গর্ভাবস্থায় অনেকেরই পায়ে পানি আসে অথবা মুখ ফুলে যায়। এগুলো সাধারণত গর্ভাবস্থার কমন সমস্যা এবং তেমন কোনো জটিলতা সৃষ্টি করে না। তবে পা ফুলে যাওয়া কখনো কখনো ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস নামক রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে।
এটি একটি মারাত্মক সমস্যা যা থেকে প্রাণঘাতী জটিলতা তৈরি হতে পারে। এই রোগের লক্ষণ দেখা দিলে সাথে সাথে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যেতে হবে।
ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস কী
ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস বা ডিভিটি হচ্ছে একটি মারাত্মক রোগ যেখানে আপনার রক্তনালীগুলোতে, বিশেষ করে পায়ের গভীর শিরাতে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। পা ছাড়াও পেলভিস বা শ্রোণিদেশ এবং হাতে ডিভিটি হতে পারে।
এটি গর্ভাবস্থায় খুব একটা কমন সমস্যা নয়। প্রতি হাজারে মাত্র ২–১ নারীর মধ্যে এই সমস্যাটি দেখা দেয়।[১] তবে গর্ভকালীন ও প্রসব পরবর্তী ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত অন্যদের তুলনায় মায়েদের ডিভিটি হওয়ার ঝুঁকি প্রায় পাঁচ গুণ বেশি থাকে।[১][২][৩]
গর্ভাবস্থায় কেন ডিভিটি বেশি হয়
গর্ভকালীন সময়ে নারীদেহে রক্ত সহজে জমাট বাঁধার প্রবণতা দেখা দেয়; যাতে পরবর্তীতে প্রসবকালীন সময়ে রক্তক্ষরণ কম হয়। আবার পেটে বাচ্চা বড় হওয়ার সাথে সাথে পেলভিস বা শ্রোণিদেশে চাপ বাড়তে থাকে, ফলে পায়ে রক্ত চলাচল কমে যায়।[৫]
এ ছাড়া এ সময়টায় তুলনামূলক বেশি বিশ্রামে থাকতে হয়। এসব কারণে গর্ভকালীন ও প্রসব পরবর্তী ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত নারীদের ডিভিটি এর ঝুঁকি বেশি থাকে।
ডিভিটি এর লক্ষণসমূহ
ডিভিটি এর লক্ষণগুলো সাধারণত যেকোনো এক পায়েই প্রকাশ পায়। তবে অনেকসময় দুই পায়েও লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেহেতু গর্ভাবস্থায় পা ফুলে যাওয়া অথবা পায়ে অস্বস্তি বোধ হওয়া বেশ কমন সমস্যা, তাই কোনটি সাধারণ পা ফোলা আর কোনটি ডিভিটি তা চিনতে পারা জরুরি।
ডিভিটি এর লক্ষণসমূহ হচ্ছে—[৬]
- এক পায়ে, বিশেষ করে গোড়ালি, পায়ের নিচের অর্ধেকের পেছনের অংশ বা উরু হঠাৎ ফুলে যাওয়া এবং ব্যথা করা
- হাঁটলে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকলে অনবরত ব্যথা করা
- আক্রান্ত স্থান গরম হয়ে থাকা
- চাপ দিলে ব্যথা পাওয়া
- আক্রান্ত স্থানের চামড়া লালচে হয়ে যাওয়া
এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে সাথে সাথে নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে। সাধারণত পায়ের আলট্রাসাউন্ড স্ক্যান পরীক্ষার মাধ্যমে ডিভিটি শনাক্ত করা হয়ে থাকে।
ডিভিটি এর ঝুঁকি কাদের বেশি
আপনার ডিভিটি হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি কি না তা যেভাবে বুঝতে পারবেন[৮]—
- যদি আপনার অথবা আপনার পরিবারের কারো এর আগে রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা হয়ে থাকে[৯]
- গর্ভধারণকালে আপনার বয়স ৩৫ এর বেশি হয়[১০]
- আপনার ওজন অনেক বেশি হয়[১১] (বিএমআই ৩০ বা তার বেশি হয়)
- যদি কিছুদিন আগেই আপনার কোনো মারাত্মক ইনফেকশন অথবা গুরুতর ইনজুরি বা জখম হয়ে থাকে
- আপনার থ্রম্বোফিলিয়া রোগ থাকে।[১২] কেননা এই রোগে সহজেই রক্ত জমাট বেঁধে যায়
- আপনার ডায়াবেটিস থাকে[১৩][১৪]
- আপনার গর্ভে যমজ সন্তান থাকে অথবা গর্ভকালীন ও প্রসবজনিত কোনো জটিলতা থাকে[১৫]
- গর্ভধারণ করার জন্য হরমোন জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করে ফার্টিলিটি চিকিৎসা নিয়ে থাকেন
- সিজারিয়ান অপারেশনের প্রয়োজন হয়[১৬]
- আপনার ধূমপানের অভ্যাস থেকে থাকে[১৭]
- আপনার পানিশূন্যতা থাকে[১৮]
- পায়ের শিরাগুলো যদি লাল হয়ে ফুলে যায় এবং মারাত্মক ব্যথা করে। এটিকে ভেরিকোজ ভেইন বলে
জার্নি বা সফর-জনিত ডিভিটি প্রতিরোধ
লম্বা সময় ধরে জার্নি করলে ডিভিটি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। জার্নিতে যে কাজগুলো করলে আপনার ডিভিটি এর ঝুঁকি কমতে পারে[১৯]—
- প্রচুর পানি পান করা
- ঢিলেঢালা ও আরামদায়ক পোশাক পরা
- সম্ভব হলে মাঝে মাঝে একটু হাঁটাচলা করা
- বসা অবস্থায় সাধারণ কিছু পায়ের ব্যায়াম করা। যেমন: কিছুক্ষণ পর পর গোড়ালি নাড়ানো
ডিভিটি থেকে হওয়া জটিলতা
ডিভিটি থেকে হওয়া একটি প্রাণনাশক জটিলতা হচ্ছে ‘পালমোনারি এম্বোলিজম’। এই রোগে জমাট বাঁধা রক্ত অথবা অন্য যেকোনো পদার্থ দ্বারা ফুসফুসের রক্তনালী বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ফুসফুসে রক্ত চলাচলে বাঁধা সৃষ্টি হয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই রোগের চিকিৎসা করতে হয়; তা না হলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।[২০]
যে লক্ষণগুলোর মাধ্যমে পালমোনারি এম্বোলিজম সন্দেহ করা যায়—[২১]
- হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলে
- হঠাৎ অনেক বেশি কাশি হতে থাকলে এবং কাশির সাথে রক্ত গেলে
- শ্বাস নেওয়ার সময় বুকের পাঁজরে ব্যথা অনুভব করলে
- বুকের যেকোনো এক পাশে কিংবা স্তনের নিচে তীক্ষ্ণ বা সূচালো ব্যথা হতে থাকলে
- বুকে জ্বালাপোড়া, কামড়ানো কিংবা বুক ভার হয়ে আসছে এমন মনে হলে
- শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত হয়ে গেলে
- পালস বা হার্টবিট বেড়ে গেলে
ডিভিটি এর চিকিৎসা
গর্ভাবস্থায় ডিভিটি শনাক্ত হলে ‘লো-মলিক্যুলার ওয়েট হেপারিন’ ইনজেকশন দেওয়া হয়ে থাকে।[২২] এটি আপনার জমাট বাঁধা রক্তপিণ্ডগুলোকে আর বড় হতে দেয় না। ফলে শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এটি রক্তে মিশে যায়।
প্লাসেন্টা বা অমরায় হেপারিন প্রবেশ করতে পারে না বিধায় মায়ের রক্তপ্রবাহ থেকে শিশুর শরীরে হেপারিন প্রবেশের কোনো সম্ভাবনা নেই।[২৩] তাই গর্ভাবস্থায় হেপারিন গর্ভের শিশুর কোনো ক্ষতি করে না।[২৪] হেপারিন নেওয়া অবস্থায় শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোও নিরাপদ।[২৫]
এই ইনজেকশন আপনার ভবিষ্যতে আবারও ডিভিটি ও পালমোনারি এম্বোলিজম হওয়ার ঝুঁকি কমায়। সাধারণত গর্ভাবস্থার বাকি সময়টুকু এবং প্রসবের পর ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত এই ইনজেকশন গ্রহণ করতে হয়।
প্রসব ব্যথা একবার শুরু হয়ে গেলে আর হেপারিন ইনজেকশন নেওয়া যাবে না। যদি সিজারিয়ান সেকশনের পরিকল্পনা করা থাকে তাহলে অপারেশনের ২ ঘন্টা আগে থেকেই হেপারিন ইনজেকশন নেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে।
ডিভিটি এর জন্য অবশ্যই হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। তবে এর পাশাপাশি নিজেকেও কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে—
- যতটুকু সম্ভব শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকতে হবে
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে
- সুষম খাবার খেতে হবে
এ ছাড়া কমপ্রেশন স্টকিং পরতে পারেন। এটি বিশেষ এক ধরনের মোজা যা পায়ের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখতে এবং পায়ের ফোলা কমাতে সাহায্য করে। আপনার নিকটস্থ ঔষধের দোকানে খুঁজলেই এই কমপ্রেশন স্টকিং পেয়ে যাবেন।তবে এই মোজা ব্যবহারের আগে অবশ্যই আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নিতে হবে। কারণ ডায়াবেটিস কিংবা রক্ত চলাচলের কোনো সমস্যা থাকলে সাধারণত কমপ্রেশন স্টকিং ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়।[২৬]