ঘুমন্ত অবস্থায় যদি আপনার শ্বাস নেওয়ার রাস্তা কোনো কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়, তাহলে নাক ডাকার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় অনেকেরই নাক ডাকার সমস্যা দেখা দেয়।[১] গর্ভধারণের আগে থেকে নাক ডাকার অভ্যাস থাকলে এসময়ে সেটি বেড়েও যেতে পারে।
নাক ডাকা ঘুমের মধ্যে অস্বস্তির কারণ হতে পারে, আবার কখনো কখনো গুরুতর কোনো সমস্যার লক্ষণও হতে পারে। এ বিষয়ে জানাশোনা থাকলে আপনার গর্ভাবস্থা আরও সহজ ও সুন্দর হয়ে উঠবে। এই আর্টিকেলে গর্ভাবস্থায় নাক ডাকা, এর চিকিৎসা, জটিলতা ও প্রতিকার তুলে ধরা হয়েছে।
কখন দেখা দেয়?
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গর্ভাবস্থা যত এগোতে থাকে, নাক ডাকার সমস্যাও তত বাড়তে থাকে।[২] বিশেষ করে গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের শেষে ও তৃতীয় ত্রৈমাসিক জুড়ে নাক ডাকা বেশ কমন।[৩]
কেন হয়?
গর্ভাবস্থায় শারীরিক বিভিন্ন পরিবর্তন হয়ে থাকে। এই পরিবর্তনগুলো গর্ভকালের জন্য স্বাভাবিক। তবে এসব পরিবর্তনের ফলে শরীরে কিছু লক্ষণ তৈরি হয়—অনেকটা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার মতো। ঘুমের মধ্যে নাক ডাকাও সেরকম একটি সমস্যা। গর্ভাবস্থায় নাক ডাকার কারণগুলো হলো—
১. গর্ভকালীন হরমোনের মাত্রা ওঠানামা করা: গর্ভাবস্থায় সন্তান ও গর্ভফুলের বিকাশকে সহায়তা করার জন্য শরীরের কিছু স্বাভাবিক হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। এই হরমোনগুলো নাক ও গলার ভেতরের আবরণের পুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের রাস্তা কিছুটা সরু হয়ে আসে। সেই সাথে নাক বন্ধ থাকা ও নাক দিয়ে পানি পড়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়। সব মিলিয়ে ঘুমের মধ্যে নাক ডাকা ও শ্বাস নিতে অসুবিধা হতে পারে।[৪]
২. ওজন বেড়ে যাওয়া: একজন স্বাভাবিক ওজনের নারীর জন্য গর্ভাবস্থায় ১১.৫–১৬ কেজি ওজন বাড়া কাম্য।[৫][৬] তবে ওজন যদি অতিরিক্ত বেড়ে যায়, তাহলে গলার আশেপাশে চর্বি জমে শ্বাসনালীতে চাপ পড়তে পারে।[৭] এই চাপের কারণে শ্বাসনালী সরু হয়ে এসে নাক ডাকার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৩. শরীরে রক্তের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া: গর্ভাবস্থায় আপনার শরীরে রক্তের পরিমাণ বেড়ে যায়।[৮][৯]। গর্ভে বেড়ে ওঠা সন্তানের বাড়তি চাহিদা মেটানোর জন্য এমন হয়ে থাকে। রক্তের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে নাকের আবরণের সরু রক্তনালীগুলো ফুলে ওঠে এবং শ্বাস নেওয়ার রাস্তাটি সরু হয়ে যায়। একারণে ঘুমের মধ্যে নাক ডাকা ও শ্বাস নিতে অসুবিধা হওয়ার মতো সমস্যা তৈরি হতে পারে।
৪. কম ঘুম হওয়া অথবা বারবার ঘুম ভেঙে যাওয়া: গর্ভাবস্থায় অনেক গর্ভবতী নারীর ঘুমে সমস্যা হতে পারে। কম ঘুম অথবা বারবার ঘুম ভাঙার ফলে গলার পেশিগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়তে পারে। যেহেতু এই পেশিগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের রাস্তা খোলা রাখার কাজ করে থাকে, তাই ক্লান্ত অবস্থায় শ্বাস নেওয়ার রাস্তা সরু হয়ে যেতে পারে।[১০] এভাবে নাক ডাকার সমস্যা তৈরি হতে পারে।
কাদের ঝুঁকি বেশি?
আপনার গর্ভাবস্থার সাথে কিছু বিষয় জড়িত থাকলে ঘুমে নাক ডাকার আশঙ্কা বেড়ে যায়[১১][১২]—
- গর্ভধারণের আগে ওবিসিটি বা স্থূলতা থেকে থাকলে গর্ভাবস্থায় নাক ডাকার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
- বয়স বাড়ার সাথে গর্ভাবস্থায় নাক ডাকার সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
- গর্ভধারণের আগে থেকে নাক ডাকার সমস্যা থাকলে গর্ভাবস্থায় তা বেড়ে যেতে পারে। গর্ভাবস্থায় ঘুমের সমস্যা হলে এমন হওয়ার আশঙ্কা আরও বেশি থাকে।
- চিত হয়ে ঘুমালে গর্ভাবস্থায় নাক ডাকার সমস্যা বেড়ে যেতে পারে।[১৩]
- ধূমপান শ্বাসতন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টির মাধ্যমে নাক ডাকার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।
- উচ্চ রক্তচাপ থাকলে সাধারণত নাক ডাকার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- যদি মুখে অথবা গলায় এমন কোনো রোগ হয়ে থাকে, যা শ্বাস-প্রশ্বাসে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে গর্ভাবস্থায় নাক ডাকার সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন: টনসিল ফোলা, স্বাভাবিকের চেয়ে বড় আকারের জিহ্বা, স্বাভাবিকের চেয়ে ছোটো চোয়াল বা থুতনি। হয়তো স্বল্প পরিসরে এসব সমস্যা শ্বাসতন্ত্রে কোনো অসুবিধা তৈরি করে না, তবে গর্ভাবস্থার অন্যান্য বিষয়ের সাথে মিলে গিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
নাক ডাকা কি বিপদজনক হতে পারে?
ঘুমের ঘোরে নাক ডাকা গর্ভাবস্থার একটি অতি পরিচিত লক্ষণ। এটি সাধারণত বিপদজনক নয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নাক ডাকার সাথে গর্ভকালীন জটিলতার সম্পর্ক থাকতে পারে।
যেমন, ‘অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া’ নামের একটা রোগে ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের রাস্তা বন্ধ হয়ে আসে। ফলে নাক ডাকার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ঘুমানোর সময় এই রোগের পাশাপাশি শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত যত সমস্যা দেখা দেয়, তাদের একত্রে ‘স্লিপ ডিসঅর্ডারড ব্রিদিং’ বলা হয়। এগুলো ঘুমের সমস্যা সৃষ্টির মাধ্যমে আপনার ও হরভের শিশুর ক্ষতি করতে পারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ‘স্লিপ ডিসঅর্ডারড ব্রিদিং’ কিছু জটিলতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। যেমন[১৪]—
- গর্ভকালীন ডায়াবেটিস
- উচ্চ রক্তচাপ
- প্রি-এক্লাম্পসিয়া
- গর্ভের সন্তানের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়া
- ডিপ্রেশন
ঘুমের মধ্যে নাক ডাকা সরাসরি বিপদজনক না হলেও সেটা এসব জটিলতার পূর্ব লক্ষণ হতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় ‘স্লিপ ডিসঅর্ডারড ব্রিদিং’ চেনার উপায় সম্পর্কে সচেতন থাকবেন এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।
স্লিপ ডিসঅর্ডারড ব্রিদিং চেনার উপায়
‘স্লিপ ডিসঅর্ডারড ব্রিদিং’ নিজে নিজে বুঝতে পারা কষ্টকর হতে পারে। ঘুমন্ত অবস্থায় আপনাকে পর্যবেক্ষণ করতে পারে এমন কেউ, অর্থাৎ আপনার সঙ্গী হয়তো প্রথমে এর লক্ষণগুলো খেয়াল করবেন[১৫]—
- ঘুমের ঘোরে নাক ডাকা
- ঘুমন্ত অবস্থায় কয়েক মুহূর্তের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাস আটকে যাওয়া। এর ফলে নাক দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার শব্দ বা নাক ঝাড়ার মত শব্দ হতে পারে
- ঘুমের ঘোরে অস্বাভাবিক শব্দ করা
- বার বার ঘুম ভাঙা
- দিনের বেলা অতিরিক্ত ঘুম ঘুম ভাব ও ক্লান্তি
এ ছাড়া আরও কিছু লক্ষণ রয়েছে যা কখনো কখনো ‘স্লিপ ডিসঅর্ডারড ব্রিদিং’ এ দেখা দিতে পারে। যেমন: বিরক্তি, হতাশা, কাজে মনোযোগ হারানো, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, গলা ব্যথা, ঘুম থেকে উঠার পর মাথা ব্যথা, কাশি, খাবার গিলতে কষ্ট হওয়া ও রাতে বুক জ্বালাপোড়া করা।[১৬]
এই লক্ষণগুলো সঙ্গীর সাথে আলোচনা করলে তিনি আপনাকে জানাতে পারবেন যে ঘুমের মধ্যে আপনার এমন কোনো লক্ষণ দেখা দেয় কি না। এ ছাড়া অস্বাভাবিক শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি ভিডিও করেও রাখতে পারবেন। এই ভিডিও রোগ ধরতে ডাক্তারকে অনেক সাহায্য করতে পারে।
গর্ভাবস্থায় নাক ডাকার চিকিৎসা
ঘরোয়া চিকিৎসা
কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করে নাক ডাকার সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। যেমন—
১. স্যালাইন স্প্রে অথবা স্ট্রিপ ব্যবহার করুন: নাক বন্ধ থাকলে নাক ডাকার সমস্যা হতে পারে। নাক পরিষ্কার রাখতে নাকে স্যালাইন স্প্রে ব্যবহার করতে পারেন। এতে নাকের ভেতরের অংশ ও আবরণ ভালোভাবে পরিষ্কার করে নেওয়া যায়, ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস সহজ হয়।
এ ছাড়া নাক ডাকা কমানোর জন্য ফার্মেসিতে ও অনলাইনে কিছু ‘ন্যাসাল স্ট্রিপ’ পাওয়া যায়। এটি ব্যান্ড-এইডের মতো পাতলা হয়। নাকের হাড়ের ওপর স্ট্রিপটি পরা হয়। এটি নাকের ভেতরের রাস্তা প্রশস্ত রাখতে সাহায্য করে।
২. কাত হয়ে ঘুমান: চিত হয়ে ঘুমালে শ্বাস নিতে অসুবিধা হতে পারে ও নাক ডাকার সমস্যা বাড়তে পারে। আবার গর্ভের আকার বড় হতে থাকলে সোজা হয়ে ঘুমাতে অস্বস্তি হতে পারে। এক পাশে কাত হয়ে ঘুমালে কিছুটা স্বস্তি পেতে পারেন।
তা ছাড়া, গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসের পর থেকে চিৎ হয়ে শোয়ার ফলে জরায়ুতে রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হতে পারে, ফলে আপনার মাথা ঘুরাতে পারে—এমনকি শিশুর শরীরে রক্ত প্রবাহ কমে গিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এজন্য এসময়ে একপাশ হয়ে, অর্থাৎ ডান অথবা বাম দিকে কাত হয়ে ঘুমালে সেটি সবচেয়ে ভালো।[১৭]
৩. মাথা উঁচু করে ঘুমান: বিছানার যেদিকে আপনি মাথা দিয়ে শুয়ে থাকেন, সেই দিকটি কিছুটা উঁচু করতে পারেন। এটি শ্বাস নেওয়ার রাস্তা খোলা রাখতে সহায়তা করবে। এজন্য খাটের পায়ার নিচে ইট বা কাঠের টুকরা দিতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় সঠিক ও আরামদায়ক ঘুমের জন্য পড়ুন: গর্ভাবস্থায় অনিদ্রা ও ঘুমের সমস্যা।
৪. ক্যাফেইন, ধূমপান ও মদপান এড়িয়ে চলুন: বিভিন্ন গবেষণায় ধূমপানের সাথে নাক ডাকার সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গিয়েছে।[১৮] ধূমপানের ধোঁয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের রাস্তায় প্রদাহ তৈরি করতে পারে। এ ছাড়া ক্যাফেইন, বিশেষ করে ক্যাফেইনযুক্ত কোমল পানীয়ের সাথে ‘স্লিপ ডিসঅর্ডারড ব্রিদিং’ এর সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছে।[১৯] ক্যাফেইন, ধুমপান ও মদপান—এগুলোর সবই ঘুমের সমস্যা করতে পারে, সাথে আপনার ও গর্ভের শিশুর নানাবিধ ক্ষতি করতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় এগুলো পুরোপুরি এড়িয়ে চলুন।
৫. সচেতনভাবে খাওয়া দাওয়া করুন: ঘুমাতে যাওয়ার আগের ২–৩ ঘণ্টার মধ্যে ভারী খাবার বা মসলাযুক্ত খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলুন। এতে বুক জ্বালাপোড়ার সম্ভাবনা কমে, ভালো ঘুমের সম্ভাবনা বাড়ে। এ ছাড়া বাড়তি ওজন ও এর জটিলতা নাক ডাকার সমস্যা ঘটাতে পারে।[২০] তাই খাবারের ব্যাপারে সচেতন থাকুন এবং প্রয়োজনের বেশি খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলুন।
গর্ভাবস্থার জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জানতে পডুন: গর্ভবতী মায়ের খাদ্য তালিকা।
৬. হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করতে পারেন: বাতাস শুষ্ক থাকলে তা নাকে শুষ্কতা তৈরি করতে পারে। হিউমিডিফায়ার এমন একটি যন্ত্র যা ব্যবহার করে রুমের বাতাস আর্দ্র রাখা যায়। এভাবে এটা শ্বাস নেওয়া সহজ করে তুলতে পারে। এটি বড় বড় ইলেক্ট্রনিক্স-এর দোকানে কিনতে পাওয়া যায়।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন
নাক ডাকার সমস্যা অনেক বেড়ে গেলে কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসে কোনো সমস্যা হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। এ ছাড়া আপনার অথবা আপনার সঙ্গীর যদি মনে হয় যে আপনার ‘স্লিপ ডিসঅর্ডারড ব্রিদিং’ এর সমস্যা থাকতে পারে, তাহলেও সময়মতো ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।