কেবল চারটি পদক্ষেপের সাহায্যে ডায়াবেটিস নিয়েও একটি সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন যাপন করা সম্ভব। পদক্ষেপগুলো মেনে চলার মাধ্যমে আপনি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন স্বাস্থ্য জটিলতা এড়িয়ে চলতে পারবেন।
প্রথম পদক্ষেপ: ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানুন
ডায়াবেটিস নিয়েও কীভাবে সুস্থ থাকা যায় সেই সম্পর্কে ধারনা থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য কিছু বিষয় জেনে রাখতে হবে। যেমন—
- জীবনধারায় কী ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে
- কী ধরনের খাবার খেতে হবে
- ডায়াবেটিসের ঔষধ কীভাবে খেতে হবে
- ইনসুলিন কীভাবে নিতে হবে
- ঘরে বসে কীভাবে রক্তের সুগার পরিমাপ করতে হবে
- কখন রক্তের সুগার পরিমাপ করতে হবে
- কখন হাসপাতালে যেতে হবে
- রোগীর নিজস্ব জীবনধারায় এসব পরিবর্তন আনার সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলো কী
এই বিষয়গুলো সম্পর্কে ডাক্তার আপনাকে সবচেয়ে ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন। তাই তাঁর সাথে আলোচনা করে এসব ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নিন।
এছাড়া ডায়াবেটিস নিয়ে সহায় এর আর্টিকেলগুলো পড়তে পারেন।
দ্বিতীয় পদক্ষেপ: ডায়াবেটিসের ABCs সম্পর্কে জানুন
ডায়াবেটিসের এবিসিস (ABCs) কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে সে ব্যাপারে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। A-B-C-s দিয়ে যা বোঝানো হচ্ছে তা হলো—
- A: HbA1C, সংক্ষেপে A1C (এ ওয়ান সি) পরীক্ষা
- B: Blood Pressure বা রক্তচাপ
- C: Cholesterol অর্থাৎ রক্তে চর্বির পরিমাণ
- s: Smoking বা ধূমপান, অর্থাৎ ধূমপান ত্যাগ করার উপায়
এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাক ও ব্রেইন স্ট্রোকসহ ডায়াবেটিসের অন্যান্য জটিলতার ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
A: এ ওয়ান সি পরীক্ষা
A1C পরীক্ষা বা HbA1C পরীক্ষা এক ধরনের রক্ত পরীক্ষা। এই পরীক্ষার মাধ্যমে বিগত ৩ মাসে রক্তের সুগারের গড় মাত্রা কেমন ছিল তা পরিমাপ করা হয়। সাধারণ গ্লুকোমিটারের সাহায্যে রক্তের সুগার পরিমাপের যে পরীক্ষা করা হয়, তা থেকে এই পরীক্ষাটি ভিন্ন।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অনেক রোগীর A1C এর লক্ষ্যমাত্রা সাধারণত ৬.৫% এর কম হয়ে থাকে। তবে এই লক্ষ্যমাত্রা একেক জনের জন্য একেক রকম। আপনার জন্য সঠিক লক্ষ্যমাত্রা কত হওয়া উচিত সেই ব্যাপারে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
B: ব্লাড প্রেসার বা রক্তচাপ
রক্তনালীর ভেতর দিয়ে রক্ত চলাচলের সময়ে তা রক্তনালীর দেয়ালে যে বল প্রয়োগ করে সেটি হলো রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেসার।
রক্তচাপ অনেক বেড়ে গেলে হার্টকে রক্ত সঞ্চালনের জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। এর ফলে হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোক, কিডনি রোগ ও চোখের ক্ষতি হতে পারে।
রক্তচাপের লক্ষ্যমাত্রা সাধারণত ১৪০/৯০ এর নিচে থাকা উচিত। কিন্তু আপনার ডাক্তার ভিন্ন কোনো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিলে সেটিই অনুসরণ করতে হবে।
C: কোলেস্টেরলের পরিমাণ
রক্তে দুই ধরনের কোলেস্টেরল থাকে—LDL ও HDL। এর মধ্যে LDL কে ‘ক্ষতিকর’ কোলেস্টেরল বলা হয়। কারণ এটি রক্তনালীর ভেতরে জমা হয়ে রক্ত চলাচলে বাধা দেয়। অন্যদিকে HDL কে বলা হয় ‘ভালো’ কোলেস্টেরল। কারণ এটি ‘ক্ষতিকর’ কোলেস্টেরলকে রক্ত থেকে সরিয়ে ফেলতে সাহায্য করে।
তাই কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত ‘ফাস্টিং লিপিড প্রোফাইল’ নামক রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে।
কোলেস্টেরলের লক্ষ্যমাত্রা একেক জনের জন্য একেক রকম হতে পারে। আপনার জন্য সঠিক লক্ষ্যমাত্রা কত হওয়া উচিত সেটি ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নিন। লক্ষ্যমাত্রায় না থাকলে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
s: স্মোকিং বা ধূমপান
ধূমপান করলে রক্তে সুগারের মাত্রা, রক্তচাপ ও রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা—সবই বেড়ে যায়। তাই ধূমপান ত্যাগ করার মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোক, নার্ভ বা স্নায়ুর সমস্যা, কিডনির সমস্যা ও ডায়াবেটিসের অন্যান্য জটিলতার ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব।
ডায়াবেটিসকে গুরুত্ব দিন
কেউ কেউ বলেন যে তাদের “হালকা ডায়াবেটিস আছে” বা তাদের “সুগার সামান্য বেশি”। এ ধরনের বক্তব্য থেকে মনে হতে পারে যে ডায়াবেটিস কোনো গুরুতর রোগ নয়। এটি একেবারেই সঠিক নয়।
ডায়াবেটিস গুরুতর একটি রোগ, তবে সঠিক পদক্ষেপ অনুসরণ করার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। শুরুতে কঠিন মনে হলেও সময়ের সাথে প্রক্রিয়াটি সাধারণত সহজ হয়ে আসে। সুস্থ জীবন ও দীর্ঘায়ুর জন্য ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে—
১. স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকা মেনে চলতে হবে
২. সুস্থ ওজন বজায় রাখতে হবে
৩. শারীরিক পরিশ্রমের পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং
৪. সুস্থ বোধ করলেও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ সেবন বন্ধ করা যাবে না
তৃতীয় পদক্ষেপ: ডায়াবেটিস নিয়ে সুস্থভাবে বাঁচতে শিখুন
ডায়াবেটিসের সাথে মানিয়ে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করা হয়তো অনেকের কাছে কঠিন—হয়তো অসাধ্যও মনে হতে পারে। এ নিয়ে খারাপ অনুভব করা অস্বাভাবিক নয়।
তবে ডায়াবেটিসের কারণে আপনি মানসিক চাপে ভুগলে সেটি রক্তের সুগার আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।
মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন
মানসিক চাপ থাকলে সেটি মোকাবেলা করতে হবে। চাপমুক্ত হওয়ার উপায়গুলোর মধ্যে রয়েছে—
- মনোযোগ সহকারে গভীরভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া
- বাগান করা
- হাঁটা। যেমন: বাড়ির ছাদে বা পার্কে
- ধ্যান বা মেডিটেশন করা
- ইয়োগা বা যোগব্যায়াম করা
- শখের কাজকর্ম করা বা পছন্দের গান শোনা
- পরিবার বা বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো
যদি মনমরা লাগে তাহলে সাহায্য চাইতে সংকোচ বোধ করবেন না। আপনার অনুভূতি অন্যদের জানানোর মাধ্যমে আপনি ভালো বোধ করতে পারেন। তাই আপনার উদ্বেগের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবেন এমন পরিবারের সদস্য, বন্ধু বা আত্মীয়ের সাথে কথা বলতে পারেন। প্রয়োজনে ডাক্তারের এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
যদি দিনের বেশিরভাগ সময় বা সপ্তাহের বেশিরভাগ দিনই মন খারাপ থাকে তাহলে সেটি ডিপ্রেশনের লক্ষণ হতে পারে। এমন ক্ষেত্রে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
স্বাস্থ্যকর খাবার খান
- ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে একটি স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকা তৈরি করে নিন। ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি আপনাকে ডায়েট চার্ট দিয়ে দিতে পারেন কিংবা পুষ্টিবিদের কাছে রেফার করতে পারেন। পুষ্টিবিদ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবারের তালিকা তৈরি করতে সাহায্য করতে পারবেন।
- ঘরে তৈরি করা স্বাস্থ্যকর খাবার খান। প্রতি সপ্তাহে আপনি কী খাবেন তা সপ্তাহের শুরুতেই পরিকল্পনা করে ফেলুন। বাইরে যাওয়ার সময়ে স্বাস্থ্যকর নাস্তা বা স্ন্যাকস সাথে নিন। যেমন: আপেল, গাজর ও শসা।
- লেবেল দেখে খাবারের পুষ্টি গুনাগুণ বোঝার চেষ্টা করুন। খাবারের মোড়কে সাধারণত সেটির পুষ্টি গুণাগুণ সংক্রান্ত তথ্য দেওয়া থাকে। এতে বাইরে খাওয়ার সময় আপনি স্বাস্থ্যকর খাবার বেছে নিতে পারবেন।
শরীর সচল রাখুন
- দিনে অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করার চেষ্টা করুন। প্রতিদিন ১০ মিনিট করে ৩ বার হাঁটা—এভাবে শুরু করতে পারেন। ধীরে ধীরে শরীরচর্চার পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা করুন।
- সপ্তাহের যেকোনো দুই দিন মাংসপেশির শক্তি বাড়ানোর ব্যায়াম বা ‘স্ট্রেংথ ট্রেনিং’ করার চেষ্টা করুন। এর মধ্যে রয়েছে ভারোত্তোলন, পুশ-আপ ও পুল-আপ। এছাড়া স্ট্রেচ ব্যান্ড ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যায়াম করতে পারেন। অথবা ইয়োগা বা যোগব্যায়াম করতে পারেন।
ইউটিউব দেখে সহজেই এ ধরনের ব্যায়াম শিখে নিতে পারেন। নিচের শব্দগুলো ব্যবহার করে এ ধরনের ব্যায়ামের ভিডিও খুঁজে পাওয়া যাবে —
- Push up
- Pull up
- Yoga
প্রতিদিনের রুটিন ঠিক করে নিন
- প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঔষধ খান। সুস্থ বোধ করলেও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ সেবন বন্ধ করবেন না। ডাক্তার আপনাকে যে ঔষধ সেবনের পরামর্শ দিয়েছেন তা কেনার সামর্থ্য না থাকলে অথবা কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে তা ডাক্তারকে জানান।
- নিয়মিত পায়ের যত্ন নিন। পায়ে কোনো কাটাছেঁড়া, ক্ষত, ফোস্কা, ফুলে যাওয়া অথবা লাল হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হচ্ছে কি না তা প্রতিদিন লক্ষ করুন। এ ধরনের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে ডাক্তারের কাছে যান।
- দাঁত ও মাড়ি ভালো রাখার জন্য প্রতিদিন সকালে ও রাতে খাবার পর ব্রাশ করুন।
- রক্তের সুগার কতদিন পর পর অথবা দিনে কতবার মাপতে হবে তা ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নিন।
- নিয়মিত রক্তের সুগার পরিমাপ করুন। সুগারের হিসাব একটি নির্দিষ্ট খাতায় বা ডায়েরিতে লিখে রাখুন।
- ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রক্তচাপ পরিমাপ করুন। রক্তচাপের হিসাব একটি নির্দিষ্ট খাতায় লিখে রাখুন।
- ধূমপান করা থেকে বিরত থাকুন।
এছাড়া ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নিউমোনিয়া এবং হেপাটাইটিস বি এর টিকা নিতে পারেন।
চতুর্থ পদক্ষেপ: নিয়মিত ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে থাকুন
ডায়াবেটিসের রোগীদের বছরে কমপক্ষে দুইবার ডাক্তার দেখানো উচিত। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ও জটিলতার ঝুঁকি কমানোর জন্য এই চেকআপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দ্রুত শনাক্ত করে আগেভাগে চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া যায়।
ডায়াবেটিসের গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষাগুলো সম্পর্কে আমাদের আর্টিকেল থেকে বিস্তারিত জেনে নিন।