গর্ভাবস্থায় মুড সুইং

গর্ভাবস্থায় আবেগ ও অনুভূতি অনেক ওঠানামা করে। দেখা গেল যেকোনো মুহূর্তে আপনি হাসছেন আবার পর মুহূর্তেই আপনি কাঁদছেন। আপনার আবেগ এমন দ্রুত পরিবর্তনকে সহজ কথায় ‘মুড সুইং’ বলে।

প্রায় প্রত্যেক গর্ভবতী নারীই এমন অনুভূতির মধ্য দিয়ে যান। তবে এ ধরনের মুড সুইং অনেক ক্ষেত্রেই সাময়িক এবং গর্ভাবস্থার জন্য ক্ষতিকর নয়।

মুড সুইং কেন হয়

গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের বেশ কিছু শারীরিক, শারীরবৃত্তিক ও মানসিক পরিবর্তন আসে। এসব গর্ভাবস্থাজনিত কারণের প্রভাবেই আপনার মুড সুইং হতে পারে। যেমন—

প্রথম ত্রৈমাসিকে

  • হরমোন এর ওঠানামা: গর্ভাবস্থায় গর্ভবতী মায়েদের শরীরে বেশ কিছু হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়।[১] এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন এমন কিছু হরমোন, যেগুলো স্বাভাবিক সময়ে শরীরে থাকলেও গর্ভাবস্থায় এসবের পরিমাণ অনেক বেশি বেড়ে যায়। এসব হরমোনের প্রভাবে এসময় মায়েদের মুড সুইং হতে পারে।
  • ক্লান্তি ও পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব: গর্ভাবস্থায়, বিশেষ করে প্রথম ত্রৈমাসিকে আপনি যতই ঘুমান না কেন, আপনার বেশ ক্লান্ত লাগবে। এতে আপনার দৈনন্দিন কাজে বিঘ্ন ঘটতে পারে। এর ফলেও আপনার মুড সুইং হতে পারে।
  • মর্নিং সিকনেস: ধারণা করা হয় যে, গর্ভাবস্থায় প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ নারীই মর্নিং সিকনেস এ ভুগে থাকেন।[২] মর্নিং সিকনেস আপনার শরীরের বেশ কিছু শারীরিক পরিবর্তনের পাশাপাশি মানসিক পরিবর্তনও আনতে পারে। বমি বমি ভাবের কারণে শারীরিক অস্বস্তি তৈরি হলে তা আপনার মানসিক অবস্থা বা মুড কেও প্রভাবিত করতে পারে। ফলে দেখা দিতে পারে মুড সুইং।

দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে

  • শারীরিক পরিবর্তন: গর্ভাবস্থায় শরীরের পরিবর্তন অনেক গর্ভবতী মা উপভোগ করলেও অনেক মা নিজের শরীরের পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারেন না। এ থেকেও অনেকসময় মন-মেজাজের পরিবর্তন বা মুড সুইং হতে পারে।

    বিশেষত যে সব মায়েরা জীবনের কোনো সময় শারীরিক গঠন নিয়ে কটু কথা শুনেছেন বা কোনো কারণে শারীরিক গঠন নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগেছেন, তাদের গর্ভাবস্থায় শারীরিক পরিবর্তনের প্রভাবে মুড সুইং হতে পারে।[৩]
  • পরীক্ষা নিরীক্ষা: গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে গর্ভের শিশুর অনেক ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়। এসব পরীক্ষার ফলাফল নিয়েও অনেক মায়েরা দুশ্চিন্তা করেন। এ থেকেও মুড সুইং হতে পারে।

তৃতীয় ত্রৈমাসিকে

  • দুশ্চিন্তা: অনেকসময় প্রথম বারের মতো মা হওয়া নিয়ে অথবা প্রথম শিশুর সাথে অনাগত শিশুর সম্পর্ক নিয়ে অনেক মা দুশ্চিন্তা করে থাকেন। পাশাপাশি প্রসব বা ডেলিভারি নিয়েও অনেক মা ভয়ে থাকেন। এসব ভীতি ও দুশ্চিন্তা থেকেও আপনার মুড সুইং হতে পারে।

মুড সুইং হলে করণীয়

মুড সুইং গর্ভাবস্থার জন্য খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। তারপরও এটি আপনার দৈনন্দিন কাজে হয়তো কিছুটা ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। নিচের কিছু সহজ উপায় অবলম্বন করে আপনি মুড সুইং এর সমস্যা অনেকটাই এড়িয়ে চলতে পারেন—

১. স্বাস্থ্যকর খাওয়া দাওয়া করুন: আপনি যখন ক্ষুধার্ত থাকবেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই আপনার মনমেজাজ কিছুটা বিক্ষিপ্ত থাকতে পারে। কাজেই গর্ভাবস্থায় নিয়মিত স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন। কোনো বেলার খাবার বাদ দিবেন না। এতে করে আপনার মস্তিষ্ক প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাবে এবং ফলে মন-মেজাজও ঠান্ডা থাকবে।

২. পর্যাপ্ত শারীরিক ব্যায়াম করুন: ব্যায়ামকে অনেকসময় স্ট্রেস রিলিভার ও মুড বুস্টার বলা হয়। আপনার গর্ভাবস্থায় মুড সুইং কিংবা মন খারাপ হলে হালকা ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করলে আপনার ভালো লাগতে পারে। হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করতে ঘরের বাইরে বের হলে বাইরের আলো বাতাস আপনার মনকে প্রশান্তি দিবে।

ব্যায়াম আমাদের শরীরে বিভিন্ন স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি ব্যায়াম এর ফলে আপনার শরীর থেকে এন্ডোরফিন নামের হরমোন নির্গত হয়, এই হরমোন প্রাকৃতিকভাবে পেইনকিলার হিসেবে কাজ করে আর মুড ভালো করতে সহায়তা করে। তাই গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ব্যায়াম আপনার মন ভালো রাখতে সহায়তা করবে।

৩. শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করুন: উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দূর করার জন্য আপনি একটি সহজ ব্যায়াম করতে পারেন। শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম আমাদের মানসিক চাপ বা স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। এই ব্যায়ামটি শুয়ে, চেয়ারে বসে হেলান দিয়ে অথবা দাঁড়িয়ে করা যেতে পারে।

ব্যায়ামের শুরুতেই রিল্যাক্সড হয়ে একটি আরামদায়ক অবস্থান গ্রহণ করুন। আপনি যদি আঁটসাঁট কাপড় পরে থাকেন, তা বদলে ঢিলেঢালা কাপড় পরে নিতে পারেন।

  • শুয়ে থাকলে: পা সোজা করে রাখুন অথবা এমনভাবে হাঁটু ভাঁজ করে নিন যাতে পায়ের পাতা বিছানার সাথে লেগে থাকে। দুই হাত দুই পাশে লম্বা করে রাখুন। হাতের তালু ওপরের দিকে, অর্থাৎ ঘরের ছাদের দিকে মুখ করে রাখুন।
  • চেয়ারে বসে থাকলে: দুই হাত দুই পাশের হাতলে রাখুন। পা দুটো মেঝেতে সমান ভাবে ফেলুন। দুই পায়ের মাঝে এক কোমর সমান ফাঁকা জায়গা রাখুন।
  • দাঁড়িয়ে থাকলে: পা দুটো সমানভাবে মেঝেতে ফেলুন এবং দুই পায়ের মাঝে ফাঁকা জায়গা রেখে আরামদায়ক ভাবে বসুন।

এবার লম্বা করে শ্বাস নিন। খুব বেশি জোর দিয়ে চেষ্টা না করে আরামদায়কভাবে পেট পর্যন্ত গভীর শ্বাস নিন। প্রতিবার শ্বাস নেওয়ার সময়ে মনে মনে এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত ধীরে ধীরে গুনবেন। তবে শুরুতেই পাঁচ পর্যন্ত গুনে লম্বা শ্বাস নিতে কষ্ট হতে পারে, সেক্ষেত্রে যতটুকু সম্ভব হয় ততটুকু নিন।

তারপর শ্বাস ধরে না রেখে আলতো করে ছেড়ে দিন। আবারও মনে মনে এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গুনতে চেষ্টা করতে পারেন। চেষ্টা করবেন শ্বাস নেওয়ার সময়ে নাক দিয়ে শ্বাস নিতে এবং মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়তে।

নিয়মিত ব্যবধানে এভাবে শ্বাস নিন আর শ্বাস ছাড়ুন। তিন থেকে পাঁচ মিনিট পর্যন্ত এই ব্যায়ামটি করতে পারেন।

৪. ঘুমকে প্রাধান্য দিন: গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় ঘুম শরীরের জন্য অপরিহার্য। একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক  প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য দৈনিক ৭–৯ ঘন্টা ঘুমকে আদর্শ ধরা হয়।[৪][৫] এর চেয়ে কম ঘুম হলে সেটি আপনার ও গর্ভের শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।[৬] একটানা বেশিক্ষণ ঘুমোতে সমস্যা হলে রাতের ঘুমের পাশাপাশি প্রয়োজনে দিনের বেলাও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারেন।

চেষ্টা করুন ঘুমের একটি রুটিন মেনে চলতে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়ার এবং একই সময়ে ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করবেন। খুব বেশি অথবা খুব কম না ঘুমিয়ে নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। ঘুমানোর জন্য সঠিক পরিবেশ তৈরি করুন। ঘুমাতে যাওয়ার আগে চা-কফি বা ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকুন।

গর্ভকালীন সময়ে দৈনিক ২০০ মিলিগ্রামের বেশি ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় ও খাবার খাওয়া উচিত নয়। অতিরিক্ত ক্যাফেইন খেলে সেটি গর্ভের শিশুর ওজন কম হওয়া এবং সময়ের আগে জন্মানোসহ নানান ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।[৭][৮]

প্রিয়জনের সাথে কথা বলুন: আপনার পরিবার ও কাছের মানুষের সাথে নিজের অনুভূতি সম্পর্কে কথা বলুন। তাদের জানান আপনি কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। আপনার মুড সুইং জনিত পরিবর্তনের জন্য তাদের আগে থেকেই জানান। প্রয়োজনে আপনার পরিচিত অন্য গর্ভবতী মায়েদের সাথে কথা বলুন।

মর্নিং সিকনেস এর জন্য প্রস্তুত থাকুন: গর্ভাবস্থায় মর্নিং সিকনেস এমন একটি সমস্যা যা কোনো সতর্ক ছাড়াই চলে আসে। তাই এটির জন্য প্রস্তুত থাকুন। সবসময় নিজের সাথে একটা পলিথিন ব্যাগ রাখুন। কোনো গন্ধ বা খাবার যদি আপনাকে ট্রিগার করে সেটি এড়িয়ে চলুন।

কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন

গর্ভাবস্থায় ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করেও মুড সুইং থেকে প্রতিকার না পেলে এবং নিচের যেকোনো লক্ষণ দেখা গেলে আপনার চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন—

  • আপনি বিষণ্ণতা বোধ করলে
  • আপনার ঘুমাতে সমস্যা হলে
  • আপনার খেতে সমস্যা হলে
  • আপনার দৈনন্দিন কাজে বিঘ্ন ঘটলে
  • আপনার মুড সুইং এর সমস্যা দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বাড়তে থাকলে

সাধারণ জিজ্ঞাসা

মুড সুইং কি গর্ভধারণের লক্ষণ?

খুব দ্রুত ইমোশন বা আবেগের পরিবর্তন গর্ভাবস্থার প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে। তবে একই ধরনের মুড সুইং অনেকসময় মাসিকের আগে আগেও হতে পারে।[৯] কাজেই গর্ভাবস্থা নিশ্চিত হতে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করুন।

সব মায়েরই কি গর্ভাবস্থায় মুড সুইং হতে পারে?

দুজন গর্ভবতী মায়ের গর্ভাবস্থা যেমন একই রকম না, তেমনি সব মায়েদেরও গর্ভাবস্থায় মুড সুইং এর ধরন একই রকম না। একজন মা মুড সুইং নিয়ে খুব বেশি সমস্যায় থাকতে পারেন, আবার অন্যজনের মুড গর্ভাবস্থার নয় মাসেই একই রকম থাকতে পারে। এমনকি একজন মায়ের দুটি ভিন্ন গর্ভাবস্থায়ও দুই ধরনের মুড সুইং হতে পারে।
তবে যেসব নারীদের মাসিকের আগে মুড সুইং হয়ে থাকে, তাদের সাধারণত গর্ভাবস্থায়ও মুড সুইং হবার সম্ভাবনা থাকে।