গর্ভাবস্থায় অনেক মায়েরই চোখে অস্পষ্ট বা ঝাপসা দেখার সমস্যা হয়। এ সমস্যাটি একদম প্রসব পর্যন্ত ভোগাতে পারে। গর্ভাবস্থার অন্যান্য সমস্যাগুলো নিয়ে মায়েদের কিছুটা ধারণা থাকে। কিন্তু চোখের এ সমস্যাটি নিয়ে অনেক মা-ই তেমন জানেন না।
আবার গর্ভাবস্থায় চোখে ঝাপসা দেখার সমস্যা প্রি-এক্লাম্পসিয়া ও মাতৃত্বকালীন ডায়াবেটিস এর মতো জটিলতার কারণেও হতে পারে। আগে থেকেই জেনে রাখলে গর্ভাবস্থায় এসব জটিলতা এড়িয়ে চলা যায়।
গর্ভাবস্থায় চোখে ঝাপসা দেখার কারণ
গর্ভাবস্থায় আপনার শরীরের পরিবর্তনের সাথে সাথে চোখেরও কিছু পরিবর্তন হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব পরিবর্তন স্বাভাবিক এবং প্রসবের পর পর আপনাআপনি সেরে যায়। গর্ভাবস্থায় যেসব সাধারণ কারণে মায়েরা চোখে ঝাপসা দেখতে পারেন সেগুলো হলো—
- হরমোনের পরিবর্তন: গর্ভাবস্থায় মায়েদের শরীরে বেশ কিছু হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এর মধ্যে প্রোজেস্টেরন হরমোনের প্রভাবে চোখের কর্নিয়ায় ফ্লুইড শিফট হতে পারে, অর্থাৎ কর্নিয়ার পেছনে থাকা তরল বেরিয়ে আসতে পারে। আর এই ফ্লুইড শিফটের কারণেই চোখে ঝাপসা দেখার সমস্যা দেখা দিতে পারে।[১] একই কারণে গর্ভাবস্থায় চোখের অভ্যন্তরীণ প্রেশার-ও স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কমে যেতে পারে।[২]
- চোখের পানির পরিমাণ কমে যাওয়া: আমাদের চোখে থাকা ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি থেকে চোখের পানি তৈরি হয়। গর্ভাবস্থায় এই গ্রন্থি থেকে চোখের পানি তৈরির হার কমে গেলে আপনার অস্বস্তি হতে পারে। চোখ শুকিয়েও যেতে পারে। এর ফলে আপনি চোখে ঝাপসা দেখতে পারেন।[৩]
- কর্নিয়া পুরু হয়ে যাওয়া: গর্ভাবস্থার শেষের দিকে হরমোনের কারণে শরীরে ফ্লুইড বা তরলের পরিমাণ বেড়ে যায়। চোখের কর্নিয়ায় অতিরিক্ত তরল জমে আপনার চোখের কর্নিয়া পুরু হয়ে যেতে পারে।[৪][৫] প্রায় ১৪ শতাংশ মায়ের এ সমস্যা হতে পারে।[৬] এ থেকে ঝাপসা দেখার সমস্যাও হয়ে থাকে।
- দৃষ্টি ক্ষেত্রের পরিবর্তন: আমাদের মস্তিষ্কের একটি গ্রন্থি হলো পিটুইটারি গ্রন্থি। গর্ভাবস্থায় এই গ্রন্থি আকারে বৃদ্ধি পায়।[৭] পিটুইটারি গ্রন্থির বৃদ্ধির ফলে আগে থেকে কারও পিটুইটারি অ্যাডেনোমা জাতীয় অক্ষতিকর টিউমার থাকলে সেটি এসময় আকারে আরও বাড়তে পারে। যার ফলে গর্ভবতী মায়েদের দৃষ্টির সীমা পরিবর্তিত হতে পারে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসতে পারে ও মাথাব্যথাসহ অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।[৮]
তাই গর্ভাবস্থায় কারও এ জাতীয় লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই ডাক্তার দেখিয়ে নিতে হবে। তবে এটি সাধারণত খুব বেশি দুশ্চিন্তার কারণ নয়। কারণ এ ধরণের টিউমার বা বৃদ্ধি সাধারণত প্রসবের পর নিজে থেকেই কমে আসে, ফলে প্রসবের পর সাধারণত দৃষ্টিশক্তি পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।[৯][১০]
কখন সম্ভাব্য জটিলতার লক্ষণ
গর্ভাবস্থায় আপনার উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ ব্লাড গ্লুকোজ থাকলে এবং এসবের পাশাপাশি চোখে ঝাপসা দেখার সমস্যা হলে সেটি গর্ভাবস্থার বিভিন্ন জটিলতা নির্দেশ করে। এসব ক্ষেত্রে যেকোনো পরিবর্তন নিয়েই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। গর্ভাবস্থায় দৃষ্টি ঝাপসা হওয়ার কারণ হতে পারে এমন দুটি জটিলতা হলো—
প্রি-এক্লাম্পসিয়া
প্রি-এক্লাম্পসিয়া একটি উচ্চ রক্তচাপ জনিত জটিলতা। এর একটি লক্ষণ হলো চোখে দেখতে সমস্যা হওয়া। যেমন: দৃষ্টি ঘোলা হয়ে যাওয়া বা চোখের সামনে আলোর ঝলকের মতো দেখতে পাওয়া।[১১]
আপনার চোখে ঝাপসা দেখার সাথে নিচের লক্ষণগুলো দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন[১২]—
- প্রচণ্ড মাথাব্যথা যা সাধারণ পেইনকিলার সেবনেও যায় না
- প্রচণ্ড বুক জ্বালাপোড়া যা এন্টাসিড খেলে সারে না
- পাঁজরের হাড়ের ঠিক নিচে তীব্র ব্যথা
- খুব খারাপ বা অসুস্থ অনুভব করা
- শরীরের বিভিন্ন জায়গা (যেমন: পায়ের পাতা, গোড়ালি, মুখ ও হাত) হঠাৎ পানি জমে ফুলে উঠতে থাকা
আপনার আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপ থাকলে আপনার প্রি-এক্লাম্পসিয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে। এক্ষেত্রে নিচের সহজ উপায়গুলো অবলম্বন করে প্রি-এক্লাম্পসিয়ার ঝুঁকি এড়িয়ে চলুন—
- গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গর্ভাবস্থায় নিরাপদ এমন ব্লাড প্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ সেবন করুন
- উচ্চ রক্তচাপ জনিত জটিলতা এড়িয়ে চলতে নিয়মিত চোখের পরীক্ষা করান
তবে প্রিএক্লাম্পসিয়ার কারণে বেশি জটিল অবস্থার সৃষ্টি হলে, এসময় চিকিৎসক আপনার প্রসবের সূত্রপাত করাতে পারেন অথবা প্রয়োজনে সরাসরি সিজারিয়ান সেকশন করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
মাতৃত্বকালীন ডায়াবেটিস
মাতৃত্বকালীন ডায়াবেটিস গর্ভাবস্থার একটি পরিচিত সমস্যা। মাতৃত্বকালীন ডায়াবেটিস থাকাকালীন চোখে ঝাপসা দেখার সমস্যা শরীরের গ্লুকোজ এর মাত্রা বেড়ে গেছে এমনটা নির্দেশ করে।
মাতৃত্বকালীন ডায়াবেটিস এর জটিলতা থেকে চোখের রেটিনার রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর ফলে চিরদিনের জন্য দৃষ্টি হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। তাই আপনার গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস থাকলে প্রতি ত্রৈমাসিকে চোখের রক্তনালী পরীক্ষা করান।
এর পাশাপাশি নিচের লক্ষণগুলোর দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখুন—
- তীব্রভাবে ঝাপসা দেখা
- ডাবল ভিশন বা যেকোনো কিছুকে দুটি করে দেখা
- সাময়িকভাবে দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলা[১৩]
আপনার গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস থাকলে নিচের পরামর্শগুলো মেনে চলার মাধ্যমে আপনি অনেকটা স্বস্তিতে থাকতে পারেন—
- প্রক্রিয়াজাত খাবার, অধিক চর্বি ও চিনিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন
- প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ সুষম খাবার খান
- নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করুন
- আপনার অতিরিক্ত গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসক আপনাকে ইনসুলিন দিলে, সেটি নিয়মিত নিন
অন্যান্য জটিলতা
আপনার যদি আগে থেকেই নিচের রোগগুলো থাকে, সেক্ষেত্রে চোখের ঝাপসা দেখার সমস্যা এ রোগগুলোর আরও খারাপ হয়ে যাওয়া বুঝায়—
- ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি[১৪]
- গ্রেভস ডিজিজ
- ইডিওপ্যাথিক ইন্ট্রাক্র্যানিয়াল হাইপারটেনশন
- মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস
- বিভিন্ন টিউমার। যেমন: পিটুইটারি এডেনোমা
- ইউভাইটিস[১৫]
তাই আগে থেকে এসব রোগ থাকলে এবং গর্ভাবস্থায় চোখে ঝাপসা দেখতে পেলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
চিকিৎসা
গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক কারণে চোখে ঝাপসা দেখার সমস্যার জন্য আপনার তেমন চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। তবে নিচের পরামর্শগুলো মেনে চললে আপনি চোখে ঝাপসা দেখার সমস্যা অনেকটা এড়িয়ে চলতে পারেন।
১. চোখকে বিশ্রাম দিন
আপনি সারাদিন কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে আপনার চোখের ক্লান্তি থেকে ঝাপসা দেখবেন। দীর্ঘ সময় ধরে স্ক্রিনে কাজ করলে চোখের বিরতি নিন। এক্ষেত্রে প্রতি ২০ মিনিট পর পর আপনার থেকে ২০ ফুট দূরে থাকা কোনো বস্তুর দিকে ২০ সেকেন্ড ধরে তাকিয়ে থাকুন। এ ছাড়াও স্ক্রিন গ্লাস, এন্টি গ্লেয়ার স্ক্রিন—এসব ব্যবহার করতে পারেন। স্ক্রিন চোখের লেভেল থেকে নিচে আর দুই ফিট দূরে রাখুন।
২. চোখের ড্রপ ব্যবহার করুন
আপনার চোখের পানি শুকিয়ে যাবার কারণে চোখে ঝাপসা দেখার সমস্যা হলে চিকিৎসক আপনাকে গর্ভাবস্থায় নিরাপদ এমন ড্রপ দিতে পারেন। আর্টিফিশিয়াল টিয়ার নামে পরিচিত এসব ড্রপ ব্যবহারের আগে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
৩. লেন্সের ব্যবহার এড়িয়ে চলুন
অনেক মা চোখের সমস্যার জন্য আগে থেকেই কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করতে পারেন। গর্ভাবস্থায় এসব কন্টাক্ট লেন্স চোখের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে। বিশেষ করে আপনার যদি চোখ শুকিয়ে যাওয়ার সমস্যা থাকে। গর্ভাবস্থায় কন্টাক্ট লেন্স এর ব্যবহার এড়িয়ে চলুন। লেন্স এর পরিবর্তে চশমা ব্যবহার করুন।
৪. চশমার পাওয়ার পরিবর্তন থেকে বিরত থাকুন
অনেক মা যারা আগে থেকেই চশমা পরেন, তাদের গর্ভাবস্থায় চশমার পাওয়ার এর পরিবর্তন হতে পারে। এসব পরিবর্তন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাময়িক। এক্ষেত্রে চশমার পাওয়ার পরিবর্তন থেকে বিরত থাকুন। গর্ভাবস্থায় শরীরের পরিবর্তনের কারণে হওয়া চোখে ঝাপসা দেখার সমস্যা প্রসবের পর থেকেই সেরে ওঠা শুরু করে।
যদি প্রসবের পরও দীর্ঘদিন আপনার সমস্যাটি থাকে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তবে চোখের যেকোনো পরিবর্তনের জন্য অন্তত ৬-৯ মাস অপেক্ষা করা উচিত। কেননা প্রসবের পর এসব সমস্যা সেরে উঠতে কিছুটা সময় লাগে।[১৬]
সাধারণ জিজ্ঞাসা
গর্ভাবস্থায় চোখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া, চোখে চুলকানি হওয়া কিংবা চশমা বা লেন্সের পাওয়ার পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার মতো চোখে ঝাপসা দেখাও স্বাভাবিক। তবে এর সাথে অন্য জটিলতার লক্ষণগুলো থাকবে না। গবেষণায় দেখা গেছে গর্ভাবস্থায় প্রায় ১৫ শতাংশ গর্ভবতী মায়েদেরই চোখের বিভিন্ন পরিবর্তন বা দেখার সমস্যা হতে পারে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই।[১৭]
গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিক থেকে সাধারণত চোখে ঝাপসা দেখার সমস্যা শুরু হতে পারে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মায়েরা আরও আগে থেকে এই সমস্যা লক্ষ করে থাকেন। গর্ভাবস্থার শেষে প্রসবের পরবর্তী ৬ সপ্তাহ পর্যন্তও এই সমস্যা আপনাকে ভোগাতে পারে।
গর্ভাবস্থায় তীব্র মাথাব্যথার সাথে চোখে ঝাপসা দেখা প্রি-এক্লাম্পসিয়ার লক্ষণ হতে পারে। যেটি আপনার ও আপনার গর্ভের শিশু উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক।[১৮] এসময় দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। তবে অনেকসময় মাইগ্রেন এর কারণেও মাথা ব্যথার সাথে চোখে ঝাপসা দেখার সমস্যা হতে পারে।