গর্ভপাত বা মিসক্যারেজ যেকোনো পরিবার বিশেষ করে গর্ভবতী মায়ের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি ঘটনা। তার ওপর গর্ভপাত নিয়ে সমাজে ঠিক-বেঠিক বিভিন্ন ধারনা প্রচলিত রয়েছে।
গর্ভপাতের ঝুঁকি কমানোর জন্য আপনি বিভিন্ন ধরনের উপদেশ কিংবা বিধিনিষেধ শুনে থাকতে পারেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে গর্ভপাত হয়ে যাওয়ার পরে, কোনো নির্দিষ্ট অভ্যাস অথবা ঘটনাকে গর্ভপাতের জন্য দায়ী করা হয়। তবে এরকম অনেক ধারণার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
গর্ভপাত নিয়ে ভুল ধারণা
গর্ভপাত হওয়ার সাথে কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি এমন ৬টি প্রচলিত বিষয় হলো—
- গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক পরিস্থিতি। যেমন: মানসিক চাপ অথবা হতাশা বা অবসাদ, গর্ভাবস্থায় আতঙ্কিত হওয়া অথবা হঠাৎ কোনো কারণে মানসিকভাবে ধাক্কা পাওয়া
- গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং ভারী কিছু ওপরে তোলা অথবা মাংসপেশি টানটান করে ব্যায়াম করা
- গর্ভাবস্থায় কর্মজীবন অব্যাহত রাখা। বিশেষ করে লম্বা সময় ধরে বসে অথবা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় এমন কোনো কাজে নিয়োজিত থাকা
- গর্ভাবস্থায় সহবাস করা
- গর্ভাবস্থায় বিমানে ভ্রমণ করা
- গর্ভাবস্থায় ঝাল খাবার খাওয়া
এসব কারণে গর্ভপাত হয় এমন ধারণার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
গর্ভপাত নিয়ে সাধারণ জিজ্ঞাসা
গর্ভপাত নানান কারণে হতে পারে। সাধারণত গর্ভের সন্তান অথবা মায়ের বিভিন্ন রোগ ও ত্রুটির কারণে গর্ভপাত ঘটে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গর্ভপাতের কারণ সুনির্দিষ্টভাবে বের করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
প্রথম ত্রৈমাসিকে সাধারণত গর্ভের শিশুর সমস্যার কারণে গর্ভপাত হয়ে থাকে। প্রথম ত্রৈমাসিকের পরের সময়গুলোতে মায়ের নানান রোগের কারণে গর্ভপাত হতে পারে।
এ ছাড়াও গর্ভের শিশুর চারপাশে কোনো ধরনের ইনফেকশন হলে ধীরে ধীরে পানি ভাঙতে শুরু হয়। এর ফলে কোনো ধরনের ব্যথা কিংবা রক্তপাত শুরু হওয়ার আগেই গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে।
আবার কখনো কখনো জরায়ুমুখ নির্দিষ্ট সময়ের বেশ আগে খুলতে শুরু করে। এ কারণেও গর্ভপাত হতে পারে।
পড়ুন: গর্ভপাতের লক্ষণ ও কারণ
প্রথম ত্রৈমাসিকে গর্ভপাতের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। প্রায় ১০০টি গর্ভপাতের মধ্যে ৮০টিই প্রথম ত্রৈমাসিকে হয়ে থাকে।[১]
গর্ভপাত হওয়ার সবচেয়ে পরিচিত লক্ষণ হলো যোনিপথ দিয়ে রক্ত যাওয়া। এ ছাড়া গর্ভপাত হলে আর যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে—
– তলপেট মোচড়ানো অথবা ব্যথা
– যোনি দিয়ে তরল নির্গত হওয়া
– যোনি দিয়ে মাংসের দলার মতো কিছু নির্গত হওয়া
– গর্ভধারণের লক্ষণগুলো কমে আসা। যেমন: বমি বমি ভাব, স্তনের আকার বৃদ্ধি
উল্লেখ্য, গর্ভপাতের কিছু লক্ষণ গর্ভাবস্থার অন্য সমস্যাতেও তৈরি হতে পারে। তাই গর্ভপাতের লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে আসলে গর্ভপাত নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রথমে দুই ধরনের পরীক্ষা করা হয়। যেমন—
– আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা
– রক্তে ‘বেটা এইচসিজি’ নামক হরমোনের পরিমাণ নির্ণয়
পড়ুন: গর্ভপাত নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা
সাধারণত গর্ভপাত একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং একবার গর্ভপাতের পর বার বার গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম (প্রায় ১-২%)।[২]
গর্ভপাতের ২ সপ্তাহের পর পুনরায় গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই গর্ভপাতের পর পরই পুনরায় গর্ভবতী হতে না চাইলে গর্ভপাত হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর জন্মনিয়ন্ত্রক পদ্ধতি ব্যবহার করা প্রয়োজন।
পড়ুন: গর্ভপাত-পরবর্তী জীবন
গর্ভপাতের প্রায় ২ সপ্তাহ পর ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বের হতে শুরু করে।
গর্ভপাত হওয়ার সবচেয়ে পরিচিত লক্ষণ হলো যোনিপথ দিয়ে রক্ত যাওয়া। এ ছাড়া গর্ভপাত হলে আর যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে—
– তলপেট মোচড়ানো অথবা ব্যথা
– যোনি দিয়ে তরল নির্গত হওয়া
– যোনি দিয়ে মাংসের দলার মতো কিছু নির্গত হওয়া
– গর্ভধারণের লক্ষণগুলো কমে আসা। যেমন: বমি বমি ভাব, স্তনের আকার বৃদ্ধি
পড়ুন: গর্ভপাতের লক্ষণ ও কারণ
গর্ভপাত হওয়ার সবচেয়ে পরিচিত লক্ষণ হলো যোনিপথ দিয়ে রক্ত যাওয়া। এই লক্ষণটি দেখা দেওয়ার সাথে সাথে হসপিটালে যেতে হবে। এ ছাড়াও গর্ভপাতের অন্যান্য লক্ষণগুলো দেখা গেলেও সাবধানতার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
দ্রষ্টব্য, গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি, মোলার প্রেগন্যান্সি, ইমপ্ল্যানটেশন ব্লিডিং এসব কারণেও যোনিপথে রক্ত যেতে পারে। এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি একটি ভয়াবহ জটিল সমস্যা। কেননা এর ফলে হঠাৎ করে শরীরের ভেতরে প্রচুর পরিমাণে রক্তপাত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এমনকি রোগী রক্তপাতের কারণে মৃত্যুবরণও করতে পারে। তাই এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া মাত্র যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে।
গর্ভপাতের ২ সপ্তাহ পরেই পুনরায় গর্ভবতী হওয়া সম্ভব। তবে একেক জনের ক্ষেত্রে সময় কিছু কম-বেশি লাগতে পারে। কিন্তু, গর্ভপাতের পর ১ বার মাসিক হলে গর্ভধারণের চেষ্টা করলে ভালো হয়। এতে করে আপনি কখন গর্ভধারণ করেছেন তা বুঝতে সুবিধা হয়। আপনার শারীরিক অবস্থা এবং পূর্বের গর্ভধারণের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে ডাক্তার আপনাকে পুনরায় কখন গর্ভধারণ করলে ভালো হয় সে বিষয়ে আরও ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন।
পড়ুন: গর্ভপাত-পরবর্তী গর্ভধারণ
গর্ভপাতের পর ৭ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত রক্তপাত হতে পারে।
মিসক্যারেজে পর পরই সহবাস করলে যোনিপথে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই গর্ভপাতের সব লক্ষণ পুরোপুরি সেরে যাওয়ার পর সহবাস করলে ভালো হয়। এজন্য গর্ভপাতের পর প্রায় ২ সপ্তাহ সহবাস এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়।
কিছু দূষিত খাবার খাওয়ার ফলে বিষক্রিয়া হলে গর্ভপাতের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। এমন কিছু খাবার হলো—
– অপাস্তুরিত দুধ অথবা দুগ্ধজাত খাবার
– কাঁচা মাংস
– কাঁচা অথবা আধা সিদ্ধ ডিম
তাই দুধ ভালো ভাবে ফুটিয়ে খেতে হবে। ডিম, মাছ, মাংস সবই ভালো মতো রান্না করে খেতে হবে।
অনেকক্ষেত্রে গর্ভপাতের কোনো নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে তা সবসময় প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না। তবে গর্ভপাতের ঝুঁকি কমানোর জন্য প্রি-কন্সেপশন চেকআপ, পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা, স্বাভাবিক ওজন নিয়ন্ত্রণ—এসব বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখা যেতে পারে।
পড়ুন: গর্ভপাত প্রতিরোধের উপায়
গর্ভপাতের পর কিছু দিন হালকা রক্তপাত হতে পারে। সাধারণত, গর্ভপাতের পর পুনরায় মাসিক হতে ৪ থেকে ৮ সপ্তাহ লেগে থাকে। তবে প্রথম দিকে মাসিক অনিয়মিত হতে পারে এবং মাসিক চক্র স্বাভাবিক হতে বেশ কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে।
পরিবারে কারও গর্ভপাত ঘটার ইতিহাস থাকলে তার বার বার গর্ভপাত হবার সম্ভাবনা থাকতে পারে। তবে এ সম্পর্কে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এই বিষয়ে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।[৩]
পুরুষের জিনগত কিছু ত্রুটির কারণে গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর জন্য জেনেটিক পরীক্ষা করা যেতে পারে।[৪]
একবার গর্ভপাতের পর বার বার গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কম। কাজেই পরবর্তী বাচ্চা নিতে সাধারণ গর্ভধারণের সময়ে যেসব সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় সেগুলো মেনে চলতে হবে। এক্ষেত্রে আপনি গর্ভপাতের ঝুঁকি কমানোর জন্য প্রি-কন্সেপশন চেকআপ, পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা, স্বাভাবিক ওজন নিয়ন্ত্রণ—এসব বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখবেন।
পড়ুন: গর্ভপাত-পরবর্তী গর্ভধারণ