্ষা করা প্রয়োজন হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট কি ভুল আসতে পারে?

কখনো কখনো রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট পুরোপুরি সঠিক না-ও আসতে পারে। এমন ক্ষেত্রে পরীক্ষাটি পুনরায় করতে হতে পারে। ডাক্তার সাধারণত তার অভিজ্ঞতার আলোকে আপনার শারীরিক অবস্থার সাথে মিলিয়ে রিপোর্টের ভুল আন্দাজ করতে পারেন। এমন ক্ষেত্রে ভিন্ন কোনো হাসপাতাল অথবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেওয়া হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় রক্ত পরীক্ষা কি ঘরে বসেই করা যাবে?

বর্তমানে কিছু প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে ঘর থেকে রক্ত সংগ্রহের সেবা প্রদান করে থাকে। স্বাস্থ্যকর্মীরা যথাসম্ভব সঠিক ফলাফল নির্ণয়ের সুবিধার্থে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রক্তের স্যাম্পল ল্যাবে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেন। অনেকসময় রক্ত পরীক্ষার ফলাফলও তারা ঘরে পৌঁছে দেন। তবে এখনো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ হাসপাতালে বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেয়ে রক্ত পরীক্ষা করান।

গর্ভাবস্থায় রক্ত পরীক্ষা করার আগে ডাক্তার কোন দিকগুলো বিবেচনা করতে পারেন?

রক্ত পরীক্ষা করার আগে রোগী অ্যাসপিরিন কিংবা রক্ত পাতলা করার কোনো ঔষধ খাচ্ছেন কি না তা বিবেচনা করা হয়। এই ঔষধগুলো হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও ডিপ ভেইন থম্বসিসের মতো কিছু রোগে ব্যবহার করা হয়। এদের ব্যবহারের ফলে রক্ত নেওয়ার পর লম্বা সময় ধরে রক্তক্ষরণ হতে পারে। তাই রক্ত পরীক্ষা দেওয়ার আগে এটি বিবেচনায় রাখা হয়। এ ছাড়াও গর্ভবতীর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য এবং তিনি কী কী ঔষধ খাচ্ছেন সেসব বিষয়ও মাথায় রাখা হয়।

(৪)

  1. American College of Obstetricians and Gynecologists. “The Rh Factor: How It Can Affect Your Pregnancy.” ACOG, https://www.acog.org/womens-health/faqs/the-rh-factor-how-it-can-affect-your-pregnancy.
  2. Centers for Disease Control and Prevention. “Perinatal Transmission of Hepatitis B Virus.” CDC, 5 July 2022, https://www.cdc.gov/hepatitis/hbv/perinatalxmtn.htm. Accessed 8 Dec. 2022.
  3. Veronese, Piero, et al. “Prevention of Vertical Transmission of Hepatitis B Virus Infection.” World Journal of Gastroenterology, vol. 27, no. 26, July 2021, pp. 4182–93.
  4. World Health Organization. Diagnostic Criteria and Classification of Hyperglycaemia First Detected in Pregnancy. WHO Press, 2013, pp. 36–37.