ইনসুলিন দেওয়ার নিয়ম

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অনেক রোগীকেই রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ইনসুলিন নিতে হয়। কিন্তু সঠিক পদ্ধতি জানা না থাকার কারণে অনেকে শরীরের ভুল স্থানে ভুল ডোজে ইনসুলিন নিয়ে ফেলেন। একারণে একদিকে রক্তের সুগার সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না, অন্যদিকে চামড়া শক্ত হয়ে গিয়ে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে।

এই আর্টিকেলে ইনসুলিন সিরিঞ্জ ও ইনসুলিন পেনের সাহায্যে ইনসুলিন নেওয়ার উপায় তুলে ধরা হয়েছে। এই নির্দেশনা অনুসরণ করে রোগী নিজেই সহজ ও সঠিকভাবে ইনসুলিন নিতে পারবেন।

ইনজেকশন দেওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন

১. ইনসুলিন: ইনসুলিনের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। এই সম্পর্কে আর্টিকেলের পরবর্তী অংশে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

২. ইনসুলিন সিরিঞ্জ অথবা ইনসুলিন পেন: ইনসুলিন ইনজেকশন নেওয়ার জন্য সিরিঞ্জ অথবা পেন—যেকোনো একটি ব্যবহার করা যায়।

  • ইনসুলিন সিরিঞ্জ: এই বিশেষ সিরিঞ্জগুলো বিভিন্ন সাইজের হতে পারে। ইনসুলিনের ধরনভেদে নির্দিষ্ট সাইজের সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হয়। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সিরিঞ্জে ইনসুলিন নিয়ে এরপরে ইনজেকশনটি করতে হয়।
  • ইনসুলিন পেন বা কলম: এটি দুই ধরনের হতে পারে। এক ধরনের ইনসুলিন পেন আছে যাতে আগে থেকেই ইনসুলিন ভরা থাকে। কলমের ভেতরের ইনসুলিন শেষ হয়ে গেলে কলমটি ফেলে দিতে হয়। আরেক ধরনের ইনসুলিন পেন আছে যেটির ভায়াল অথবা কার্তুজ (কার্ট্রিজ) পরিবর্তন করে বারবার ব্যবহার করা যায়।

    এসব কলমের সাথে আলাদাভাবে সুঁই ব্যবহার করতে হয়। সুঁইগুলো কেবল একবার ব্যবহার করা যায়। এসব সুঁইকে কেবল ত্বক ভেদ করতে হয়—পেশী অথবা শিরার মধ্য দিয়ে যেতে হয় না। তাই এগুলো বেশ ছোটো ও সরু হয়।

৩. ধারালো বস্তু ফেলার নির্দিষ্ট স্থান: ধারালো বস্তু ফেলার জন্য একটি ঝুড়ি নির্দিষ্ট করে রাখতে পারেন। সেখানে ব্যবহৃত সুঁইটি নিরাপদে ফেলে দেওয়া যাবে।

ইনসুলিন সিরিঞ্জ দিয়ে ইনসুলিন দেওয়ার নিয়ম

আটটি সহজ ধাপে আপনি ঘরে বসেই ইনসুলিন সিরিঞ্জ এর সাহায্যে ইনসুলিন নিতে পারবেন। ধাপগুলো নিচে তুলে ধরা হলো—

ধাপ ১: হাত ভালোভাবে ধুয়ে শুকিয়ে নিন।

ধাপ ২: ইনজেকশনটি শরীরের কোন জায়গায় দিবেন সেটি ঠিক করুন। ইনসুলিন ইনজেকশন নেওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হলো শরীরের চর্বিযুক্ত স্থান। যেমন: তলপেট (নাভির নিচের অংশ), উরু অথবা নিতম্ব।

প্রত্যেকবার ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ইনজেকশন নেওয়া উচিত। আগে যেখানে ইনসুলিন নিয়েছেন তার থেকে থেকে অন্তত ১ সেন্টিমিটার বা আধা ইঞ্চি দূরে পরের ইনজেকশনটি দেওয়া উচিত। একই জায়গায় বারবার ইনজেকশন দিলে ওই জায়গাটি শক্ত হয়ে ফুলে যেতে পারে—যা পরবর্তীতে ইনসুলিন শোষণে ও সঠিকভাবে কাজ করতে বাধা দিবে।

ধাপ ৩: ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক ইনসুলিনটি বেছে নিন। ইনসুলিনের মেয়াদ আছে কি না সেটি বোতলের গায়ে লেখা তারিখ থেকে জেনে নিন।

ইনসুলিন ব্যবহারের পূর্বে সাধারণত বোতল বা ভায়াল ঝাঁকিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে ঘোলা প্রকৃতির ইনসুলিন ব্যবহারের পূর্বে ইনসুলিন পুরোপুরি মিশে যাওয়া পর্যন্ত ভায়ালটি দুই হাতের তালুর মাঝে রেখে আলতো করে ঘুরিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে ইনসুলিনের প্যাকেটে থাকা নির্দেশনাটি ভালোমতো পড়ে নিন।

ধাপ ৪: ইনসুলিন সিরিঞ্জটি মোড়ক থেকে বের করে ওপরের ক্যাপটি খুলে নিন। সিরিঞ্জটি খাড়া করে ধরুন। এবার সিরিঞ্জের প্লাঞ্জার বা দণ্ড টেনে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী যত ইউনিট ইনসুলিন নিতে হবে ততটুকু (তত cc বা ml) বাতাস সিরিঞ্জে প্রবেশ করান।

গুরুত্বপূর্ণ

ইনসুলিনের ধরনভেদে নির্দিষ্ট সাইজের সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হয়। নাহলে ভুল ডোজে ইনসুলিন নেওয়ার মাধ্যমে মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই ইনসুলিন নেওয়ার সময়ে ইউনিট অনুযায়ী উপযুক্ত সিরিঞ্জ ব্যবহার করা হচ্ছে কি না সেই বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। ডাক্তারের কাছ থেকে এই বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নিন।

ধাপ ৫: ইনসুলিনের ভায়ালটি খাড়া করে ধরে বোতলের ভেতরে সিরিঞ্জের সুঁইটি পুরোপুরি ঢুকিয়ে দিন। এরপর সিরিঞ্জের প্লাঞ্জার বা দণ্ড চেপে সিরিঞ্জের ভেতরে থাকা বাতাস ভায়ালে ঢুকিয়ে দিন। এতে করে সিরিঞ্জে ইনসুলিন তুলতে সুবিধা হবে।

এবার ভায়ালটি উল্টো করে ধরে নির্ধারিত ইউনিটের চেয়ে সামান্য বেশি ইনসুলিন সিরিঞ্জে টেনে নিন। খেয়াল রাখবেন ভায়ালের ভেতরে সুঁইয়ের মাথার চারিদিকে যেন ইনসুলিন থাকে এবং কোনো বাতাস না থাকে। 

ধাপ ৬: এরপর এমনভাবে সিরিঞ্জটি ধরুন যেন সুঁই ওপরে ও প্লাঞ্জার নিচে থাকে। সিরিঞ্জের গায়ে আলতো করে কয়েকটি টোকা দিন যেন ভেতরে কোনো বাতাস থাকলে তা ওপরের দিকে উঠে আসে।

এবার যতক্ষণ পর্যন্ত সুঁইয়ের মাথায় ইনসুলিন না দেখা যায় ততক্ষণ সিরিঞ্জের নিচের দিকে থাকা প্লাঞ্জারে ধীরে ধীরে চাপ দিন। এই কাজটিকে বলা হয় ‘প্রাইমিং’। সুঁই ও সিরিঞ্জের ভেতরে কোনো বাতাস থাকলে তা এই পদ্ধতিতে বের করা যায়। ফলে ডোজ নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। এভাবে সিরিঞ্জে যেন কেবল নির্ধারিত ডোজের ইনসুলিন থাকে সেটি নিশ্চিত করুন।

ধাপ ৭: যেখানে ইনজেকশনটি নিবেন সেই স্থান পরিষ্কার ও শুকনো আছে কি না সেটি নিশ্চিত করুন। ইনজেকশন দেওয়ার আগে ত্বক আস্তে চিমটি দিয়ে উঠিয়ে নিতে পারেন। এবার সমকোণে বা খাড়াভাবে (৯০ ডিগ্রী কোণে) সুঁইটি শরীরে পুরোপুরি প্রবেশ করান। যতক্ষণ পর্যন্ত পুরো সিরিঞ্জ খালি না হয় ততক্ষণ প্লাঞ্জারে চাপ দিয়ে ধরে রাখুন।

ধাপ ৮: সুঁইটি বের করে ফেলার আগে ইনসুলিন যেন শরীরে প্রবেশ করার যথেষ্ট সময় পায় সেজন্য এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনে নিন। ত্বকে চিমটি দিয়ে রাখলে তা সরিয়ে নিন। এবার সুঁইটি বের করে ফেলুন। অবশেষে সুঁইসহ সিরিঞ্জটি নিরাপদ স্থানে ফেলে দিন।

ইনসুলিন পেন বা কলম দিয়ে ইনসুলিন দেওয়ার নিয়ম

ইনসুলিন পেন এর সাহায্যে সাতটি সহজ ধাপে ইনসুলিন নেওয়া যায়। ধাপগুলো নিচে তুলে ধরা হলো—

ধাপ ১: হাত ভালোভাবে ধুয়ে শুকিয়ে নিন।

ধাপ ২: ইনজেকশনটি শরীরের কোন জায়গায় দিবেন সেটি ঠিক করুন। ইনসুলিন ইনজেকশন নেওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হলো শরীরের চর্বিযুক্ত স্থান। যেমন: তলপেট (নাভির নিচের অংশ), উরু অথবা নিতম্ব।

প্রত্যেকবার ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ইনজেকশন নেওয়া উচিত। আগে যেখানে ইনসুলিন নিয়েছেন তার থেকে থেকে অন্তত ১ সেন্টিমিটার বা আধা ইঞ্চি দূরে পরের ইনজেকশনটি দেওয়া উচিত। একই জায়গায় বারবার ইনজেকশন দিলে ওই জায়গাটি শক্ত হয়ে ফুলে যেতে পারে—যা পরবর্তীতে ইনসুলিন শোষণে ও সঠিকভাবে কাজ করতে বাধা দিবে।

ধাপ ৩: ইনসুলিন পেন এর বাইরের ও ভেতরের ক্যাপ খুলে এতে সুঁইটি লাগিয়ে নিন। ডায়াল ঘুরিয়ে দুই ইউনিটে নিয়ে আসুন। এরপর পেনটিকে সোজা করে ধরুন।

যতক্ষণ পর্যন্ত সুঁইয়ের মাথায় ইনসুলিন না দেখা যায় ততক্ষণ পেনের পেছনে থাকা প্লাঞ্জারে ধীরে ধীরে চাপ দিন। এই কাজটিকে বলা হয় ‘প্রাইমিং’। সুঁই ও ইনসুলিন ভায়াল বা কার্তুজের ভেতরে কোনো বাতাস থাকলে তা এই পদ্ধতিতে বের করা যায়, ফলে ডোজ নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।

ধাপ ৪: এবার ডায়াল ঘুরিয়ে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নির্দিষ্ট ডোজটি বাছাই করুন। যেখানে ইনজেকশনটি নিবেন সেই স্থান পরিষ্কার ও শুকনো আছে কি না তা নিশ্চিত করুন।

ধাপ ৫: সমকোণে বা খাড়াভাবে (৯০ ডিগ্রী কোণে) সুঁইটি শরীরে প্রবেশ করান। ইনজেকশন দেওয়ার আগে ত্বক আস্তে চিমটি দিয়ে উঠিয়ে নিতে পারেন। যতক্ষণ পর্যন্ত ডায়ালটি জিরোতে (০) ফেরত না যায়, ততক্ষণ প্লাঞ্জারে চাপ দিয়ে ধরে রাখুন।

ধাপ ৬: সুঁইটি সরানোর আগে ইনসুলিন যেন শরীরে প্রবেশ করার যথেষ্ট সময় পায়, সেজন্য ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গুনে নিন। ত্বকে চিমটি দিয়ে রাখলে তা সরিয়ে নিন।

ধাপ ৭: সুঁইটি সরিয়ে নিরাপদ স্থানে ফেলে দিন।

বিশেষ দ্রষ্টব্য

আপনার ডাক্তার আপনাকে কোনো বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করতে বললে সেই পদ্ধতিই মেনে চলবেন।