গর্ভবতী অবস্থায় পেটের ভেতরে শিশুর নড়াচড়া টের পাওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা। গর্ভের শিশুর নড়াচড়া থেকে শিশুর সুস্থতা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়। তবে এই নড়াচড়া একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হয়ে থাকে। তাই মোটা দাগে নড়াচড়ার পরিমাণ ও ধরন স্বাভাবিক না কি অস্বাভাবিক সেটি বলে দেওয়া কঠিন।
গর্ভের শিশুর নড়াচড়ার ধরনে কিছু বিশেষ পরিবর্তন আসলে সেটি বিপদের লক্ষণ হতে পারে। তাই মা ও গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে আনতে এই বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি।
গর্ভের শিশু নড়াচড়া করছে কি না যেভাবে বুঝবেন
গর্ভের শিশু নড়াচড়া করতে শুরু করলে পেটের ভেতরে হালকা ঝাঁকুনির মতো অনুভূতি হয়ে থাকে। আবার কখনো কখনো শিশু পেটের ভেতরে আলতোভাবে ঘুরছে বলে মনে হতে পারে।
গর্ভকাল বাড়ার সাথে সাথে গর্ভের শিশুও বাড়ন্ত উদ্যমে নড়াচড়া করতে থাকে। তখন পেটের ভেতরে লাথি কিংবা খানিকটা ঝাঁকুনির মতো অনুভূতি হতে পারে। পুরো গর্ভকাল জুড়ে গর্ভের শিশুর নড়াচড়ার মাত্রা ও ধরনে যে তারতম্য দেখা যায়, সেটিকে শিশুর ব্রেইন ও স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশের প্রতিফলন বলে ধরা হয়।
বিশেষ তথ্য
গর্ভবতী নারী নিজে সচল অবস্থায় থাকলে কিংবা কোনো কাজে ব্যস্ত থাকলে গর্ভের শিশুর নড়াচড়া টের না-ও পেতে পারেন।
মাস অনুযায়ী শিশুর নড়াচড়া
গর্ভধারণ থেকে ৪ মাসের গর্ভবতী
গর্ভাবস্থার প্রথম চার মাস, অর্থাৎ ১ম থেকে ১৬তম সপ্তাহের মধ্যে সাধারণত গর্ভবতী নারীরা শিশুর নড়াচড়া অনুভব করতে পারেন না। তবে ইতঃপূর্বে গর্ভধারণ করেছেন এবং সন্তান প্রসব করেছেন এমন নারীদের মধ্যে কেউ কেউ গর্ভাবস্থার ১৬তম সপ্তাহে শিশুর নড়াচড়া টের পেতে শুরু করেন।
৫ থেকে ৬ মাসের গর্ভবতী
সাধারণত গর্ভধারণের ৪ মাসের পরে, অর্থাৎ ১৬ সপ্তাহ–২৪তম সপ্তাহের মধ্যে গর্ভবতী নারীরা প্রথমবারের মতো শিশুর নড়াচড়া টের পেতে শুরু করেন। এর মধ্যে বেশিরভাগ নারীই গর্ভধারণের ১৮ সপ্তাহ–২০তম সপ্তাহে প্রথমবারের মতো এই নড়াচড়া অনুভব করেন। গর্ভকাল আগানোর সাথে সাথে পেটের ভেতরে শিশুর নড়াচড়াও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে।কেউ প্রথমবারের মতো গর্ভবতী হলে গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহ পার হওয়ার আগ পর্যন্ত গর্ভের শিশুর নড়াচড়া না-ও বুঝতে পারেন। এমনকি কারও কারও ক্ষেত্রে প্রথমবার নড়াচড়া বুঝতে গর্ভধারণের ২০তম সপ্তাহের পরেও আরও কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে যেতে পারে।[১]
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
গর্ভধারণের ২৪ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভের শিশুর কোনো ধরনের নড়াচড়া অনুভব না করলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
ডাক্তার গর্ভের শিশুর নড়াচড়া ও হার্টবিট বা হৃৎস্পন্দন পরীক্ষা করে দেখবেন। প্রয়োজনে তিনি পেটের আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিতে পারেন।
৭ থেকে ৮ মাসের গর্ভবতী
গর্ভাবস্থার ৭ম–৮ম মাসে, অর্থাৎ ২৪তম সপ্তাহ থেকে ৩২তম সপ্তাহে সময়ের সাথে গর্ভের শিশুর নড়াচড়াও বাড়তে থাকে। গর্ভধারণের ৩২তম সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভের শিশুর নড়াচড়া এভাবে বাড়তে থাকে।[২][৩] তা ছাড়া দিন-রাতের পরিবর্তনের সাথে সাথে গর্ভের শিশুর নড়াচড়ার ধরনেও ভিন্নতা আসে। গর্ভধারণের ২০তম সপ্তাহ থেকেই এই দিন-রাতের পরিবর্তন লক্ষ করা যেতে পারে।
গর্ভের শিশুকে সাধারণত বিকেলে ও সন্ধ্যায় সবচেয়ে বেশি নড়াচড়া করতে দেখা যায়।[৪]
আবার গর্ভের শিশু যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন শিশুর নড়াচড়া টের পাওয়া যায় না। এই সময়টুকুকে ‘স্লিপ সাইকেল’ বা ঘুম-চক্র বলা হয়। দিনে ও রাতে নিয়মিত বিরতিতে এই ঘুম-চক্র চলতে থাকে। একেকটি চক্র সাধারণত ২০–৪০ মিনিট স্থায়ী হয়।[৫] তবে গর্ভে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা শিশুর ঘুম-চক্র একটানা ৯০ মিনিটের বেশি সময় ধরে চলতে থাকার ঘটনা বিরল।[৬][৭]
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
গর্ভধারণের ২৮তম সপ্তাহের পর থেকে যদি গর্ভবতী নারীর গর্ভের শিশুর নড়াচড়া নিয়ে সন্দেহ হয়, তাহলে তাদেরকে পরবর্তী দুই ঘণ্টার জন্য বাম কাত হয়ে শুয়ে গর্ভের শিশুর নড়াচড়ার দিকে মনোযোগ দেওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে যদি কমপক্ষে ১০ বার শিশুর নড়াচড়া সুস্পষ্টভাবে বোঝা না যায়, তাহলে তাকে সাথে সাথে নিকটস্থ হাসপাতালে অথবা গাইনী ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
৯ থেকে ১০ মাসের গর্ভবতী
গর্ভকাল বাড়ার সাথে সাথে পেটের ভেতরে শিশুর নড়াচড়াও বাড়তে থাকে। গর্ভের ৩২তম সপ্তাহে এই নড়াচড়া সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে। এরপর থেকে প্রসবের আগ পর্যন্ত গর্ভের ভেতরে শিশুর নড়াচড়া স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে। তবে সময়ের সাথে নড়াচড়ার মাত্রা স্থিতিশীল থাকলেও নড়াচড়ার ধরনে পরিবর্তন আসে।[৮] প্রসব চলাকালীন সময়েও গর্ভের ভেতরে শিশুর নড়াচড়া চলতে থাকবে।
পড়ুন: সপ্তাহ অনুযায়ী গর্ভাবস্থা
বিশেষ দ্রষ্টব্য: কেউ কেউ বাড়িতে হৃৎস্পন্দন শোনার যন্ত্র (হোম ডপলার) দিয়ে নিজেরাই গর্ভের শিশুর হৃৎস্পন্দন পরীক্ষা করার চেষ্টা করেন। মনে রাখতে হবে, এই যন্ত্রটি গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্য সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে পারে না। হৃৎস্পন্দন শোনা গেলেও শিশু আসলেই সুস্থ আছে কি না সেই ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। তাই গর্ভের শিশুর শারীরিক অবস্থা সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
গর্ভাবস্থায় শিশুর নড়াচড়া খেয়াল করা কেন জরুরি?
গর্ভের শিশু কোনো কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে পেটের ভেতরে তার নড়াচড়া স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়। এ ছাড়া শিশুর নড়াচড়ার ধরনেও পরিবর্তন আসতে পারে। এই ধরনের পরিবর্তন গর্ভের শিশুর দেহে ইনফেকশন অথবা অন্য কোনো সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।
যত তাড়াতাড়ি এসব পরিবর্তন খেয়াল করা যায়, ততই ভালো। এতে গর্ভবতী মা ও গর্ভের শিশুকে দ্রুত সঠিক চিকিৎসা দেওয়া যাবে। ফলে গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে আনা এবং মৃত্যুঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হবে।
গর্ভের শিশুর নড়াচড়ায় নিচের ৩টি পরিবর্তনের কোনোটি দেখা দিলেই দেরি না করে গর্ভবতী নারীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে—
১. নড়াচড়া স্বাভাবিকের তুলনায় কমে গেলে
২. একেবারেই নড়াচড়া অনুভব করতে না পারলে
৩.নড়াচড়ার গতানুগতিক ধরনে কোনো পরিবর্তন আসলে
এসব ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভের শিশুর নড়াচড়া ও হৃৎস্পন্দন পরীক্ষা করা প্রয়োজন। তা নাহলে গর্ভের শিশুর জীবন বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
যদি গভীর রাতে এমন সমস্যা দেখা দেয়, তাহলেও সকালের জন্য অপেক্ষা না করে গর্ভবতী নারীকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
গর্ভাবস্থায় শিশুর নড়াচড়া বেড়ে গেলে করণীয়
গর্ভের শিশুর নড়াচড়া বেড়ে গিয়েছে বলে মনে হলেও সেটি নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তবে নড়াচড়ার স্বাভাবিক ধরনে পরিবর্তন আসলে সেটি শঙ্কার কারণ হতে পারে।
তাই শিশু কতবার নড়াচড়া করছে সেটি হিসাব করার চেয়ে প্রতিদিনের নড়াচড়ার ধরনটি সঠিকভাবে বুঝতে পারার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। এতে গর্ভের শিশুর স্বাভাবিক নড়াচড়ার ধরন সম্পর্কে মোটামুটি সঠিক ও নিশ্চিত একটি ধারণা তৈরি হবে। ফলে স্বাভাবিক ধরনে পরিবর্তন আসলে সেটি খেয়াল করা সহজ হবে।
শিশুর নড়াচড়ার ধরনে যেকোনো পরিবর্তন আসলে অবশ্যই ডাক্তার অথবা নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র (যেমন: কমিউনিটি ক্লিনিক, স্যাটেলাইট ক্লিনিক, সদর হাসপাতাল)—এর প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে চেকআপ করিয়ে নিতে হবে।
সাধারণ জিজ্ঞাসা
সাধারণত গর্ভধারণের ৪মাসের পরে—১৬তম সপ্তাহ থেকে ২৪ তম সপ্তাহের মধ্যে গর্ভবতী নারীরা প্রথমবারের মতো শিশুর নড়াচড়া অনুভব করতে শুরু করেন। প্রসবের সময় পর্যন্ত গর্ভের শিশুর এই নড়াচড়া অনুভব করা যায়।
তবে কেউ প্রথমবারের মতো গর্ভবতী হলে গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহ পার হওয়ার আগ পর্যন্ত গর্ভের শিশুর নড়াচড়া অনুভব না-ও করতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় প্রতিটি শিশু একে অপরের থেকে ভিন্ন আচরণ করে। গর্ভের শিশু সারাদিনে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক বার নড়াচড়া করবে—এমন কোনো কথা নেই। তাই গর্ভবতী মা প্রতিদিন কতবার নড়াচড়া অনুভব করেন সেই হিসাব রাখার প্রয়োজন নেই।[৯]
তবে শিশু পেটের ভেতরে যেভাবে নড়াচড়া করে সেই ধরন বা প্যাটার্ন বোঝার চেষ্টা করা জরুরি। যেমন, দিনের নির্দিষ্ট কোনো বেলায় নড়াচড়া বেড়ে অথবা কমে যায় কি না সেটি লক্ষ করা। এতে গর্ভের শিশুর স্বাভাবিক নড়াচড়ার ধরন সম্পর্কে মোটামুটি সঠিক ও নিশ্চিত একটি ধারণা তৈরি হবে। ফলে স্বাভাবিক ধরনে পরিবর্তন আসলে সেটি দ্রুত খেয়াল করে সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।
গর্ভবতী যত তাড়াতাড়ি গর্ভের শিশুর নড়াচড়া অনুভব করতে পারবেন, অন্যরা তত তাড়াতাড়ি বাইরে থেকে এটি বুঝতে পারবেন না। এক্ষেত্রে প্রথম কিছুদিন কেবল মা-ই গর্ভের শিশুর নড়াচড়া টের পাবেন। পরবর্তীতে অন্যরা মায়ের পেটের ওপর হাত রেখে গর্ভের শিশুর নড়াচড়া বা লাথি অনুভব করতে পারবে। বাইরে থেকে হাত দিয়ে নড়াচড়া বোঝার এই অনুভূতিও একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হবে।
শিশু গর্ভের ভেতরে বড় হতে হতে নড়াচড়া করতে থাকে। সাধারণত গর্ভাবস্থার শেষের দিকে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত গর্ভের ভেতরে শিশুর এমন ঘোরাঘুরি চলতে থাকে। তাই শিশু গর্ভকাল জুড়ে পেটের ভেতরে যেকোনো অবস্থানে, অর্থাৎ যেকোনো পাশেই থাকতে পারে।