আমাদের শরীরে হরমোন নামের কিছু কেমিক্যাল থাকে। এগুলো মূলত রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে পৌঁছে সঠিকভাবে কাজ করার সিগন্যাল দেয়। থাইরয়েড হরমোনগুলো এমনই কিছু গুরুত্বপূর্ণ হরমোন। গর্ভের শিশুর বুদ্ধির সঠিক বিকাশের জন্য থাইরয়েড হরমোন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভবতীর শরীরে এই হরমোনগুলো সঠিক পরিমাণে আছে কি না তা নির্ণয় করতে থাইরয়েড পরীক্ষা করা হয়।
থাইরয়েড পরীক্ষা কী
আমাদের গলার সামনে থাইরয়েড নামের একটি গ্রন্থি রয়েছে। এই গ্রন্থিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ হরমোন তৈরি হয়। এদের নাম থাইরক্সিন (T4) ও ট্রাইআয়োডোথাইরোনিন (T3)।
থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন (TSH) নামের আরেকটা হরমোন ব্রেইনের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে T3 ও T4 তৈরি হওয়ার সিগন্যাল নিয়ে আসে।
এই হরমোনগুলো রক্তের মাধ্যমে নির্ধারিত অঙ্গে পৌঁছে কাজ করে। তাই রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে থাইরয়েড হরমোনের সঠিক পরিমাণে আছে কি না সেটা যাচাই করা হয়।
থাইরয়েড পরীক্ষায় মূলত রক্তে TSH এর মাত্রা দেখা হয়। পরীক্ষার ফলাফল ও শারীরিক লক্ষণের ভিত্তিতে T4 ও T3 হরমোনসহ আরও কিছু পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেওয়া হতে পারে।
কখন করা হয়
প্রথম গর্ভকালীন চেকআপের সময়েই অন্যান্য রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষার সাথে TSH পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে পরে মাসখানেক পর পুনরায় পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে ডাক্তার আরও কিছু রক্ত পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় কেন থাইরয়েড পরীক্ষা করা হয়
থাইরয়েড হরমোন গর্ভের শিশুর বুদ্ধিবৃত্তির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা শিশুর ব্রেইন ও স্নায়ুতন্ত্রের গঠন ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।[১] বিশেষত, গর্ভাবস্থার প্রায় ১৮–২০তম সপ্তাহ পর্যন্ত শিশু মূলত মায়ের থাইরয়েড হরমোনের ওপরেই নির্ভরশীল থাকে।[২]
থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণ কম-বেশি হলে শিশুর বুদ্ধির বিকাশে বাধা সৃষ্টি হয়। চিকিৎসা না করালে এর পাশাপাশি গর্ভের শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মানো, সময়ের আগে জন্মানো, গর্ভপাত ও মৃতপ্রসবের সম্ভাবনা থাকে।[৩] এ ছাড়া মায়ের শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গের সুষ্ঠু কার্যকলাপ নিশ্চিত করতেও থাইরয়েড হরমোনগুলো সঠিক পরিমাণে থাকা অপরিহার্য।[৪]
এসব কারণে গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড পরীক্ষা করানো খুব জরুরি।[৫] পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা বাড়ানো কিংবা কমানোর ওষুধ দেওয়া হয়। এভাবে গর্ভাবস্থায় রক্তে থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রায় আনা হয়।
গর্ভাবস্থায় TSH এর স্বাভাবিক মাত্রা
গর্ভাবস্থায় রক্তে TSH এর পরিমাণ গর্ভধারণের আগের সময়ের তুলনায় কিছুটা কম থাকা স্বাভাবিক। কতখানি কম থাকবে, সেই হিসেবটা জাতিভেদে ও আরও কিছু বিষয়ের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।[৬] বাংলাদেশে গর্ভাবস্থায় TSH এর মাত্রা নিয়ে স্বল্প পরিসরে গবেষণা হয়েছে।[৭] আমরা TSH এর স্বাভাবিক মাত্রা ‘বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি’ নামক হরমোন বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী তুলে ধরছি[৮]—
প্রথম ত্রৈমাসিক | ০.১ থেকে ৩.০ mIU/L |
দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক | ০.২ থেকে ৪.০ mIU/L |
তৃতীয় ত্রৈমাসিক | ০.৩ থেকে ৪.০ mIU/L |
অতিরিক্ত TSH ও হাইপোথাইরয়েডিজম
রক্তে TSH এর মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে হাইপোথাইরয়েডিজম আছে ধরা হয়। দ্রুত চিকিৎসা শুরু না করলে গর্ভের ছোট্টমণির মস্তিষ্কের বিকাশে ত্রুটি দেখা দিতে পারে। আইকিউ অন্য শিশুদের তুলনায় কম হতে পারে।[৯][১০] শিশু সময়ের আগে ও কম ওজন নিয়ে জন্মাতে পারে।
এ ছাড়া আক্রান্ত মায়ের গর্ভপাত হওয়ার ঝুঁকি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। আবার গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ ও প্রি-এক্লাম্পসিয়া, রক্তশূন্যতা, গর্ভফুল ছিঁড়ে যাওয়া ও প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণের আশঙ্কাও বেড়ে যায়।[১১]
আপনার হাইপোথাইরয়েডিজম ধরা পড়লে ডাক্তার আরও কিছু রক্ত পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিতে পারেন। হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণ আছে কি না সেটা খতিয়ে দেখতে পারেন। এসবের ভিত্তিতে তিনি ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন, যা রক্তে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিকে নিয়ে আসবে।
হাইপারথাইরয়েডিজম
রক্তে TSH এর মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলে এবং T4 ও/অথবা T3 হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে তাকে হাইপারথাইরয়েডিজম বলে।[১২] চিকিৎসার অভাবে গর্ভের শিশুর বিকাশ বাধা প্রাপ্ত হতে পারে। নবজাতকের জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি বাড়তে পারে।[১৩] সেই সাথে গর্ভবতী মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, প্রি-এক্লাম্পসিয়া ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে।[১৪]
হাইপারথাইরয়েডিজমের জটিলতা এড়ানোর জন্যও সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করা জরুরি। কারণ ওষুধের মাধ্যমে সাধারণত হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখা যায়। ফলে গর্ভবতী ও গর্ভের সন্তান দুজনই সুস্থ থাকতে পারে।
আপনার হাইপারথাইরয়েডিজম অথবা হাইপোথাইরয়েডিজম থাকলে গর্ভকালীন বিশেষ পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন হয়। এজন্য আপনাকে গাইনী বিভাগের বিশেষজ্ঞ ইউনিটের তত্ত্বাবধানে থাকার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে। হাসপাতালে এই ইউনিটটি ‘ফিটো-ম্যাটারনাল মেডিসিন ইউনিট’ নামে পরিচিত। এ ছাড়া আপনাকে হরমোন বিশেষজ্ঞের কাছেও রেফার করা হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড পরীক্ষার প্রক্রিয়া
কোথায় করা হয়
প্রায় সব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে থাইরয়েডের জন্য TSH পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। তবে কিছু হাসপাতালে মানসম্মতভাবে এই পরীক্ষা করার ব্যবস্থা না-ও থাকতে পারে। অনেক সময় সরকারি হাসপাতালে TSH পরীক্ষা করার জন্য আপনাকে নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগে যেতে হতে পারে। এই বিভাগটি স্থানভেদে ‘পরমাণু বিভাগ’ বা ‘আণবিক শক্তি বিভাগ’ নামেও পরিচিত।
থাইরয়েড পরীক্ষার প্রস্তুতি
TSH পরীক্ষা একটি রক্ত পরীক্ষা। এর জন্য আলাদা তেমন কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না। তবে নিচের বিষয়গুলো মাথায় রাখবেন—
- প্রথম গর্ভকালীন চেকআপে আপনাকে অনেকগুলো পরীক্ষা করতে দেওয়া হবে। এর মধ্যে কিছু পরীক্ষার (যেমন: ওজিটিটি ও প্রস্রাব পরীক্ষা) জন্য বিশেষ প্রস্তুতির দরকার পরে। একই দিনে সব পরীক্ষা করতে গেলে সেসব পরীক্ষার প্রস্তুতির নিয়মাবলী মাথায় রাখবেন।
- পরীক্ষার সময়ে আপনি অসুস্থ থাকলে বা কোনো ইনফেকশনে আক্রান্ত থাকলে পরীক্ষার ফলাফল সঠিক না-ও আসতে পারে। তাই সুস্থ হওয়ার পরে পরীক্ষা করানোই শ্রেয়। এই ব্যাপারে ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিন।[১৫]
- যেহেতু সুঁই ফুটিয়ে রক্ত সংগ্রহ করা হবে, সেহেতু আপনার রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা থাকলে আগেই জানাবেন। এ ছাড়া অ্যাসপিরিন অথবা রক্ত পাতলা করার কোনো ওষুধ সেবন করলেও তা ডাক্তারকে আগেভাগে জানাবেন। কারণ রক্ত সংগ্রহের পর এই ওষুধগুলোর প্রভাবে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে। হার্টের সমস্যা, স্ট্রোক, প্রি-এক্লাম্পসিয়া, ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস—এরকম কিছু রোগে এই ওষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
- আপনি সম্প্রতি কনট্রাস্ট ডাই ইনজেকশন ব্যবহার করে এক্স-রে অথবা সিটি স্ক্যান করিয়ে থাকলে সেটাও ডাক্তারকে জানিয়ে রাখবেন। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, আয়োডিনযুক্ত ডাই ব্যবহার করলে তা কিছু ক্ষেত্রে থাইরয়েড পরীক্ষার ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে।
- রক্ত সংগ্রহের পর আপনার মাথা ঘোরানোর অথবা অস্বস্তি লাগার একটি আশংকা থাকে। তাই হাসপাতালে যাওয়ার সময় সাথে করে কাউকে নিয়ে যেতে পারেন।
- হাসপাতালে ভিড় থাকলে আপনার পরীক্ষার সিরিয়াল আসতে সময় লাগতে পারে। তাই সম্ভব হলে খাবার ও পানি সাথে নিয়ে যাবেন।
পরীক্ষার প্রক্রিয়া
এই পরীক্ষার জন্য সুঁই ফুটিয়ে রক্তের স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়। মূল প্রক্রিয়াটি হলো—
- রক্ত পরীক্ষায় সাধারণত হাতের শিরা থেকে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। প্রথমে আপনার হাতের ওপরের অংশে দড়ির মতো একটি টার্নিকেট শক্ত করে বাধা হবে। এর ফলে হাতের শিরাগুলো ফুলে স্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং সেখান থেকে সহজে ও সঠিকভাবে রক্ত সংগ্রহ করা যাবে।
- এবার হাতের যেই অংশে সুঁই ঢুকানো হবে, সেই অংশ অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া হবে। তারপর সিরিঞ্জের সাথে সংযুক্ত একটি সুঁই অথবা বাটারফ্লাই সুঁই ত্বকের ভেতর দিয়ে শিরায় ঢুকিয়ে রক্ত নেওয়া হবে। এসময়ে আপনি সামান্য খোঁচা অনুভব করতে পারেন, তবে খুব বেশি ব্যথা হওয়ার কথা না।
- রক্ত সংগ্রহ করা হয়ে গেলে টার্নিকেট খুলে দেওয়া হবে। এরপর এক টুকরা জীবাণুমুক্ত তুলা দিয়ে সুঁই ফুটানোর স্থানটি চেপে ধরে রাখতে হবে কয়েক মিনিট। তারপর এর ওপর একটি সার্জিক্যাল টেপ অথবা ব্যান্ডএইড বসিয়ে দেওয়া হবে।
থাইরয়েড পরীক্ষার ফলাফল
ফলাফল পেতে প্রতিষ্ঠানভেদে ২–৭ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। আপনার সুবিধার্থে অন্যান্য পরীক্ষার ফলাফলসহ একসাথে সব রিপোর্ট সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে পারেন। এজন্য পরীক্ষা শেষে কবে, কখন ও হাসপাতালের কোন অংশ থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে তা জেনে নিন।
থাইরয়েড পরীক্ষার খরচ
TSH পরীক্ষার জন্য প্রায় ৭০০ টাকা লাগে। যদি সাথে T4 পরীক্ষা করেন তাহলে আরও ৯০০ টাকার মতো লাগবে। কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানে এর চেয়ে কম খরচ পড়তে পারে। আবার বেসরকারি হাসপাতাল অথবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এই খরচ আরও বেশি হতে পারে।