গর্ভপাত নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা

গর্ভকালের প্রথম অথবা দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে যোনিপথে রক্তক্ষরণসহ গর্ভপাতের অন্যান্য লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে গেলে সাথে সাথেই মায়ের জন্য গর্ভপাতের চিকিৎসা শুরু করা হবে না। কেননা গর্ভপাতের কিছু লক্ষণ গর্ভাবস্থার অন্য কিছু সমস্যা থেকেও তৈরি হতে পারে। তাই প্রথমে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এসব লক্ষণগুলো গর্ভপাতের জন্য হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করা হয়।

এর পাশাপাশি এসব পরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভপাত হয়ে থাকলেও, গর্ভের ভেতরের সবকিছু পুরোপুরি বের হয়েছে কি না অথবা গর্ভের ভেতরে এখনো গর্ভকালীন টিস্যু অথবা গর্ভের শিশুর অবশিষ্টাংশ রয়ে গিয়েছে কি না সেসবও নিশ্চিত হওয়া যায়। গর্ভপাতের পর গর্ভের ভেতরের কিছু অবশিষ্টাংশ রয়ে গিয়ে থাকলে সেখান থেকে পরবর্তীতে রক্তক্ষরণ কিংবা ইনফেকশনও হতে পারে।

সাধারণত গর্ভপাতের লক্ষণ নিয়ে আসলে গর্ভপাত নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রথমে দুই ধরনের পরীক্ষা করা হয়। যেমন—

  • আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা
  • রক্তে ‘বেটা এইচসিজি’ নামক হরমোনের পরিমাণ নির্ণয় পরীক্ষা

এ ছাড়াও রক্তের কিছু সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হতে পারে। তবে তিন অথবা তিনের বেশিবার গর্ভপাত হয়ে থাকলে গর্ভপাতের নির্দিষ্ট কিছু কারণ খোঁজার জন্য আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে। তবে বেশিরভাগ সময়ে গর্ভপাতের কোনো নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।

আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা

আলট্রাসাউন্ড মা ও গর্ভের শিশুর জন্য একটি নিরাপদ পরীক্ষা। আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভে সন্তান আছে কি না, গর্ভের আকার, গর্ভের সন্তানের দৈর্ঘ্য এবং গর্ভে সন্তানের হৃৎস্পন্দন সচল রয়েছে কি না এই বিষয়গুলো দেখা হয়। এর ওপর ভিত্তি করে গর্ভাবস্থার অবসান ঘটেছে কি না অথবা ঘটতে যাচ্ছে কি না তা নির্ণয় করা হয়।

পরীক্ষাটি দুইভাবে করা যেতে পারে। যেমন—

  • পেটের আলট্রাসাউন্ড
  • ট্রান্সভ্যাজাইনাল বা যোনিপথে আলট্রাসাউন্ড

গর্ভপাত নিশ্চিত হওয়ার জন্য সাধারণত ট্রান্সভ্যাজাইনাল আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষাটি তুলনামূলক বেশি নির্ভরযোগ্য। এ ছাড়াও বার বার গর্ভপাত হতে থাকলে জরায়ুমুখে দুর্বলতা আছে কি না এবং জরায়ুর গঠনগত কোনো সমস্যা আছে কি না—এই বিষয়গুলোও পরবর্তী গর্ভাবস্থায় যোনিপথের আলট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে যাচাই করা হয়।

ট্রান্সভ্যাজাইনাল আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষায় যোনিপথ দিয়ে একটি লম্বা লাঠির মতো ট্র্যান্সডিউসার ঢুকানো হবে। এই ট্র্যান্সডিউসার দিয়ে পেটের ভেতরের দৃশ্য ধারণ করা হবে যা কম্পিউটারের মতো একটি মনিটরে ফুটে উঠবে। এতে করে তেমন কোনো ব্যথা অনুভব না করলেও কিছুটা অস্বস্তি লাগতে পারে।

তবে অনেকক্ষেত্রে যোনিপথে আলট্রাসাউন্ড পাশাপাশি পেটের আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করারও প্রয়োজন হতে পারে।

রক্ত পরীক্ষা

গর্ভপাত নির্ণয়ের জন্য রক্তে ‘বেটা এইচসিজি’ নামক একটি হরমোনের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। গর্ভাবস্থা চলাকালীন সময়ে মায়ের রক্তে এর মাত্রা গর্ভধারণ করেনি এমন নারীদের তুলনায় বেশি হয়। গর্ভপাত হয়ে গেলে এই মাত্রা আবার কমে আসে।

হরমোনের মাত্রা সঠিকভাবে যাচাই করার জন্য দুইবার এই পরীক্ষা করা হয়। প্রথম পরীক্ষার ৪৮ ঘন্টা পর দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করা হয়।

এ ছাড়াও গর্ভপাতের কারণে রক্তক্ষরণের পর মায়ের রক্তশূন্যতা হয়েছে কি না সেটা দেখার জন্য রক্তের হিমোগ্লোবিন দেখে নেওয়া হবে। একই সাথে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করে ফেলা হবে। কারণ রক্তক্ষরণ বেশি হলে মাকে আলাদা করে রক্ত দিতে হতে পারে।

মায়ের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ হলে তাকে গর্ভাবস্থার অবসানের সাথে সাথে ‘অ্যান্টি-ডি’ ইনজেকশন দেওয়া হবে। পরবর্তী গর্ভাবস্থায় আরএইচ ইনকমপ্যাটিবিলিটি নামক জটিলতা থেকে সন্তানকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এই ইনজেকশন দেওয়া হয়।

রক্ত পরীক্ষার জন্য হাতে সুই ফুটিয়ে একটি সিরিঞ্জে রক্ত সংগ্রহ করা হবে। তারপর সেটা পরীক্ষা করে দেখা হবে। ওপরের তিনটি বিষয় এক সিরিঞ্জ রক্ত দিয়েই সম্পন্ন করা যাবে।

তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অনেকসময় এসব পরীক্ষার পরও গর্ভপাত নির্ণয় করা কঠিন হয়ে যায়। যার ফলে আলট্রাসাউন্ড ও রক্ত পরীক্ষা কয়েকবার করে করতে হতে পারে। পাশাপাশি পরীক্ষা করার পর চিকিৎসা নেওয়ার আগে কত সময় অপেক্ষা করা হবে সেটিও বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

অন্যান্য পরীক্ষা

ক্যারিওটাইপিং

এটি জিনগত সমস্যা নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত একটি পরীক্ষা। যদি পর পর ৩ বার গর্ভপাত হয়, তাহলে তৃতীয় বার গর্ভপাতের পর সন্তানের শরীর থেকে কিছুটা মাংস সংগ্রহ করে এই পরীক্ষাটি করে দেখা হয়।

যদি শিশুর শরীরে কোনো জিনগত ত্রুটি পাওয়া যায় তাহলে মা ও বাবা দুইজনেরই ক্যারিওটাইপিং করার প্রয়োজন হতে পারে। এর ফলে পরবর্তীতে গর্ভাবস্থা সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটা তা নিয়ে মন্তব্য করা সম্ভব হতে পারে। সন্তান নেওয়ার অন্যান্য উপায় (যেমন: আইভিএফ) নিয়েও আলোচনা করা হবে।

তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই একজন ক্লিনিক্যাল জিন বিশেষজ্ঞ অথবা ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার চেষ্টা করুন।

রক্তের ‘অ্যান্টি-ফসফোলিপিড অ্যান্টিবডি’ ও ‘লুপাস অ্যান্টি কোয়াগুলেন্ট’ নির্ণয়

এটি একটি রক্ত পরীক্ষা যার মাধ্যমে ‘অ্যান্টি-ফসফোলিপিড অ্যান্টিবডি’ ও ‘লুপাস অ্যান্টি কোয়াগুলেন্ট’ নামক রক্তের বিশেষ দুইটি উপাদান নির্ণয় করা হয়। গর্ভপাত হওয়ার পর গর্ভপাতের কারণ খোঁজার উদ্দেশ্যে এই পরীক্ষা করার উপদেশ দেওয়া যেতে পারে।

অ্যান্টি-ফসফোলিপিড অ্যান্টিবডি রক্ত জমাট করে ফেলে যার ফলে গর্ভফুলে রক্ত ভালোভাবে পৌঁছায় না এবং এতে গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে।

পরীক্ষাটি করা হলে দুই বার করা হয়। প্রথমবার পরীক্ষা করার কয়েক সপ্তাহ পর দ্বিতীয়বার করা হয়ে থাকে।