পটাশিয়াম রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। শরীরে কোনো কারণে পানি আসলে অতিরিক্ত পানি বের করে দিতেও পটাশিয়াম সহায়তা করে। এ ছাড়া এটি ব্রেইন স্ট্রোক, হাড় ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিস ও কিডনিতে পাথর হওয়া প্রতিরোধে সহায়তা করে।
পটাশিয়াম কী
পটাশিয়াম দেহে পাওয়া খনিজগুলোর মধ্যে পরিমাণের দিক থেকে তৃতীয় স্থান দখল করে। পটাশিয়াম বা খনিজ লবণ আমাদের শরীরে ইলেক্ট্রোলাইট হিসেবে কাজ করে। ইলেক্ট্রোলাইট পানিতে মিশে দেহের বিভিন্ন শরীরবৃত্তীয় কাজ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ হলো—
- দেহের ভেতরে পানির ভারসাম্য রক্ষা করা
- কোষে পুষ্টি উপাদান প্রেরণ এবং কোষ থেকে বর্জ্য অপসারণ করা
- দেহের ক্ষার ও এসিডের মাত্রা (pH Level) ঠিক রাখা
- মস্তিষ্কে নার্ভ বা স্নায়ুর বার্তা আদান-প্রদানে সহায়তা করা
- পেশির সংকোচন নিয়ন্ত্রণ করা
একারণে শরীরে ইলেক্ট্রোলাইট এর পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কমে অথবা বেড়ে গেলে দেহের নানান গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাধা সৃষ্টি হয়। ইলেক্ট্রোলাইট এর ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য সঠিক পরিমাণে পটাশিয়াম গ্রহণ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে পটাশিয়াম এর গুরুত্ব
পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। এগুলো হলো—
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশী মানুষ মৃত্যুবরণ করে হৃদরোগে। উচ্চ রক্তচাপ থাকলে সেটি হার্ট অ্যাটাক সহ বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগ সৃষ্টি করতে পারে।
রক্তে উচ্চ মাত্রায় সোডিয়াম (লবণ) থাকলে সেটি রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে যাদের আগে থেকেই হাই প্রেসারের সমস্যা আছে তাদের ক্ষেত্রে রক্তচাপ আরও বেড়ে যেতে পারে। পটাশিয়াম রক্তে অতিরিক্ত সোডিয়াম কমিয়ে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
ব্রেইন স্ট্রোক প্রতিরোধ
মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হলে ব্রেইন স্ট্রোক হতে পারে। স্ট্রোক বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের বহু মানুষের মৃত্যু ও প্যারালাইজড বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়াসহ বিভিন্ন জটিলতার পেছনে দায়ী। গবেষণায় দেখা গেছে, পটাশিয়াম সমৃদ্ধ ডায়েট স্ট্রোক প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
হাড় ক্ষয় প্রতিরোধ
অস্টিওপোরোসিস বা হাড় ক্ষয়জনিত রোগে হাড় ফাঁপা ও ছিদ্রযুক্ত হয়ে পড়ে। এটি ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি স্বল্পতার সাথে সম্পর্কযুক্ত। ক্যালসিয়াম হাড়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মিনারেল। পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেলে শরীর থেকে ক্যালসিয়াম হারানোর পরিমাণ কমে যায়। ফলে অস্টিওপোরোসিস এর ঝুঁকি কমানো যায়।
কিডনিতে পাথর হওয়া প্রতিরোধ
গবেষণায় দেখা গেছে, পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার মাধ্যমে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি কমাতে পারে। যেহেতু অনেক ফল ও সবজিতে পটাশিয়াম থাকে, এটি সহজেই আমাদের ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
দেহে পানি ধরে রাখার পরিমাণ কমানো
শরীরে অতিরিক্ত পানি জমার কারণে পেট, মুখ, হাত-পা ও ফুসফুসসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে পানি আসতে পারে। সোডিয়াম (লবণ) দেহে পানি ধরে রাখতে সাহায্য করে।
উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম গ্রহণ করলে তা প্রস্রাব তৈরির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় এবং প্রস্রাবের সাথে সোডিয়াম বের করে দেয়। ফলে শরীরে পানি আসা কমে।
পটাশিয়াম যুক্ত খাবারের তালিকা
ফল ও শাকসবজি সহ অনেক খাবারই পটাশিয়াম সমৃদ্ধ। সবুজ শাক, বিনস, বাদাম ও দুগ্ধজাত খাবার পটাশিয়ামের ভালো উৎস। একজন প্রাপ্তবয়স্ক (১৯ বছর ও তদূর্ধ্ব) মানুষের প্রতিদিন ৩৫০০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম গ্রহণ করা উচিত। এই পটাশিয়ামের সম্পূর্ণটাই খাবার থেকে পাওয়া সম্ভব।
এখানে পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবারের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে—
ফল: শুকনো ফল (কিসমিস, শুকনো অ্যাপ্রিকট ইত্যাদি), কলা, অ্যাভোকাডো, কমলা, ডালিম, আঙ্গুর, ডাবের পানি, খেজুর, তরমুজ, মিষ্টিকুমড়া
শাকসবজি: বিন ও শিম জাতীয় খাবার (যেমন: মটরশুঁটি, বরবটি, কিডনি বিন, পিন্টো বিন, সয়াবিন), সবুজ বিট জাতীয় খাবার, শাক, ব্রকলি, পোরটোবেলো মাশরুম, আলু, মিষ্টি আলু, টমেটো (বিশেষ করে টমেটো পেস্ট), শসা
দুগ্ধজাত খাবার, মাছ-মাংস ও অন্যান্য: দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, দই বা ইয়োগারট, উদ্ভিজ্জ দুধ (যেমন: সয় ও অ্যালমন্ড), কাজু বাদাম, মুরগির মাংস, স্যামন মাছ, অন্যান্য সামুদ্রিক মাছ
দৈনন্দিন খাবার থেকেই দৈনিক পটাশিয়াম এর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। ফার্মেসি থেকে আলাদা করে পটাশিয়াম সাপ্লিমেন্ট কিনে খাওয়ার প্রয়োজন নেই।
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া পটাশিয়াম এর ঔষধ (সাপ্লিমেন্ট) সেবন মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম গ্রহণ পরিপাক নালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ফলে পেট ব্যথা ও ডায়রিয়া হতে পারে—এমনকি অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের মাধ্যমে মৃত্যুও ঘটাতে পারে।
তবে কোনো রোগীর রক্তে যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে পটাশিয়াম স্বল্পতা ধরা পরে তাহলে ডাক্তার উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম সাপ্লিমেন্ট সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন।
রক্তে পটাশিয়াম কমে অথবা বেড়ে গেলে কী হয়
শরীরের অন্যসব উপাদানের মতো পটাশিয়ামের পরিমাণেও ভারসাম্য ঠিক না থাকলে সেটি শরীরে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
রক্তে পটাশিয়াম কমে গেলে হাইপোক্যালেমিয়া অবস্থার সৃষ্টি হয়। অপরদিকে অতিরিক্ত পটাশিয়াম দেহে হাইপারক্যালেমিয়া অবস্থা তৈরি করে। এসবের কারণে দেহের কোষ, মস্তিষ্ক, পেশি ও হার্টের কাজ ব্যাহত হয়ে মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে।
তরলের ভারসাম্য রক্ষা
আমাদের শরীরের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগই পানি। এই পানির ৪০ ভাগ থাকে আমাদের কোষের ভেতরের তরলে। পটাশিয়াম কোষের ভেতরের পানির প্রধান ইলেক্ট্রোলাইট। এটি কোষের ভেতরে পানির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে সোডিয়াম কোষের বাইরের পানির প্রধান ইলেক্ট্রোলাইট। ফলে এটি কোষের বাইরের পানির পরিমাণ নির্ধারণ করে।
যদি পানি কোষের ভেতর থেকে বাইরে চলে যায় তখন কোষ শুকিয়ে যেতে পারে। আবার বাইরে থেকে কোষে অতিরিক্ত পানি প্রবেশ করলে কোষ ফুলে গিয়ে ফেটে পড়তে পারে। এসব কারণে পটাশিয়াম সহ সব ধরনের ইলেক্ট্রোলাইট সঠিক পরিমাণে গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী।
অপরদিকে শরীরে তরলের ভারসাম্য না থাকলে পানিশূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে। পানিশূন্যতার কারণে কিডনি ও হৃৎপিণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্মে বিভিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি হয়।
স্নায়ুতন্ত্রে বার্তা আদান-প্রদান
স্নায়ুতন্ত্র আমাদের মস্তিষ্ক থেকে শরীরের বিভিন্ন অংশে সংকেত প্রেরণ করে। এসব সংকেত পেশির সংকোচন-প্রসারণ, হৃদস্পন্দন, দেহের নানান রিফ্লেক্স সহ শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।
কোষের ভেতরে সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের চলাচল এর মাধ্যমে এসব সংকেত তৈরি হয়। রক্তে পটাশিয়ামের পরিমাণ কমে গেলে সেটি শরীরের সংকেত প্রেরণের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
পেশির সংকোচন নিয়ন্ত্রণ
স্নায়ুতন্ত্র শরীরের পেশির সংকোচন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। রক্তে পটাশিয়ামের পরিমাণে পরিবর্তন আসলে সেটি স্নায়ুর বার্তা পরিবহনে প্রভাব ফেলতে পারে, যা পেশির সংকোচনকে দুর্বল করে তোলে।
তবে মনে রাখতে হবে, পটাশিয়ামের পরিমাণ কমে কিংবা বেড়ে যাওয়া—উভয় ঘটনাই স্নায়ুকোষের ক্ষমতা বদলে দেওয়ার মাধ্যমে মস্তিষ্কের সংকেত বা নার্ভ ইম্পালসকে প্রভাবিত করতে পারে।
হার্টের সংকোচন-প্রসারণ নিয়ন্ত্রণ
পটাশিয়াম হৃৎপিণ্ড বা হার্টের সুস্থতা রক্ষার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। পটাশিয়াম কোষের ভেতরে-বাইরে যাতায়াত করে নিয়মিতভাবে হৃদস্পন্দন বজায় রাখতে সাহায্য করে।
রক্তে পটাশিয়ামের পরিমাণ খুব বেড়ে গেলে হার্ট দুর্বল হয়ে যেতে পারে, এমনকি হার্টের স্বাভাবিক আকার-আকৃতিতে পরিবর্তন আসতে পারে। এর ফলে হৃদপেশির সংকোচন দুর্বল হয়ে যেতে পারে এবং অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন বা অ্যারিদমিয়া সৃষ্টি হতে পারে।
একইভাবে রক্তে পটাশিয়ামের পরিমাণ কমে গেলে সেটিও হৃদস্পন্দনকে প্রভাবিত করে হার্টের স্বাভাবিক কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক না হলে হৃৎপিণ্ড ঠিকমত মস্তিষ্ক, কিডনি ও পেশিসহ সারাদেহে রক্ত সরবরাহ করতে পারে না। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দনের কারণে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে আকস্মিক মৃত্যু ঘটতে পারে।