হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ

হার্ট অ্যাটাক একটি জরুরি অবস্থা। আপনার বা আপনার পরিবারের কারও হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে যেতে হবে।

হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে মনে হলে দেরি না করে হাসপাতালে যেতে হবে। লক্ষণগুলো নিয়ে সন্দেহ থাকলেও চিকিৎসা নিতে দ্বিধা করা ঠিক নয়। কারণ অন্য কোনো রোগের কারণে লক্ষণগুলো দেখা দিলে হাসপাতালে সেটিরও চিকিৎসা করা সম্ভব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকলে যদি সঠিক চিকিৎসা না নেওয়া হয় তাহলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—

১. বুকে ব্যথা: বুকের মাঝখানে চাপ ধরার মতো ব্যথা হতে পারে। এছাড়া রোগীর বুকের মধ্যে কিছু চেপে বসে আছে অথবা কিছু আটকে (টাইট হয়ে) আসছে এমন অনুভূত হতে পারে

২. শরীরের অন্য জায়গায় ব্যথা: এই ব্যথা বুক থেকে হাতে চলে আসছে এমন মনে হতে পারে। সাধারণত বাম হাতে এমন ব্যথা হয়। তবে এই ব্যথা উভয় হাতেই যেতে পারে। হাতের পাশাপাশি চোয়াল, ঘাড়, পিঠ ও পেটে ব্যথা চলাচল করতে পারে।

৩. মাথা ঘুরানো অথবা মাথা ঝিমঝিম করা

৪. শরীরের ঘেমে যাওয়া 

৫. শ্বাসকষ্ট 

৬. বমি বমি ভাব অথবা বমি হওয়া

৭. প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে পড়া: রোগী অস্বাভাবিক অস্থিরতা অনুভব করবেন (প্যানিক অ্যাটাক) অথবা তিনি মারা যাচ্ছেন এমন মনে হবে।

কাশি অথবা শ্বাসপ্রশ্বাসের সময়ে শিস দেওয়ার মত শোঁ শোঁ শব্দ হওয়া

সাধারণত হার্ট অ্যাটাকে বুকে বেশ তীব্র ব্যথা হয়। কিন্তু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে অনেক নারী রোগীদের ক্ষেত্রে, এই ব্যথা বদহজম অথবা গ্যাস্ট্রিকের ব্যথার মতো মৃদু হতে পারে।

কেউ কেউ আবার একেবারেই ব্যথা অনুভব করেন না। ডায়াবেটিসের রোগী ও বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও এমনটি দেখা যায়।

এসব ক্ষেত্রে রোগীর আসলেই হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে কি না তা আনুষঙ্গিক লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহায্য নেওয়া হয়।

হাসপাতালে যাওয়ার পূর্বে করণীয়

রোগীর হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে মনে হলে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। হার্টের ওপরে চাপ এড়াতে হাসপাতালে পৌঁছানোর পূর্বের সময়টুকুতে রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। 

হাতের কাছে অ্যাসপিরিন (৩০০ মিলিগ্রাম) ট্যাবলেট থাকলে এবং রোগীর অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধে কোনো অ্যালার্জি না থাকলে হাসপাতালে পৌঁছানো পর্যন্ত আস্তে আস্তে চিবিয়ে ট্যাবলেটটি খেতে পারে।

অ্যাসপিরিন রক্ত পাতলা করে এবং হার্টে রক্ত সরবরাহ বাড়াতে সাহায্য করে।

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট

কিছু ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক হতে সৃষ্ট জটিলতার (ভেন্ট্রিকুলার অ্যারিদমিয়া) কারণে হৃৎস্পন্দন একেবারে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, হার্ট রক্ত পাম্প করা বন্ধ করে দিয়ে স্থবির হয়ে যেতে পারে। এই ঘটনাকে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বলা হয়ে থাকে। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—

  • রোগী শ্বাস নিচ্ছে না বলে মনে হওয়া
  • রোগীর সব ধরনের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া
  • রোগীর সাথে কথা বললে বা তার গায়ে সজোরে ধাক্কা দিলেও কোনো সাড়া না পাওয়া

যদি কারও কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হচ্ছে বলে মনে হয় তাহলে সাথে সাথে রোগীকে সিপিআর (কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন) দিতে হবে। হাতের কাছে আটোমেটেড ডিফিব্রিলেটর (এইডি) থাকলে সেটিও এক পর্যায়ে ব্যবহার করতে হবে। 

সিপিআর এর অংশ হিসেবে রোগীর বুকে নির্দিষ্ট নিয়মে চাপ প্রয়োগ করতে হয়। এভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া হার্ট পুনরায় চালু করা সম্ভব হতে পারে। ফলে সারা শরীরে আবার রক্ত সরবরাহ শুরু হয়।

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে সিপিআর দিয়ে আপনি একজন রোগীর জীবন বাঁচাতে পারেন। নিচের ভিডিও থেকে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট সম্পর্কে জীবন রক্ষাকারী কিছু তথ্য জেনে নিন।

সিপিআর দেওয়ার নিয়ম

সিপিআর এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো চেস্ট কমপ্রেশন। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের রোগীর জীবন বাঁচাতে বিশেষ পদ্ধতিতে বুকে চাপ প্রয়োগের পদ্ধতিকে চেস্ট কমপ্রেশন বলা হয়। চেস্ট কমপ্রেশন দেওয়ার জন্য ডাক্তার অথবা স্বাস্থ্যকর্মী হওয়ার প্রয়োজন নেই। একজন সাধারণ মানুষ সঠিকভাবে চেস্ট কমপ্রেশন শিখে নেওয়ার মাধ্যমে একজন রোগীর জীবন বাঁচাতে পারেন।

আমরা এখানে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের চেস্ট কমপ্রেশন দেওয়ার নিয়মগুলো তুলে ধরেছি—

  1. প্রথমে এক হাতের তালু আরেক হাতের ওপরে রাখুন। এবার উপরের হাতের আঙ্গুলের সাহায্যে নিচের হাত নিচের ছবির মতো করে ধরুন যেন জোরে চাপ দিতে পারেন।
  2. আপনার দুই হাত রোগীর বুকের ওপর দুই নিপলের মাঝামাঝি রাখুন। রোগীর বুকের ওপরে এমনভাবে ঝুঁকে আসবেন যেন আপনার কাঁধ এবং হাতের তালু একটা সোজা লাইন বরাবর থাকে। শরীরের পুরো ভর কাজে লাগিয়ে যত জোরে সম্ভব একাধারে চাপ দিতে থাকুন। এমনভাবে চাপ দিন যেন আপনার হাত সোজাসুজি কমপক্ষে ৫-৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত নিচে যায়।
  3. পর পর দুইবার চাপ প্রয়োগের মাঝে অল্প সময় ব্যবধান রাখুন। একবার চাপ দেওয়ার পরে খেয়াল রাখতে হবে পরের বার চাপ দেওয়া শুরু করার আগে রোগীর বুক যেন আগের অবস্থানে ফিরে আসে। প্রতি মিনিটে কমপক্ষে ১০০-১২০ টি চাপ দিন।
  4. অ্যাম্বুলেন্স না আসা পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ায় চাপ দিতে থাকুন। একজন চাপ দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেলে প্রয়োজনে অন্য কারোর সাথে জায়গা বদল করে নিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এই বদল করতে যেন বেশি সময় নষ্ট না হয়।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকার কারণে বর্তমানে মুখে শ্বাস না দিয়ে কেবলমাত্র হাতের চাপ দিয়ে কার্ডিও-পালমোনারি রিসাসিটেশন করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

অটোমেটেড এক্সটারনাল ডিফিব্রিলেটর (এইডি)

এই যন্ত্রটি একটি স্বয়ংক্রিয়, সহজে বহনযোগ্য ও নিরাপদ ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র। বেশিরভাগ উন্নত দেশে জনসমাগমস্থলে ফার্স্ট এইডের সরঞ্জামের সাথে এটি রাখা হয়।

এটি কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের সময় হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে। যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোগীর হৃৎস্পন্দন নজরে রেখে প্রয়োজনবোধে ইলেকট্রিক শক দিতে পারে।

আমাদের দেশে যন্ত্রটি সহজলভ্য নয়। তাই অফিস কর্তৃপক্ষকে বলে এবং প্রতিবেশীরা মিলে চাঁদা তুলে এই গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রটি কেনার ব্যবস্থা করতে পারেন।

অ্যানজাইনা ও হার্ট অ্যাটাক

হার্টে অক্সিজেনযুক্ত রক্তের সরবরাহ কমে গেলে কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। এসব লক্ষণ একত্রে অ্যানজাইনা নামক অবস্থার সৃষ্টি করে। এই অবস্থায় শরীরের অন্তর্নিহিত কোনো সমস্যার কারণে বুকে ব্যথা সহ বিভিন্ন লক্ষণ সৃষ্টি হয়। 

অ্যানজাইনা রোগীদের মধ্যেও হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। তবে অ্যানজাইনা রোগীদের ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো সাধারণত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করার সময়ে দেখা দেয় এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই লক্ষণগুলো চলে যায়। 

তবে মাঝে মাঝে অ্যানজাইনা রোগীদেরও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। তাই অ্যানজাইনা ও হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলোর পার্থক্য জেনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এসব পার্থক্য মনে রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো— অ্যানজাইনার লক্ষণগুলো ঔষধ সেবনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলোর ক্ষেত্রে এটি সম্ভব হয় না।

অ্যানজাইনা হলে ডাক্তার রোগীকে গ্লিসারাইল ট্রাইনাইট্রেট নামক একটি ঔষধ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এটি জিহ্বার নিচে রাখার ট্যাবলেট অথবা স্প্রে হিসেবে পাওয়া যায়। ঔষধটি ব্যবহারের ৫ মিনিটের মধ্যে অ্যানজাইনার লক্ষণগুলোর উন্নতি হয়। প্রথম ডোজে কাজ না হলে ৫ মিনিট পরে রোগী দ্বিতীয় ডোজ নিতে পারেন। দ্বিতীয়বারে কাজ না হলে আবারও ৫ মিনিট পর তৃতীয় ডোজ নেওয়া যায়।

তবে ১৫ মিনিটের মধ্যে তিনটি ডোজ নেওয়ার পরেও যদি ব্যথা না যায় তাহলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।