একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গর্ভধারণ নিশ্চিত হওয়ার পরে শতকরা ১০ ভাগ ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থার পরিণতি গর্ভপাত হয়ে থাকে। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে গর্ভধারণ নিশ্চিত হওয়ার পূর্বেই গর্ভপাত হয়ে যায়। সাধারণত প্রথম ত্রৈমাসিকে গর্ভপাত হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি।[১]
মা ও শিশুর স্বাস্থ্য এবং আশেপাশের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী কেন্দ্রের চিকিৎসা ব্যবস্থার সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে প্রত্যেক শিশুর বাইরের জগতে বেঁচে থাকার জন্য প্রস্তুত হতে সময় কিছুটা কম-বেশি লাগতে পারে। তাই গর্ভপাতের সময়সীমা একেক দেশে একেক রকম হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে গর্ভাবস্থার ২৮ সপ্তাহ সম্পূর্ণ হওয়ার আগে গর্ভের সন্তান মারা গেলে তাকে গর্ভপাত বলে। অপরদিকে ২৮ সপ্তাহের পর গর্ভে সন্তানের মৃত্যু ঘটলে তাকে মৃতপ্রসব বলা হয়।[২]
গর্ভপাতের লক্ষণ
গর্ভপাতের সবচেয়ে পরিচিত লক্ষণ হলো যোনিপথ বা মাসিকের রাস্তা দিয়ে রক্ত যাওয়া। এই রক্তপাতের মাত্রা কারও বেশি আবার কারও কম হয়। অন্তর্বাসে অথবা পায়জামায় রক্তের হালকা ছোপ ছোপ দাগ লাগা কিংবা বাদামী রঙের অল্প পরিমাণে রক্তপাত হওয়া থেকে শুরু করে টকটকে লাল রঙের এবং জমাট বাঁধা রক্তের দলাসহ ভারী রক্তপাত হতে পারে।
এই রক্তপাত কারও একটানা কয়েকদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। আবার কারও ক্ষেত্রে রক্তপাত কিছু সময় বন্ধ থেকে কয়েক দিন পরে পুনরায় শুরু হতে পারে।
যোনিপথে রক্তপাত ছাড়াও গর্ভপাত হলে অন্যান্য যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে সেগুলো হলো—
- তলপেট মোচড়ানো অথবা ব্যথা হওয়া
- যোনিপথ দিয়ে তরল নির্গত হওয়া
- যোনিপথ দিয়ে মাংসের দলার মতো কিছু নির্গত হওয়া
- গর্ভধারণের লক্ষণগুলো না থাকা। যেমন: বমি বমি ভাব ও স্তনে ব্যথা
দ্রষ্টব্য, গর্ভকালের প্রথম দিকে যোনিপথে রক্তপাত হলে তা সব ক্ষেত্রে গর্ভপাত নির্দেশ করে না। এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি বা জরায়ুর বাইরে গর্ভধারণ করলে, মোলার প্রেগন্যান্সি, অর্থাৎ গর্ভধারণের পরিবর্তে গর্ভে থোকা থোকা মাংসের দলা সৃষ্টি হলে এবং ইমপ্ল্যানটেশন ব্লিডিং, অর্থাৎ ভ্রূণ জরায়ুর গায়ে বসার কারণেও মায়ের যোনিপথে রক্তপাত হতে পারে।
এসব ছাড়াও এই সময়ে অন্যান্য কোনো রোগের কারণেও রক্তপাত হতে পারে।[৩] তাই এই সময়ে যোনিপথে রক্তপাত হলেই আতঙ্কিত না হয়ে নিকটস্থ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
তবে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি একটি ভয়াবহ জটিল সমস্যা। কেননা এর ফলে হঠাৎ করে শরীরের ভেতরে প্রচুর পরিমাণে রক্তপাত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এমনকি রোগী রক্তপাতের কারণে মৃত্যুবরণও করতে পারে। তাই এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া মাত্র যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে।
এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির লক্ষণ এবং লক্ষণ দেখা দিলে কী হতে পারে এসব জানতে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি আর্টিকেলটি পড়ুন।
গর্ভপাতের কারণসমূহ
গর্ভপাত নানান কারণে হতে পারে। সাধারণত গর্ভের সন্তান অথবা মায়ের বিভিন্ন রোগ ও ত্রুটির কারণে গর্ভপাত ঘটে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গর্ভপাতের কারণ সুনির্দিষ্টভাবে বের করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
প্রথম ত্রৈমাসিকে সাধারণত গর্ভের শিশুর কোনো ধরনের সমস্যার কারণে গর্ভপাত হয়ে থাকে। প্রথম ত্রৈমাসিকের পরের সময়গুলোতে মায়ের নানান রোগের কারণে গর্ভপাত হতে পারে।
এ ছাড়াও গর্ভের শিশুর চারপাশে কোনো ধরনের ইনফেকশন হলে ধীরে ধীরে পানি ভাঙতে শুরু হয়। এর ফলে কোনো ধরনের ব্যথা কিংবা রক্তপাত শুরু হওয়ার আগেই গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে।
আবার কখনো কখনো জরায়ুমুখ নির্দিষ্ট সময়ের বেশ আগে খুলতে শুরু করে। এ কারণেও গর্ভপাত হতে পারে।
গর্ভপাতের কারণগুলোকে ত্রৈমাসিক অনুযায়ী দুইটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন—
প্রথম ত্রৈমাসিকে গর্ভপাতের কারণ
গর্ভাবস্থার ১৩তম সপ্তাহ পর্যন্ত যে সময়কাল তাকে প্রথম ত্রৈমাসিক বলে। এসময়ে গর্ভপাত হওয়ার কারণগুলো হলো—
১. ক্রোমোজোমের সমস্যা
আমাদের দেহের যেকোনো অংশের গঠন কেমন হবে তা নির্ভর করে ‘ডিএনএ’ এর ওপর। অর্থাৎ শিশুর চেহারা অথবা চুলের রঙ থেকে শুরু করে তার শরীরের ভেতরের নানান অঙ্গের গঠনও ‘ডিএনএ’ এর ওপর নির্ভরশীল। আর ক্রোমোজোম হলো একাধিক ‘ডিএনএ’ এর সমষ্টি।
প্রতিটি মানুষের দেহে মোট ২৩ জোড়া, অর্থাৎ ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকে। এর মধ্যে ২৩টি আসে মায়ের শরীর থেকে আর বাকী ২৩টি আসে বাবার শরীর থেকে।
কখনো কখনো গর্ভধারণের সময়ে মা-বাবার কাছ থেকে ২৩টির কম অথবা বেশি ক্রোমোজোম চলে আসতে পারে। এর ফলে গর্ভের শিশুর দেহে ক্রোমোজোম সংখ্যা কম-বেশি হয়। ফলে সে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারবে না। এর পরিণতি স্বরূপ গর্ভপাত হতে পারে।[৪]
এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটে সে সম্পর্কে এখনো সঠিকভাবে কিছু জানা যায়নি। এমনকি এ ধরনের ঘটনার পেছনে গর্ভের শিশুর মা-বাবার কোনো ধরনের শারীরিক সমস্যাও দায়ী নয়। যে কারও ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটতে পারে।
তবে স্বস্তির বিষয় এই যে, পরবর্তী কোনো গর্ভাবস্থায় এর পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা কম।
২. গর্ভফুলের সমস্যা
গর্ভফুল বা প্লাসেন্টার মাধ্যমে মায়ের শরীর থেকে গর্ভের শিশুর দেহে রক্ত সরবরাহ হয়। এই রক্তের মাধ্যমে সে গর্ভের ভেতরে বেড়ে ওঠার জন্য পুষ্টি উপাদান পায়। তাই গর্ভফুলে কোনো সমস্যা থাকলে শিশুর রক্ত সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে।
৩. অন্যান্য কারণ
যে কারও যেকোনো সময় গর্ভপাত হতে পারে। তবুও কিছু বিষয় প্রথম ত্রৈমাসিকে গর্ভপাত হওয়ার হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। যেমন—
- গর্ভবতী মায়ের বয়স বেশি হওয়া[৫]
- গর্ভবতী মায়ের ওজন অতিরিক্ত হওয়া[৬]
- অতিরিক্ত ক্যাফেইনযুক্ত খাবার খাওয়া অথবা পানীয় পান করা। যেমন: চা ও কফি[৭]
- ধূমপান করা অথবা ধূমপায়ীদের আশেপাশে থাকার কারণে সিগারেটের ধোঁয়া সেবন করা
- মাদকদ্রব্য গ্রহণ করা
- মদপান করা[৮]
দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে গর্ভপাতের কারণ
গর্ভাবস্থার ১৪তম সপ্তাহ থেকে ২৮ সপ্তাহ পর্যন্ত সময়কালকে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক বলে। এই সময়ে যেসব কারণে গর্ভপাত হতে পারে—
১. মায়ের দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা
দীর্ঘ দিন মায়ের কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে এবং বিশেষ করে ঠিকমতো তার চিকিৎসা না নিলে অথবা তা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে, গর্ভপাতের আশঙ্কা বেড়ে যায়। যেসব রোগ থাকলে গর্ভপাতের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে সেগুলো হলো—
- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস[৯]
- অতিরিক্ত উচ্চ রক্তচাপ
- সিস্টেমিক লুপাস ইরাইথামেটোসাস বা এসএলই
- কিডনির রোগ
- হাইপারথাইরয়েডিজম বা রক্তে থাইরয়েড হরমোন বেড়ে যাওয়া
- হাইপোথাইরয়েডিজম বা রক্তে থাইরয়েড হরমোন কমে যাওয়া
- অ্যান্টি ফসফোলিপিড সিনড্রোম[১০]
২. ইনফেকশন
গর্ভাবস্থায় মা কিছু ইনফেকশনে আক্রান্ত হলে গর্ভপাতের আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে।[১১][১২] যেমন—
- রুবেলা ভাইরাস
- সাইটোমেগালো ভাইরাস
- ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস। এক্ষেত্রে যোনিপথে স্বাভাবিক অবস্থায় থাকা নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা অতিরিক্ত বেড়ে যায়
- এইচআইভি
- ক্ল্যামাইডিয়া
- গনোরিয়া
- সিফিলিস
- ম্যালেরিয়া
৩. খাদ্যে বিষক্রিয়া
কিছু নির্দিষ্ট জীবাণু দ্বারা দূষিত খাবার খাওয়ার ফলে বিষক্রিয়া হলে গর্ভপাতের আশংকা বেড়ে যেতে পারে। যেমন—
- অপাস্তুরিত দুধ অথবা দুগ্ধজাত খাবার থেকে লিসটেরিয়া ব্যাকটেরিয়ার বিষক্রিয়া
- কাঁচা অথবা ভালোমতো সেদ্ধ না হওয়া মাংস থেকে টক্সোপ্লাসমার বিষক্রিয়া
- কাঁচা অথবা আধা সিদ্ধ ডিম থেকে স্যালমনেলার বিষক্রিয়া
এজন্য দুধ ভালো ভাবে ফুটিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করুন। পাশাপাশি ডিম, মাছ ও মাংস ভালো মতো রান্না করে খান। সুশি জাতীয় কাঁচা অথবা ভালোমতো সেদ্ধ না করা খাবার এড়িয়ে চলুন।
৪. ঔষধপত্র
কিছু ঔষধ সাধারণ মানুষের জন্য নিরাপদ হলেও সেসব গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। গর্ভাবস্থায় এসব সেবন করলে তা গর্ভের সন্তানের বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করতে পারে। এমনকি গর্ভপাতও ঘটাতে পারে।
গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ায় এমন কিছু ঔষধ হলো—
- মিসোপ্রস্টল: গ্যাস্ট্রিক বা পেটের আলসারের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত
- রেটিনয়েড: ত্বকের একজিমা অথবা ব্রণের সমস্যার জন্য ব্যবহৃত
- মেথোট্রেক্সেট: বাত রোগের জন্য ব্যবহৃত
- বিভিন্ন এনএসএআইডি গ্রুপের ঔষধ: ব্যথানাশক ও প্রদাহনাশক হিসেবে ব্যবহৃত। যেমন: আইবুপ্রোফেন
সবচেয়ে ভালো হয় যদি গর্ভাবস্থায় যেকোনো ঔষধ নেওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নেওয়া হয়। ‘ওভার দ্যা কাউন্টার’, অর্থাৎ প্রেসক্রিপশন ছাড়া ক্রয় করা যায় এমন ঔষধগুলো নিরাপদ কি না সেটিও ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে নিলে ভালো হয়। ঔষধের নির্দেশিকা পড়ে নিলেও এক্ষেত্রে আপনি কিছু তথ্য জানতে পারেন।
৪. জরায়ুর গঠন
মায়ের গর্ভ, অর্থাৎ জরায়ুর গঠনে কিছু সমস্যা হলে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে গর্ভপাত ঘটতে পারে। যেমন: গর্ভাবস্থায় জরায়ুতে টিউমার বা ফাইব্রয়েড হলে এবং জরায়ুর আকৃতি অস্বাভাবিক হলে।
৫. দুর্বল জরায়ুমুখ
কিছু কিছু ক্ষেত্রে জরায়ুমুখের পেশিগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে দুর্বল হয়ে যেতে পারে। পূর্বে কখনো জরায়ুমুখে কোনো আঘাত পেয়ে থাকলে বিশেষত কোনো অপারেশন হওয়ার কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হলে এমন সমস্যা হতে পারে।
পেশির দুর্বলতার কারণে জরায়ুমুখ গর্ভকাল শেষ হওয়ার আগেই প্রসারিত হয়ে যেতে পারে। ফলে গর্ভপাত ঘটতে পারে।
৬. পিসিওএস
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম বা পিসিওএস এটি একটি হরমোনজনিত সমস্যা, যার ফলে ওভারি বা ডিম্বাশয় স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হয়ে যায়। ফলে ডিম্বাশয়ের স্বাভাবিক কাজকর্ম বাধাগ্রস্ত হয়। এই রোগে একজন নারীর শরীরে বিভিন্ন রকমের সমস্যা তৈরি হতে পারে। কিছু গবেষণায় ধারণা করা হয়েছে যে, পিসিওএস আক্রান্ত নারীর গর্ভপাত হওয়ার আশংকা বেশি।