গর্ভাবস্থায় হাত ঝিনঝিন করা

হাত ঝিনঝিন বা অসাড় হয়ে আসার সমস্যা বেশ কিছু ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

গর্ভাবস্থায় অর্ধেকের বেশি নারীর হাত ঝিনঝিন করছে বা অবশ হয়ে আসছে বলে মনে হয়ে থাকে।[১] বিশেষ করে হাত দিয়ে একটানা অনেকক্ষণ একই ধরনের কাজ করলে এমন অনুভূতি হয়। যেমন: লেখালেখি, টাইপ করা অথবা সেলাই করা। একে ডাক্তারি ভাষায় ‘কারপাল টানেল সিন্ড্রোম’ বলা হয়।

এক্ষেত্রে কোনো কাজ করার পর হাত, কবজি অথবা আঙুলে এমন ঝিনঝিন করার পাশাপাশি হালকা ব্যথা, জ্বালাপোড়া অথবা অবশ হয়ে আসার মতো সমস্যা হতে পারে। কিছু ঘরোয়া উপদেশ মেনে চলার মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

লক্ষণ

গর্ভাবস্থায় কার্পাল টানেল সিন্ড্রোমের নানান ধরনের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। সাধারণত রাতে ও ভোরবেলা লক্ষণগুলোর তীব্রতা বেড়ে যায়। হাতের আঙুল, হাত, কবজি, এমনকি কাঁধ পর্যন্ত এসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে—

  • হাত অসাড় হয়ে আসা
  • সুঁই ফুটানোর মতো খোঁচা খোঁচা অনুভূতি হওয়া
  • ব্যথা হওয়া—এক্ষেত্রে দপদপে, ভোঁতা, তীক্ষ্ণ বা ধারালো ব্যথা হতে পারে
  • হাত ফুলে যাওয়া
  • আঙুল গরম হয়ে হওয়া
  • হাত দিয়ে কোনো কিছু ধরতে কিংবা ধরে রাখতে কষ্ট হওয়া
  • হাতের, বিশেষ করে বৃদ্ধাঙ্গুলির কাজের দক্ষতা কমে যাওয়া। এক্ষেত্রে হাত দিয়ে বোতাম লাগানোর মতো সূক্ষ্ম কাজের ক্ষমতা কমে যেতে পারে

কখন হতে পারে?

সাধারণত গর্ভাবস্থায় হাতে ঝিনঝিন করার সমস্যাটা শেষ ত্রৈমাসিকেই বেশি দেখা দেয়।[২] তবে শরীরের ওজন বৃদ্ধি এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এর আগেও এমনটা হতে পারে৷

সাধারণত প্রসবের পর শরীর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করলে হাত ঝিনঝিন করার সমস্যাটাও কমতে থাকে।[৩] তবে এটি সম্পূর্ণভাবে চলে যেতে প্রসবের প্রায় ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে৷ যদি এরপরও সমস্যাটি থেকে যায় তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

হাত ঝিনঝিন করার কারণ

আমাদের হাতের অনেকগুলো নার্ভ বা স্নায়ুর মধ্যে একটি হলো ‘মিডিয়ান নার্ভ’। এটি হাতের বিভিন্ন অংশ ও বৃদ্ধাঙ্গুলির নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে। সেই সাথে হাত ও কব্জির অনেকখানি অংশের অনুভূতি বহনের কাজ করে।[৪] এই মিডিয়ান নার্ভ বগলের কাছ থেকে শুরু হয়। এরপরে নিচে নামতে নামতে কব্জিতে থাকা ‘কার্পাল টানেল’ নামক অংশের ভেতর দিয়ে ঢুকে হাতের আঙুলে গিয়ে শেষ হয়।

কোনো কারণে কব্জির কাছাকাছি অংশে এই নার্ভের ওপর চাপ পড়লে নার্ভের স্বাভাবিক কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়। একারণেই মূলত ‘কার্পাল টানেল সিন্ড্রোম’ বা হাত ঝিনঝিন করার সমস্যা দেখা দেয়।

হাত ঝিনঝিন করার কারণ
ছবি: মিডিয়ান নার্ভে চাপ পড়ার ফলে ‘কার্পাল টানেল সিন্ড্রোম’ সৃষ্টি হওয়া

কার্পাল টানেল সিন্ড্রোম যেকোনো এক কিংবা উভয় হাতে হতে পারে। এতে মৃদু থেকে তীব্র—যেকোনো মাত্রায় সমস্যা অনুভব হতে পারে। গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন কারণে মিডিয়ান নার্ভে চাপ পড়ে থাকে। যেমন—

  • গর্ভাবস্থায় হাতে পানি এসে হাত ফুলে যাওয়ার কারণে মিডিয়ান নার্ভের ওপর চাপ পড়ে৷[৫] ফলে হাত ঝিনঝিন ও ব্যথা করতে পারে।
  • গর্ভাবস্থায় বাড়তি ওজনের কারণে এমন হতে পারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, অতিরিক্ত ওজনের অধিকারীদের মধ্যে ‘কার্পাল টানেল সিন্ড্রোম হওয়ার প্রবণতা বেশি।[৬]
  • কব্জির ওপর ভার দিয়ে করা হয় এমন কোনো কাজ অনেকক্ষণ ধরে করতে থাকলে মিডিয়ান নার্ভের ওপর চাপ পড়তে পারে। বিশেষ করে কেউ যদি অফিসে অথবা বাসায় ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
  • ধূমপান ও মদপান করলে গর্ভাবস্থায় হাত ঝিনঝিন করার ঘটনা বেড়ে যেতে পারে। এগুলো হাতের স্বাভাবিক রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করার কারণে এমন হয় বলে ধারণা করা হয়।[৭]
  • এই সমস্যা সাধারণত রাতে ঘুমানোর সময়ে বেশি দেখা দেয়৷ কারণ শোয়ার পর শরীরের নিচের অংশের রক্ত পুরো শরীরে ছড়িয়ে যায়৷ ফলে বাড়তি রক্তের কারণে হাতের নার্ভগুলোর ওপর চাপ পড়ে।

হাত ঝিনঝিন করার চিকিৎসা

হাত ঝিনঝিন বা অসাড় হয়ে আসার সমস্যা সারিয়ে তুলতে বেশ কিছু ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করা যায়। যেমন—

১. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া: হাত ঝিনঝিন করলে হাত দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। হাত দুটোকে যথাসম্ভব বিশ্রাম দেওয়ার চেষ্টা করুন। একটা বালিশের ওপরে হাত রেখে হাতকে বিশ্রাম দিতে পারেন।

২. ব্যথার জায়গায় বরফ বা ঠান্ডা পানি ব্যবহার: একটু মোটা ধরনের একখণ্ড নরম সুতি কাপড়ে কয়েক টুকরো বরফ জড়িয়ে ব্যথার জায়গায় ধরে রাখলে আরাম পাবেন। ঠান্ডা পানিতে ১০ মিনিটের মতো হাতের কব্জি ডুবিয়ে রাখলেও ব্যথা কমে আসতে পারে। এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে এক মিনিট গরম পানির সেঁক, আরেক মিনিট ঠাণ্ডা পানির সেঁক—এভাবে ৫–৬ মিনিট ধরে সেঁক দিতে পারেন।

৩. বিশ্রামের সময় হাতের পজিশন ঠিক রাখা: কাজ করার সময়টুকু ছাড়া বাকি সময়ে হাত দুটোকে উঁচু করে বা ওপরে তুলে রাখতে পারেন। এতে হাত ফুলে থাকলে সেই ফোলা কমে আসবে। প্রয়োজনে হাতের নিচে বালিশ বা কুশন ব্যবহার করতে পারেন। যে হাতে ব্যথা হয়, সে হাতের ওপর কাত হয়ে শোয়া থেকে বিরত থাকুন। সেই সাথে হাত ঝিনঝিন করার সমস্যা এড়াতে ঘুমানোর সময়ে হাতের ওপর ভার দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। ঘুমানোর সময়ে হাত বিছানার বাইরে ঝুলিয়ে দিলে এবং কিছুটা ঝাঁকালে ব্যথা কমে আসতে পারে।

৪. হাতে ব্রেইস বা বেল্ট পরা: আপনার যদি হাতে অনেক বেশি ব্যথা হতে থাকে তাহলে ঘুমানোর সময়ে কবজিতে ব্রেইস বা বেল্ট পরতে পারেন। এটি ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে।[৮] এসব Wrist Brace নামে ফার্মেসিতে কিনতে পাওয়া যায়।

৫. কাজের সময়ে সঠিক দেহভঙ্গি মেনে চলা: অনেকক্ষণ ধরে ডেস্কে বসে (যেমন: কম্পিউটারে) কাজ করলে চেষ্টা করুন হাতের অবস্থান ঠিক রাখতে। টাইপ করার সময়ে খেয়াল করুন হাতের কবজি যেন সোজা থাকে এবং কনুই যেন হাতের চেয়ে কিছুটা উঁচুতে থাকে। এমনটা করলে হাতের রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক থাকবে, ফলে ব্যথা কমে আসতে পারে।[৯]

৬. হাতের রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা: হাতের রক্ত প্রবাহ ঠিক রাখতে হাত একই রকম ভঙ্গিতে রেখে অনেকক্ষণ ধরে করতে হয়—এমন কাজ যতটা সম্ভব কমিয়ে দিন। সারাদিনে কাজের ফাঁকে অথবা অবসরে দুই হাত স্ট্রেচিং অথবা হালকা ব্যায়াম করে নিতে পারেন।

৭. লবণ খাওয়া কমানো: গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত লবণ খেলে গায়ে পানি আসা বা হাত-পা ফুলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়৷ তাই এসময়ে যতটা সম্ভব লবণ কম খাওয়ার চেষ্টা করুন।

৮. বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার: অনেকে হাত ব্যথার জন্য আকুপাংচার জাতীয় থেরাপি নিয়ে সুফল পেয়ে থাকেন। তবে গর্ভাবস্থায় এ ধরনের কোনো থেরাপি নেওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

৯. ঔষধের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ: ওপরের ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করে হাত ঝিনঝিন না কমলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন করতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে, গর্ভাবস্থায় সব ধরনের ব্যথানাশক ঔষধ সেবন নিরাপদ নয়। তাই এসময়ে ঔষধ সেবনের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নেওয়া উচিত।

কার্পাল টানেল এক্সারসাইজ

কার্পাল টানেল সিন্ড্রোমের জন্য হাতের কিছু বিশেষ ব্যায়ামের পরামর্শ দেওয়া হয়। এগুলো খুবই সহজ, বাসায় বসে নিজে নিজেই কর‍তে পারবেন—

কবজির ব্যায়াম

হাতের কবজির ব্যায়াম
ছবি: কবজির ব্যায়াম
  • আপনার হাত প্রথম ছবির মতো করে টেবিলের ওপরে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে রাখুন, যেন হাতটা টেবিলের কিনারায় ঝুলে থাকে
  • এরপর দ্বিতীয় ছবির মতো করে হাত টেবিল থেকে না সরিয়ে আঙুলগুলোকে ওপরে ওঠান এবং কবজি ওপরের দিকে ভাঁজ করুন
  • এবার কবজি নিচের দিকে ভাঁজ করুন এবং আঙুলগুলো নিচে নামান
  • এভাবে মোট ১০ বার ওপর-নিচ করুন
  • এই ব্যায়ামে অভ্যস্ত হয়ে গেলে পরবর্তীতে আঙুলগুলো ওপরে তোলার সময়ে হাতের ওপরে হালকা কিছু রেখে প্র‍্যাকটিস করুন। যেমন: ছোটো একটি আপেল, মানিব্যাগ, ঔষধের বোতল অথবা একটি বালা

আঙুলের ব্যায়াম

আঙুলের ব্যায়াম
ছবি: আঙুলের ব্যায়াম
  • বাহুসহ পুরো হাতকে আরামদায়ক অবস্থানে রাখুন। হাতের পাতা দ্বিতীয় ছবির মতো ছড়িয়ে রাখুন
  • এরপর হাতের আঙুলগুলো প্রথম ছবির মতো মুষ্টিবদ্ধ করুন
  • এভাবে ১০ বার মুষ্টি বাঁধুন আর খুলুন
  • পরবর্তীতে হাতের ভেতরে নরম রাবারের বল নিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করার অভ্যাস করুন

বুড়ো আঙুলের ব্যায়াম

বুড়ো আঙুলের ব্যায়াম
ছবি: বুড়ো আঙুলের ব্যায়াম
  • হাতকে আরামদায়ক অবস্থানে রাখুন
  • এরপর ছবির মতো বুড়ো আঙুল দিয়ে এক এক করে হাতের প্রতিটি আঙুলে চাপ দিন

সাধারণ জিজ্ঞাসা

গর্ভাবস্থায় হাত অবশ হয়ে আসা কি প্রি-এক্লাম্পসিয়ার লক্ষণ হতে পারে?

প্রি-এক্লাম্পসিয়া গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ সংক্রান্ত একটি জটিলতা। এর একটি কমন লক্ষণ হলো হঠাৎ শরীরে পানি আসা বা ফুলে যাওয়া৷ এসময়ে হাতে পানি আসলে বা হাত ফুলে গেলে নার্ভের ওপর চাপ পড়ে হাত ঝিনঝিন বা অবশ হয়ে আসার অনুভূতি হতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় হাত ঝিনঝিন করা বা অবশ হয়ে আসা প্রি-এক্লাম্পসিয়ার একটি লক্ষণ হতে পারে।

উল্লেখ্য, কেবল হাত ঝিনঝিন করা বা অবশ হওয়া মানেই যে আপনার প্রি-এক্লাম্পসিয়া হয়েছে, এমনটা নয়৷ তবে গর্ভধারণের ২০তম সপ্তাহ অথবা তার পরে হঠাৎ করেই হাতে পানি এসে হাত ফুলে গেলে সেটি শঙ্কার কারণ। এমন ক্ষেত্রে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।