চিনি খাওয়ার ফল

ফল, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারে প্রাকৃতিকভাবেই চিনি থাকে। তবে আমাদের দৈনন্দিন গ্রহণ করা চিনির বেশিরভাগই আসে বিভিন্ন খাবার ও পানীয়তে আলাদা করে যোগ করা চিনি বা ‘ফ্রি সুগার’ হতে। যেমন: বিস্কুট, মিষ্টি দই, চকলেট, মিষ্টি, মধু, চা-কফি ও কোমল পানীয়।

দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় যদি অনেক চিনি, অর্থাৎ ফ্রি সুগারযুক্ত খাবার ও পানীয় রাখা হয়, তাহলে স্থূলতা বা ওবিসিটি ও দাঁত ক্ষয়ের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

এই আর্টিকেলে বয়সভেদে কতটুকু চিনি খাওয়া উচিত এবং বেশি চিনি খাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে।

কতটুকু চিনি খাওয়া যাবে?

ফ্রি সুগার বা আলাদা করে চিনিযুক্ত খাবার সাধারণত খুব সুস্বাদু হয়। তবে এসবে তেমন পুষ্টি উপাদান থাকে না। এই ধরনের খাবারে প্রচুর ক্যালরি থাকায় এসব বেশী খেলে ওজন বেড়ে যায়। ফলে অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতার মতো সমস্যা হয়।

ফ্রি সুগার থেকে আসা ক্যালরির পরিমাণ প্রতিদিনের ক্যালরিসীমার ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। অর্থাৎ খাবার কিংবা পানীয়তে যোগ করা চিনি থেকে দৈনিক ক্যালরির ৫% এর বেশি গ্রহণ করা যাবে না।

হিসাবের সুবিধার্থে বয়সভেদে দৈনিক সুপারিশকৃত ফ্রি সুগারের মাত্রা—

বয়স সীমাপ্রতিদিনের সর্বোচ্চ চিনি গ্রহণের মাত্রা
প্রাপ্তবয়স্ক৩০ গ্রাম
৭ থেকে ১০ বছর২৪ গ্রাম
৪ থেকে ৬ বছর১৯ গ্রাম
৪ বছরের কমনা খাওয়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়

*১ চা চামচ চিনি = ৪ গ্রাম

কেক-বিস্কুট, চকলেট-মিষ্টি, কোমল পানীয় ও জুসের মতো খাবারগুলো চিনিবহুল। এগুলোতে কী পরিমাণ চিনি থাকে সেই সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা থাকে না। উদাহরণস্বরূপ, এক গ্লাস কোকে ৯ চা চামচ পর্যন্ত চিনি থাকতে পারে—যা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সুপারিশকৃত সারাদিনের চিনির সীমার চেয়েও বেশি। তাই এসব খাবার খাওয়ার পরিমাণ কমাতে হবে।

দুধ, আস্ত ফল ও সবজিতে প্রাকৃতিকভাবে যেই চিনি থাকে সেটিকে ফ্রি সুগার হিসেবে গণনা করা হয় না। এই ধরনের চিনি খাওয়া কমানোর প্রয়োজন নেই।

প্যাকেটজাত খাবারের মোড়কে উল্লেখ করা পুষ্টি উপাদানের তালিকায় ‘মোট চিনি’র হিসাবের মধ্যে ফ্রি সুগারের সাথে এসব চিনিও অন্তর্ভুক্ত করা থাকে।

পরিমিত চিনি খাবেন কেন?

আপনার ওজন ও চিনি

খাবারের মাধ্যমে শরীর যে শক্তি পায় সেটি ‘ক্যালরি’তে হিসাব করা হয়। আমরা যতটুকু ক্যালরি গ্রহণ করি এবং যেই পরিমাণ শক্তি খরচ করি—এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন। যতটুকু শক্তি ব্যয় করা হয় তার চেয়ে বেশি ক্যালরির খাবার খেলে এই অতিরিক্ত ক্যালরি ওজন বাড়িয়ে দেয়।

বেশি চিনি খেলে খাবারের মাধ্যমে শরীরে অতিরিক্ত ক্যালরি জমা হতে পারে। ফলে ওজন বেড়ে যায়। অতিরিক্ত ওজন হৃদরোগ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও কিছু ক্যান্সারসহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

স্বাস্থ্যকর ও সুষম ডায়েটের জন্য আমাদের গ্রহণ করা বেশিরভাগ ক্যালরি অন্যান্য খাবার থেকে আসা উচিত। যেমন: পূর্ণশস্য শ্বেতসার সমৃদ্ধ খাবার, ফল ও শাকসবজি। সম্ভব হলে উচ্চমাত্রায় ফ্রি সুগারযুক্ত খাবার খাওয়া একেবারে বাদ দিয়ে দিতে হবে।

দাঁত ক্ষয় ও চিনি

চিনি দাঁত ক্ষয় হওয়ার একটি প্রধান কারণ। দাঁত ক্ষয় প্রতিরোধ করতে হলে ফ্রি সুগারযুক্ত খাবার ও পানীয় খাওয়া কমাতে হবে। অর্থাৎ মিষ্টি, চকলেট, কেক, বিস্কুট,জ্যাম-জেলি ও কোমল পানীয় সীমিতভাবে গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি মধু, ফলের জুস, স্মুদি ও শুকনো ফলের মতো ফ্রি সুগারযুক্ত খাবার ও পানীয় কম খেতে হবে।

কিশমিশ, খেজুর ও আলুবোখারার মতো শুকনো ফল বা ড্রাই ফ্রুটসে চিনির পরিমাণ তুলনামূলক বেশি থাকে। তাই এগুলো দাঁত ক্ষয় করতে পারে। এগুলো আলাদা করে নাস্তা হিসেবে খাওয়া উচিত নয়।  তবে খাবারের সাথে কিংবা খাওয়ার পর ডেজার্ট হিসেবে অল্প পরিমাণ ড্রাই ফ্রুটস বেছে নেওয়া যেতে পারে।

ফল ও শাকসবজিতে প্রাকৃতিকভাবে যেই চিনি থাকে সেটি ফ্রি সুগার নয়। তাই সেসব চিনি থেকে দাঁত ক্ষয় হওয়ার সম্ভাবনা কম।

কিন্তু ফল ও সবজি রস বা ব্লেন্ড করা হলে চিনিগুলো মুক্ত বা ফ্রি সুগারে পরিণত হয়। এই ফ্রি সুগার দাঁতের ক্ষতি করতে পারে। পাশাপাশি ফল ও সবজিতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ফাইবার নষ্ট হয়ে যায়।

দিনে ১৫০ মিলিলিটার বা আধা গ্লাসের বেশি ফলের জুস কিংবা স্মুদি খাওয়া উচিত নয়। জুস বা স্মুদি খেতে হলে আহারের সাথে খাওয়া উচিত। এতে দাঁত ক্ষয় হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।

শিশুদের ক্ষেত্রে

দোকানের জুস, কোক-ফান্টার মতো কোমল পানীয় কিংবা চিনি দেওয়া ফলের রস শিশুদের খেতে দেওয়া একেবারেই উচিত নয়। এসব পানীয়ের বদলে বিশুদ্ধ পানি, দুধ অথবা চিনিমুক্ত পানীয় খাওয়াতে পারেন।

অতিরিক্ত চিনি খাওয়া কমানোর উপায়

আলাদা চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয়ের মধ্যে রয়েছে—

পানীয়খাবার
কোমল পানীয়কেক-পেস্ট্রি ও বিস্কুট
এনার্জি ড্রিংক ও স্পোর্টস ড্রিংকক্যান্ডি ও চকলেট
ফলের জুস ও ফ্রুট পাঞ্চডোনাট ও আইসক্রিম
চকলেট ড্রিংক। যেমন: চকলেট দুধ, কোল্ড কফি ও হট চকলেটদুধ-চিনি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন মিষ্টি জাতীয় খাবার। যেমন: মিষ্টি, লাচ্ছি, মিষ্টি দই ও ইয়োগার্ট, সেমাই ও পায়েস

সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস তৈরি করার জন্য এই ধরনের অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয় খাওয়া কমাতে হবে। এক্ষেত্রে নিচের পরামর্শগুলো সাহায্য করতে পারে—

পানীয়তে চিনি কমানো

  • কোমল পানীয়ের বদলে পানি, চিনি-ছাড়া লেবুর শরবত বা ডাবের পানি খেতে পারেন। চা-কফির মতো পানীয়তে চিনি খাওয়ার অভ্যাস থাকলে সেটি ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন। বিষয়টি খুব কঠিন মনে হলে আস্তে আস্তে চিনি কমাতে থাকুন—যতক্ষণ না চিনি সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দিতে পারেন।

খাবারে চিনি কমানো

  • রুটি ও পাউরুটির সাথে উচ্চমাত্রায় চিনিযুক্ত জ্যাম, মধু অথবা সিরাপ না খেয়ে, কলা ও অন্যান্য মৌসুমি ফল খেতে পারেন।
  • প্যাকেটের পুষ্টি উপাদানের তালিকা পড়ে কম চিনিযুক্ত খাবার কিনুন। খাবারের মধ্যে কম চিনিযুক্ত বিকল্পটি বেছে নেওয়ার চেষ্টা করুন।
  • বাসায় কেক, পুডিং অথবা অন্যান্য মিষ্টিজাতীয় খাবার তৈরি করার সময়ে চিনি কম দিয়ে তৈরি করুন।
  • কর্ণ ফ্লেক্স ও অন্যান্য ব্রেকফাস্ট সিরিয়ালের ক্ষেত্রে যেগুলোতে আলাদা করে মধু, চিনি অথবা চকলেট যোগ করা হয়নি সেগুলোকে বেছে নিন। আবার এগুলো খাওয়ার সময়ে চিনি যোগ না করে কলা অথবা আমের মতো কিছু ফল কেটে যোগ করে খেতে পারেন।

পুষ্টি উপাদানের তালিকা ও চিনি

বেশিরভাগ প্যাকেটজাত খাবারেই সাধারণত ফুড লেবেল বা পুষ্টি উপাদানের একটি তালিকা দেওয়া থাকে। খাবার কেনার সময়ে এই তালিকা পড়ে নিন। তালিকাটি প্যাকেটের সামনে কিংবা পেছনে—যেকোনো দিকেই থাকতে পারে। বেছে বেছে কম চিনিযুক্ত বিকল্পটি বেছে নেওয়ার চেষ্টা করুন।

খাদ্যপণ্যকে মোট চিনি বা চিনির পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে নিচের হিসাব অনুযায়ী উচ্চ অথবা নিম্ন মাত্রায় চিনিযুক্ত ধরা হয়—

  • উচ্চমাত্রা: প্রতি ১০০ গ্রাম খাবারে ২২.৫ গ্রামের বেশি
  • নিম্নমাত্রা: প্রতি ১০০ গ্রাম খাবারে ৫ গ্রাম অথবা তারচেয়ে কম

কোনো খাবারের প্রতি ১০০ গ্রামে মোট চিনির পরিমাণ ৫ গ্রাম থেকে ২২.৫ গ্রামের মাঝে থাকলে খাবারটিকে মাঝারি মাত্রায় চিনিযুক্ত ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ‘মোট’ চিনির পরিমাণ খাদ্যপণ্যটিতে সব ধরনের উৎস থেকে আসা চিনিকে অন্তর্ভুক্ত করে। অর্থাৎ দুধ, আস্ত ফল ও শাকসবজিতে প্রাকৃতিকভাবে যেই চিনি থাকে এবং বিভিন্ন খাবারে যেই ফ্রি সুগার থাকে—সবই ‘মোট’ চিনির অন্তর্ভুক্ত।

কোনো খাদ্যপণ্যে ফল অথবা দুধ থাকলে সেটি ফ্রি সুগারযুক্ত খাদ্যপণ্য থেকে বেশি স্বাস্থ্যকর হবে। এমনকি দুটি পণ্যের ‘মোট চিনি’ এর পরিমাণ সমান হলেও ফ্রি সুগারযুক্ত খাদ্যপণ্যটি কম স্বাস্থ্যকর।

প্যাকেটজাত খাবারে আলাদা করে চিনি যোগ করা হয়েছে কি না সেটি প্যাকেটের উপকরণের তালিকা থেকে জানা যায়। এক্ষেত্রে চিনি বা চিনি ছাড়া অন্য যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।

মোড়ক বা প্যাকেটের সংকেত

কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিনির মাত্রা নির্দেশ করার জন্য প্যাকেট বা মোড়কে নির্দিষ্ট রঙের কোড ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট খাদ্যপণ্যতে সুগারের মাত্রা সহজেই জানা যায়। এক্ষেত্রে রঙের কোডগুলো হলো—

  • লাল = উচ্চমাত্রা। এসব খাবারের প্রতি ১০০ গ্রামে ২২.৫ গ্রামের বেশি অথবা প্রতি পরিবেশনে ২৭ গ্রামের বেশি চিনি থাকে
  • হলুদ অথবা সোনালী = মাঝারি মাত্রা। এসব খাবারের প্রতি ১০০ গ্রামে ৫ গ্রাম থেকে ২২.৫ গ্রাম পর্যন্ত চিনি থাকে
  • সবুজ = নিম্নমাত্রা। এসব খাবারের প্রতি ১০০ গ্রামে ৫ গ্রাম অথবা তার চেয়েও কম চিনি থাকে

সবুজ ও হলুদ রঙের কোডযুক্ত খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। উচ্চমাত্রার চিনিযুক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।

রেফারেন্স ইনটেক

কোনো নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদানের দৈনিক সুপারিশকৃত মাত্রা প্যাকেটের গায়ে রেফারেন্স ইনটেক (RI) হিসেবে লেখা থাকতে পারে। এটি এক ধরনের গাইডলাইন। এতে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের জন্য প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় শক্তি ও নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদানের আনুমানিক পরিমাণ তুলে ধরা হয়।

সারাদিনে খাওয়া মোট চিনির রেফারেন্স ইনটেক হলো ৯০ গ্রাম, যার মধ্যে ৩০ গ্রাম ফ্রি সুগার থেকে আসতে পারে। কিছু খাবারে থাকা চিনির পরিমাণ প্যাকেটের সামনে রেফারেন্স ইনটেক এর শতকরা অংশ (%) হিসেবে উল্লেখ করা থাকে।