গর্ভপাত-পরবর্তী জীবন

গর্ভপাত যেকোনো মায়ের ও পরিবারের জন্য একটি মর্মান্তিক ঘটনা। গর্ভপাতের পর পর আপনার মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটতে পারে। পরবর্তীতে গর্ভধারণ করা নিয়ে মনে নানান ধরনের প্রশ্ন জাগতে পারে। গর্ভপাত পরবর্তী সময়টায় কীভাবে নিজের মানসিক যত্ন নিতে পারেন এবং কীভাবে ধীরে ধীরে পরবর্তী গর্ভধারণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করবেন—সেসব নিয়ে এই অংশে আলোচনা করা হয়েছে।

মানসিক অবস্থা

গর্ভপাতের পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়া স্বাভাবিক একটি ঘটনা। অনেকে গর্ভপাতের বেশ কিছুদিন এমনকি কয়েক সপ্তাহ পরেও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

যেসব সমস্যা হতে পারে

এসময়ে আপনি ক্লান্তি, দুঃখ ও বিষণ্ণতা অনুভব করতে পারেন। এমনকি অপরাধবোধেও ভুগতে পারেন। সেই সাথে আপনার খাবারে অরুচি তৈরি হওয়া অথবা ঘুমের সমস্যাও হতে পারে। অনেকসময়ে হয়তো আপনি রাগ অনুভব করবেন—আপনার সঙ্গীর প্রতি অথবা পরিবার-পরিজনের প্রতি কিংবা এমন কেউ যাদের গর্ভাবস্থা সফল হয়েছে তাদের প্রতি।

কখনো কখনো আপনি অসাড় বা অনুভূতিশূন্য অনুভব করতে পারেন, যেন ঘটনাটি আপনার ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি। আবার কেউ কেউ শূন্যতা ও একাকীত্ব অনুভব করে থাকেন। মাঝে মাঝে আপনার নিজেকে আতঙ্কিত মনে হতে পারে, যার ফলে স্বাভাবিক জীবনে মানিয়ে নিতে অসুবিধাও হতে পারে।

যা যা করতে পারেন

অনেকে নিজের অনুভূতি-অভিজ্ঞতা নিয়ে অন্যদের সাথে আলোচনা করলে কিছুটা আশ্বস্ত অথবা হালকা বোধ করেন। আবার অনেকের জন্য এই বিষয়ে কথা বলা খুবই কষ্টদায়ক হয়ে পড়ে। তাই আপনার যা ভালো লাগে সেটিই করুন।

গর্ভপাতের পর অনেকের জন্য পুনরায় গর্ভধারণের কথা চিন্তা করাও কঠিন হয়ে যেতে পারে। আবার কেউ কেউ গর্ভপাতের পর পরই পরবর্তী গর্ভধারণের পরিকল্পনা শুরু করে ফেলেন। আপনি নিজের মন ও শরীরের সুস্থতার ওপর ভিত্তি করে আপনার পছন্দমাফিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

কারও কারও ক্ষেত্রে গর্ভপাতের পর সঙ্গীর সাথে সম্পর্কে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। আপনাকে এই কঠিন সময়ে সহায়তা দেওয়ার জন্য আপনার সঙ্গী নিজের অনুভূতিগুলো চেপে রাখতে পারেন। তাই নিজেদের মধ্যে এই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করে নিলে ভালো হয়। এতে করে নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও সমস্যা কিছুটা কম হতে পারে।

মনোবল ফিরে পেতে ও স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসার জন্য আপনি মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী সংস্থার সাহায্য নিতে পারেন। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগে আপনি এরকম সহায়তা পেতে পারেন।

বেসরকারিভাবেও এরকম বিভিন্ন সংস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে অবশ্যই রেজিস্টার্ড সাইকোলজিস্ট অথবা সাইকিয়াট্রিস্ট ছাড়া অন্য কারও পরামর্শ নেওয়ার চেষ্টা করুন। নিজে থেকে কোনো ঔষধ সেবন করা থেকে বিরত থাকুন।

পরবর্তীতে গর্ভধারণ

গর্ভপাতের পর পরই সহবাস করলে যোনিপথে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই গর্ভপাতের সব লক্ষণ পুরোপুরি সেরে যাওয়ার পরে সহবাস করলে ভালো হয়। এজন্য গর্ভপাতের পর প্রায় ২ সপ্তাহ সহবাস এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ২ সপ্তাহ পর্যন্ত ট্যামপুন বা মিন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার না করলে ভালো হয়। কেননা এই সময়ে এসব ব্যবহার ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।[১]

গর্ভপাতের ২ সপ্তাহ পরেই পুনরায় গর্ভধারণ করা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, গর্ভপাতের কমপক্ষে ৬ মাস পর পুনরায় গর্ভধারণ করলে তা মা ও শিশুর জন্য ভালো ফলাফল নিয়ে আসতে পারে।[২][৩] তবে অপরদিকে স্কটল্যান্ডের নারীদের ওপর একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, প্রথমবার গর্ভপাতের ৬ মাসের মধ্যে গর্ভধারণ করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।[৪]

তাই আপনার শারীরিক অবস্থা এবং পূর্বের গর্ভধারণের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে ডাক্তার আপনাকে পুনরায় কখন গর্ভধারণ করলে ভালো হয় সে বিষয়ে আরও ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন। সেজন্য হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার সময়ে অথবা পুনরায় গর্ভধারণ করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার চেষ্টা করুন।

এসময়টায় আপনি গর্ভবতী হতে না চাইলে গর্ভপাতের পর যত দ্রুত সম্ভব যেকোনো ধরনের কার্যকর জন্ম-নিরোধক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করে দিতে হবে।

তবে গর্ভপাতের পর ১ বার মাসিক হয়ে যাওয়ার পর গর্ভধারণের চেষ্টা করলে ভালো হয়। এতে করে আপনি কখন গর্ভধারণ করেছেন তা বুঝতে সুবিধা হয়। সাধারণত গর্ভপাতের ৪-৮ সপ্তাহের মধ্যে মাসিক শুরু হয়ে যায়। তবে একেক জনের ক্ষেত্রে এই সময়কাল কম-বেশি হতে পারে। তবে শুরুর দিকে মাসিক অনিয়মিত হতে পারে এবং মাসিক চক্র স্বাভাবিক হতে বেশ কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে।

পরবর্তীতে গর্ভপাত প্রতিরোধের উপায়

অনেকক্ষেত্রে গর্ভপাতের কোনো নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে তা সবসময় প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না। তবে গর্ভপাতের ঝুঁকি কমানোর জন্য আপনি যেসব বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে পারেন—

১. প্রি-কন্সেপশন চেকআপ

গর্ভধারণ করার আগে প্রি-কন্সেপশন চেকআপে আপনার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করুন। এই চেকআপে আপনি পূর্বে গর্ভবতী হয়ে থাকলে সে সম্পর্কে এবং আপনার ও আপনার সঙ্গীর পরিবারের কোনো বিশেষ রোগের ইতিহাস আছে কি না সে সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হবে।

পাশাপাশি আপনি বর্তমানে কোনো ঔষধ সেবন করছেন কি না এবং কোনো রোগে আক্রান্ত আছেন কি না সেসব তথ্যও নেওয়া হয়। আপনি গর্ভবতী হওয়ার জন্য শারীরিকভাবে সুস্থ কি না সেটি যাচাইয়ের জন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। যেমন: রক্ত পরীক্ষা, প্রস্রাব পরীক্ষা, ওজন মাপা, রক্তচাপ মাপা এবং প্রয়োজনে জরায়ুমুখের অংশ সংগ্রহ করা (প্যাপ টেস্ট)। এর পাশাপাশি চিকিৎসক কর্তৃক আপনার পেট, তলপেট ও স্তনের শারীরিক পরীক্ষা করা হতে পারে।

এসবের মাধ্যমে আপনার কোনো শারীরিক সমস্যা থাকলে তা নির্ণয় করে সে অনুযায়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়।

২. পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যাভ্যাস

গর্ভকালীন সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর ও সুষম খাবার খান। পাশাপাশি দিনে কমপক্ষে পাঁচ পরিবেশন ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়ার চেষ্টা করুন। পাশাপাশি গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার সময় থেকে আপনি ফলিক এসিড ও আয়রন ট্যাবলেট খেতে পারেন। এর ফলে গর্ভে সন্তানের বেড়ে ওঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই উপাদানগুলোর কোনো ঘাটতি থাকবে না।

৩. স্বাভাবিক ওজন

গর্ভধারণের আগে শরীরের ওজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মাত্রায় নিয়ে আসুন। কেননা অস্বাভাবিক বেশি ওজন গর্ভপাতের আশংকা বাড়িয়ে দিতে পারে। খাদ্যাভ্যাস ও দৈনন্দিন জীবনে সক্রিয় থাকার মাধ্যমে আপনি আপনার ওজন স্বাভাবিক সীমার মধ্যে রাখতে পারেন।

৪. মানসিক সুস্থতা

মানসিক চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করুন। অতিরিক্ত চাপ গর্ভধারণের সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করতে পারে।[৫] নিজেকে মানসিকভাবে সুস্থ-সাবলীল রাখার জন্য শারীরিক ব্যায়াম, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম কিংবা মেডিটেশনের সাহায্য নিতে পারেন।

৫. পরিমিত ক্যাফেইন

ক্যাফেইনযুক্ত খাবার, অর্থাৎ চা-কফি পরিমিত পরিমাণে পান করুন। গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ করলে (দিনে আনুমানিক দুই কাপের বেশি) তা গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।

৬. ধূমপান ও মদ্যপান বর্জন

ধূমপান, মদ্যপান অথবা অন্য কোনো নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে থাকলে তা সম্পূর্ণভাবে বাদ দিন। এই সকল দ্রব্য নারী-পুরুষ উভয়ের প্রজনন ক্ষমতাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।[৬][৭] তাই আপনি ও আপনার সঙ্গী দুইজনই ধূমপান, মদ ও নেশা দ্রব্য পুরোপুরি এড়িয়ে চলুন।

৭. ইনফেকশনের ব্যাপারে সতর্কতা

গর্ভাবস্থায় গর্ভের শিশুর ক্ষতি হতে পারে এমন কোনো বিশেষ ধরনের ইনফেকশন থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে সতর্ক থাকুন। যেমন: রুবেলা। গর্ভাবস্থায় কাঁচা অথবা অর্ধসেদ্ধ মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ খেলে শরীরে নানান জীবাণু প্রবেশ করার ফলে আপনি ও আপনার গর্ভের শিশু ইনফেকশনে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই এসময়ে মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ ভালোভাবে সেদ্ধ করে খাবেন।