ডায়াবেটিস

ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যা রক্তে সুগারের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বাড়িয়ে দেয়।

ইনসুলিন নামের একটি হরমোন আপনার রক্তে সুগারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এই হরমোনটি পাকস্থলীর পেছনে থাকা অগ্ন্যাশয় বা প্যানক্রিয়াস নামের একটি গ্রন্থি থেকে তৈরি হয়।

যখন খাবার পরিপাক হয়ে আপনার রক্তে প্রবেশ করে, তখন এই ইনসুলিন রক্ত থেকে সুগার (গ্লুকোজকে) কোষের ভেতরে ঢুকিয়ে সেটাকে ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদন করে। কিন্তু ডায়াবেটিস হলে আপনার দেহ সুগার তথা গ্লুকোসকে ভেঙ্গে এভাবে শক্তি উৎপাদন করতে পারে না।

ডায়াবেটিসের কারণ ও প্রকারভেদ

মূলত দুটি কারণের ওপর ভিত্তি করে ডায়াবেটিসকে প্রধান দুই ভাগে ভাগ করা হয়:

টাইপ ১ ডায়াবেটিস

গ্লুকোজকে কোষের ভেতরে সরিয়ে নেয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ইনসুলিন আপনার দেহে থাকে না। টাইপ ১ ডায়বেটিসে এমনটি হয়, কারণ এতে দেহের নিজস্ব রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেম) আপনার ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলোকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়।

টাইপ ২ ডায়াবেটিস

আপনার দেহে যে ইনসুলিন তৈরী হয়েছে তা সঠিকভাবে  কাজ করছে না। টাইপ ২ ডায়াবেটিসে এটি দেখা যায়, কারণ এতে দেহে পর্যাপ্ত পরিমানে ইনসুলিন তৈরি হয় না, অথবা পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি হলেও দেহের কোষগুলো সেই ইনসুলিনের প্রতি সংবেদনশীল থাকে না।

টাইপ ১ ডায়াবেটিসের তুলনায় টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। সচরাচর ডায়াবেটিস বলতে টাইপ ২ ডায়াবেটিসকেই বোঝানো হয়ে থাকে।

এই দুটি প্রকার ছাড়াও ডায়াবেটিসের আরও প্রকারভেদ রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (Gestational Diabetes)। গর্ভবতী নারীদের অনেকের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় রক্তে সুগারের মাত্রা এতটা বেড়ে যায় যে তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দেহে যথেষ্ট পরিমাণে ইনসুলিন তৈরী হয় না, তখন এই ডায়াবেটিস দেখা দেয়। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ে লেখা আর্টিকেলগুলো পড়তে পারেন।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

অনেকেই নিজের অজান্তে টাইপ ২ ডায়াবেটিসে ভুগেন। প্রায়ই দেখা যায়, ভিন্ন ধরনের কোনো অসুখ বা সমস্যার জন্য যখন রক্ত কিংবা প্রস্রাব পরীক্ষা করানো হয় তখন এই ডায়াবেটিস ধরা পড়ে।

কারও ডায়াবেটিস থাকলে সেটা দ্রুত সনাক্ত করা প্রয়োজন, কারণ সময়মতো ডায়াবেটিস ধরা না পড়লে অর্থাৎ চিকিৎসা না নিলে এটি দিন দিন শরীরকে আরও বেশি অসুস্থ করে ফেলবে। শুধু তাই নয়, ডায়াবেটিস হলে আপনার অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতার ঝুঁকি বেড়ে যায়। অনেক সময় নীরবে, কোন লক্ষণ ছাড়াই এমন কিছু রোগ শরীরে বাসা বাঁধে যা আপনি বুঝতে পারেন না। এজন্যই আমরা ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়মিত চেকআপ করার পরামর্শ দিই।

স্বাস্থ্য জটিলতাগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের ডায়াবেটিসের নানা স্বাস্থ্য জটিলতা ও আপনার করণীয় শীর্ষক আর্টিকেলটি পড়ুন।

প্রি-ডায়াবেটিস (Pre-Diabetes)

অনেকেরই রক্তে সুগারের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি থাকে, কিন্তু এতটাও বেশি না যে তাদের ডায়াবেটিস রোগী বলা যায়। এই অবস্থাকে বলে প্রি-ডায়াবেটিস।

আপনার রক্তে সুগারের মাত্রা যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, তাহলে আপনার ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেকটা বেড়ে যায়। তাই রক্তে সুগারের মাত্রা স্বাভাবিক মাত্রার মধ্যে রাখতে এখনই ব্যবস্থা নিন।

সাধারণত একটি স্বাস্থ্যকর ডায়েট এবং ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে আপনি প্রি-ডায়াবেটিস থেকে ডায়াবেটিস হওয়া প্রতিরোধ করতে পারেন। কারও কারও এর সাথে ক্ষেত্রে ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে, সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

ডায়াবেটিসের লক্ষণ

ডায়াবেটিস এর মূল লক্ষণগুলো দেখা দিলে অতি দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত। এগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • অতিরিক্ত পিপাসা লাগা
  • স্বাভাবিকের চেয়ে ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া, বিশেষ করে রাতের বেলা
  • অতিরিক্ত ক্লান্ত বোধ করা
  • ওজন কমে যাওয়া ও শরীর শুকিয়ে যাওয়া
  • যৌনাঙ্গের আশেপাশে চুলকানো, কিংবা বারবার থ্রাশ (Thrush – ছত্রাক/ফাঙ্গাস দিয়ে ইনফেকশন) হওয়া
  • কাটা-ছেঁড়া বা অন্য কোন ক্ষত শুকাতে অনেক সময় লাগা
  • দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া

বিশেষ তথ্য

টাইপ ১ ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক দিনের ব্যবধানেও দেখা দিতে পারে ও মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারে। অন্যদিকে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের শুরুর দিকে তেমন নির্দিষ্ট লক্ষণ থাকে না, বা সেগুলো শুরুতে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। এর ফলাফল হিসেবে অনেকে না বুঝেই এই রোগ নিয়ে বছরের পর বছর পার করে দেন। 

আপনার লাইফস্টাইল বা জীবনধারার পরিবর্তন করলেও টাইপ ১ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে না। তবে স্বাস্থ্যকর, সুষম খাবার খাওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম করে শরীর সচল রেখে স্বাস্থ্যকর ওজন ধরে রাখার মাধ্যমে  আপনি  টাইপ ২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন।

ডায়াবেটিস নিয়ে জীবনযাপন

ডায়াবেটিস ধরা পড়লে আপনাকে রক্তে সুগারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এজন্য স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে, নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে ও সুগারের পরিমাণ ঠিক আছে কি না দেখার জন্য নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। ডায়াবেটিসের চেকআপ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন।

এসব নিয়মকানুন মেনে চললে আপনি সারাজীবন ওষুধের সাহায্য ছাড়া ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন। টাইপ ১ ডায়াবেটিস  থাকলে এগুলোর পাশাপাশি আজীবন নিয়মিত ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়।

যেহেতু টাইপ ২ ডায়াবেটিস ডায়েট এবং ব্যায়ামের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব না হলে এর চিকিৎসায় ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে। সাধারণত ট্যাবলেট দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা হয়, পরে প্রয়োজনে ইনসুলিন ইনজেকশন ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হতে পারে।