গর্ভাবস্থায় আপনার শরীরের বিভিন্ন পরিবর্তনের কারণে হওয়া সমস্যাগুলোর মধ্যে শ্বাসকষ্ট অন্যতম। এসময় এমন শ্বাসকষ্ট হওয়া অস্বাভাবিক না। তবে কখনো কখনো আপনার হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের রোগও এর পেছনে দায়ী হতে পারে। সেক্ষেত্রে পরীক্ষার মাধ্যমে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।
শ্বাসকষ্ট আপনার অস্বস্তির পাশাপাশি ঘুমেও বিঘ্ন ঘটাতে পারে। গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট হলে করণীয় কী এবং কখন জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা নিতে হবে, তা এই আর্টিকেলটিতে তুলে ধরা হয়েছে।
যেভাবে বুঝবেন আপনার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে
গর্ভবতী মায়েরা শ্বাসকষ্টকে এভাবে বর্ণনা করে থাকেন—
- স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারছেন না। শ্বাস নেওয়ার জন্য অধিক পরিশ্রম করতে হচ্ছে।
- গলা ও বুক চেপে আসছে মনে হচ্ছে।
- পর্যাপ্ত বাতাস বা অক্সিজেন পাচ্ছে না মনে হচ্ছে, অর্থাৎ বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছেন না।
সময়
গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট অনেক কারণেই হতে পারে। তাই কারণ ভেদে প্রায় সব ত্রৈমাসিকেই আপনার শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে হরমোনের তারতম্য শ্বাসপ্রশ্বাসকে পরিবর্তন করে। এসময় আপনার অতিরিক্ত ক্লান্তি থেকেও মনে হতে পারে আপনার অতিরিক্ত অক্সিজেন প্রয়োজন।
গর্ভাবস্থার মাঝের দিকে আপনার জরায়ুর বৃদ্ধিতে আপনার শ্বাসতন্ত্র ও রক্ত সংবহনতন্ত্রের বেশ কিছু পরিবর্তন হয়। এতে করে আপনার শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
আবার গর্ভাবস্থার শেষের দিকে শ্বাসকষ্ট অনেকটা বেড়ে যেতে পারে। কারণ ৩১ থেকে ৩৪ সপ্তাহের মধ্যে আপনার বাড়ন্ত শিশু অনেক বেশি জায়গা নিয়ে ফেলে। এতে করে বুক ও পেটের মাঝামাঝি থাকা ডায়াফ্রাম নামের শ্বাসপ্রশ্বাসের সাহায্যকারী পেশিতে চাপ পড়ে এবং শ্বাসকষ্ট হয়।
তবে গর্ভাবস্থার শেষ সপ্তাহে আপনার শ্বাসকষ্ট কিছুটা কমতে পারে। কারণ এসময় ডেলিভারির জন্য আপনার শিশু কিছুটা নিচে নামতে শুরু করে। ফলে শ্বাস নেওয়ার জন্য কিছুটা বাড়তি জায়গা পাওয়া যায়।
কারণ
নিচের কারণগুলোর ফলে গর্ভাবস্থায় আপনার শ্বাসকষ্ট হতে পারে—
বাড়ন্ত জরায়ু: গর্ভাবস্থায় জরায়ুর আকার বেড়ে যাওয়ার কারণে তা পেটের ওপর চাপ দেয়। ফলে উপরের দিকে থাকা ফুসফুসের ওপর-ও কিছুটা চাপ পড়ে। এতে করে ফুসফুসের অক্সিজেন বিনিময়ের স্থানটি সংকুচিত হয়ে আসে। এ কারণে শ্বাস নিতে কিছুটা কষ্ট হয়।[১]
হরমোনের পরিবর্তন: গর্ভাবস্থায় আপনার শরীরে বেশ কিছু হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এর মধ্যে প্রোজেস্টেরন হরমোন অন্যতম। শরীরে প্রোজেস্টেরন এর মাত্রা বেড়ে গেলে তা শ্বাসপ্রশ্বাসের স্বাভাবিক গতিকে বাড়িয়ে দেয়। ফলে অনেকে শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন। সাধারণত গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই শরীরে প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা বাড়তে থাকে, তাই এসময়-ও অনেকের শ্বাসকষ্ট শুরু হতে পারে।[২]
একাধিক গর্ভধারণ: যমজ শিশু বা একের অধিক সন্তান ধারণ করলে আপনার জরায়ু অধিক জায়গা দখল করবে। সেক্ষেত্রে আপনার ফুসফুস প্রসারণের জন্য আরও কম জায়গা পাবে এবং এতে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি: গর্ভাবস্থায় আপনার অতিরিক্ত ওজন বাড়লে সেটি থেকেও বিভিন্ন স্বাস্থ্য জটিলতা হতে পারে। এর মধ্যে শ্বাসকষ্ট অন্যতম।
অন্যান্য রোগ: গর্ভাবস্থা সম্পর্কিত কারণ ছাড়াও বিভিন্ন রোগের কারণেও আপনার শ্বাসকষ্ট হতে পারে। যেমন: রক্তশূন্যতা, প্রি-এক্লাম্পসিয়া, পালমোনারি এমবোলিজম, অ্যাজমা বা হাঁপানি, নিউমোনিয়া, কোভিড-১৯।
এ ছাড়াও নিচের কারণগুলোও আপনার শ্বাসকষ্টের পেছনে দায়ী হতে পারে—
- এলার্জি
- দুশ্চিন্তা
- থাইরয়েডের সমস্যা
- কোনো কারণে শ্বাসনালীতে কিছু আটকে গেলে
গর্ভাবস্থায় যেকোনো কারণে আপনার শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
চিকিৎসা
অন্য যেকোনো রোগ বা সমস্যার কারণে যদি আপনার শ্বাসকষ্ট না হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আপনার বিশেষ কোনো চিকিৎসার তেমন প্রয়োজন হবে না। তবে শ্বাসকষ্ট নিয়ে আপনার যেকোনো সমস্যা বা অস্বস্তির কথা গর্ভকালীন চেকআপের সময় আপনার চিকিৎসককে বলুন।
এসময় চিকিৎসক নিচের বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করবেন—
- আপনার হার্টরেট এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের হার চেক করবেন
- আপনার কী রকম ব্যায়াম বা কাজকর্ম করা উচিত সে সম্পর্কে ধারণা দিবেন
- আপনার শ্বাসকষ্টের পেছনে অন্য কোনো রোগ থাকলে সেটি নির্ণয় করবেন এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসা দিবেন
- শ্বাস কষ্ট নিয়ে আপনার কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে সেটির উত্তর দিবেন
- প্রয়োজনে আপনাকে কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে পাঠাবেন
প্রতিকার
গর্ভাবস্থার কারণে শ্বাসকষ্ট হলে সেটি সাধারণত প্রতিরোধ করা যায় না। তবে শ্বাসকষ্ট বোধ করলে নিচের ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করে স্বস্তি পেতে পারেন—
- নিজেকে শান্ত করুন: যেকোনো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করলে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যেতে পারে। কাজেই শ্বাসকষ্ট হলে প্রথমেই নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করুন।
- যেকোনো কাজ ধীরে সুস্থে করুন: কোনো ভারী কাজ বা ব্যায়াম করার ফলে যদি আপনার শ্বাসকষ্ট হয়, সবার আগে কাজটি থামান। কাজের মাঝে বিরতি নিন।
- অবস্থানের পরিবর্তন করুন: সোজা হয়ে বসুন। প্রয়োজনে কাঁধের সাহায্যে হেলান দিন। বুকে চাপ অনুভব করলে এতে করে তা কিছুটা কমতে পারে।
- দেহভঙ্গি খেয়াল করুন: শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে আপনার দুই হাত কিছুক্ষণ মাথার উপরে তুলে ধরে রাখুন। এতে করে আপনার পাঁজরের ওপর চাপ কমে আপনার শ্বাস নিতে সুবিধা হবে।
- সঠিক পজিশনে ঘুমান: রাতে ঘুমানোর সময় অতিরিক্ত বালিশ দিয়ে কোমর থেকে মাথা কিছুটা উঁচু করে ঘুমান। এ ধরনের অবস্থাকে ডাক্তারি ভাষায় ‘প্রপড আপ পজিশন’ বলে। এতে করে ঘুমানোর সময় আপনার ফুসফুসের ওপর চাপ কম পড়ে।
- শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম করুন: শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম আপনাকে গভীরভাবে শ্বাস নিতে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি আপনি অনেকটা রিল্যাক্স হবেন।
- ওজনের দিকে লক্ষ্য রাখুন: গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ওজন কমাতে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন। আপনার গর্ভকালীন চেকআপের সময় চিকিৎসক বলে দিবেন কতটুকু ওজন বাড়া আপনার জন্য স্বাভাবিক। সে অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
জরুরি অবস্থা
কোনো কাজ (যেমন: সিঁড়ি দিয়ে উঠা, ভারী কিছু আলগানো) এসব করার সময়ে হালকা শ্বাসকষ্ট হলে খেয়াল করুন বিশ্রাম নিলে তা প্রশমিত হয়ে যায় কি না। যদি বিশ্রামের পরও ঠিক না হয় অথবা আপনার নিচের এক বা একাধিক লক্ষণ দেখা যায়, সেটিকে জরুরি অবস্থা মনে করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন[৩]—
- তীব্র শ্বাসকষ্ট হলে
- শ্বাসকষ্টের সাথে কাশি হলে
- কথা বলার সময় একটা পূর্ণ বাক্য শেষ করতে না পারলে
- বুক ব্যথার সাথে শ্বাসকষ্ট হলে
- জ্বরের সাথে শ্বাসকষ্ট হলে
- আপনার হাত পায়ের আঙুল, ঠোঁট নীল বর্ণ ধারণ করা শুরু করলে
- শ্বাসকষ্টের সাথে মুখ, পেট ফুলে গেলে (অ্যালার্জির কারণে এমনটা হতে পারে)
- হঠাৎ করেই শ্বাসকষ্ট শুরু হলে
সাধারণ জিজ্ঞাসা
গর্ভাবস্থায় অনেক মায়েরই শ্বাসকষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সুস্থ গর্ভবতী মায়ের গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট হতে পারে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপনার হৃদরোগ ও ফুসফুসের কোনো রোগের লক্ষণ হিসেবেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে।[৪]
শুধুমাত্র গর্ভাবস্থার কারণেই শ্বাসকষ্ট হলে সেটি আপনার জন্য কিছুটা অস্বস্তিকর হলেও আপনার গর্ভের শিশুর জন্য এটি তেমন ক্ষতিকর নয়। কেননা গর্ভধারণজনিত কারণে আপনার শ্বাসকষ্ট হলেও আপনার শিশুর শরীরে প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল দিয়ে নিয়মিত অক্সিজেন সরবরাহ হয়।
গর্ভাবস্থার প্রথম থেকেই শ্বাসকষ্ট শুরু হতে পারে। তবে প্রসবের সময় কাছে আসতে আসতে এটি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে যায়।[৫]
গর্ভাবস্থার কারণেই শ্বাসকষ্ট হলে সেটি প্রসব পর্যন্ত থাকতে পারে। প্রসবের পর পর আপনার শ্বাসকষ্ট আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে। বিশেষত গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ২৭ সপ্তাহ থেকে ৪০ সপ্তাহের মধ্যে এটি প্রশমিত হতে শুরু করে।
আপনার যদি আগে থেকেই অ্যাজমা বা হাঁপানির কারণে শ্বাসকষ্ট থেকে থাকে এবং আপনি ইনহেলার ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে আপনি আগের মতোই ইনহেলার ব্যবহার করতে পারবেন। কারণ ইনহেলার ব্যবহার সাধারণত গর্ভাবস্থার জন্য নিরাপদ। তবে সাবধানতাবশত প্রয়োজনের অতিরিক্ত ইনহেলার ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
বিভিন্ন ভারী কাজ (যেমন: সিঁড়ি দিয়ে উঠলে, ভারী কিছু বহন করলে) আপনার শ্বাসকষ্ট হতে পারে। সেক্ষেত্রে যেকোনো ভারী কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। তবে নিত্য প্রয়োজনীয় হালকা কাজ এবং হাঁটা চলা বিশ্রাম নিয়ে করতে পারেন।