খুব স্বাভাবিকভাবেই গর্ভাবস্থায় আপনার শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়। আপনার শরীরের অন্যান্য অংশের মতো আপনার চামড়ায়ও বেশ কিছু পরিবর্তন হতে পারে। এর মধ্যে ফুসকুড়ি ও চুলকানি খুবই পরিচিত সমস্যা।
চামড়ায় ফুসকুড়ি বিভিন্ন কারণে হতে পারে। যেমন: অনেকের আগে থেকে একজিমা জাতীয় চর্মরোগ থাকার কারণে চামড়ার ফুসকুড়ি হতে পারে। অনেকের আবার গরম থেকে ঘামাচি কিংবা ছোটো ফুসকুড়ি হতে পারে। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতা থেকেও ফুসকুড়ি হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে শুধুমাত্র গর্ভাবস্থার কারণেই জীবনে প্রথমবার আপনার চামড়ার ফুসকুড়ি হচ্ছে।
গর্ভকালীন চামড়ার ফুসকুড়ি
গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তনের কারণে মায়েদের চামড়ায় বিভিন্ন পরিবর্তন আসতে পারে—যা সাধারণত আপনার ও আপনার গর্ভের শিশুর জন্য তেমন ক্ষতিকর নয়। এমন কিছু পরিচিত গর্ভকালীন চামড়ার ফুসকুড়ি হলো—
পলিমরফিক ইরাপশন
এ ধরনের ফুসকুড়ি সাধারণত গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকে দেখা যায় এবং প্রসবের কিছুদিন পরই সেরে যায়।[১]
এ ধরনের ফুসকুড়িতে চামড়ায় ছোটো, লাল লাল, ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়। যেটি অনেকটা এলার্জির মতো দেখায় এবং অনেক বেশি চুলকানি হতে পারে।
এই ফুসকুড়ি সাধারণত প্রথমে পেটে উঠে, এরপর সেখান থেকে উরু, নিতম্ব, কোমর ও স্তনে ছড়াতে পারে।[২]
যেসব মায়েরা ঝুঁকিতে থাকেন[৩]—
- যদি প্রথমবারের মতো গর্ভবতী হন
- যদি গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ওজন বাড়ে[৪]
- যদি গর্ভে যমজ বা দুই এর অধিক শিশু থাকে[৫]
করণীয়
- ফুসকুড়িগুলো ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন কিংবা নরম সুতি কাপড়ে বরফ জড়িয়ে ফুসকুড়ির উপর লাগাতে পারেন
- যতটুকু সম্ভব চুলকানো এড়িয়ে চলুন
- প্রয়োজনে ময়েশ্চারাইজার ক্রিম ব্যবহার করুন
- নরম, আরামদায়ক ও ঢিলেঢালা পোশাক পরুন যেন ফুসকুড়িতে বারবার ঘষা না লাগে
চিকিৎসা
পলিমরফিক ইরাপশন ৪ সপ্তাহ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে নিজ থেকেই সেরে যায়। অনেক ক্ষেত্রে অন্য কোনো লক্ষণ থাকলে সেটির চিকিৎসা নিতে হয়।
আপনার চুলকানির সমস্যা হলে, চিকিৎসক আপনাকে চুলকানির ঔষধ দিবেন। এ ধরনের ফুসকুড়ির জন্য চিকিৎসক সাধারণত মুখে খাওয়ার এন্টিহিস্টামিন জাতীয় ঔষধ এবং ত্বকে লাগানোর টপিকাল স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ দেন—যেটি ফুসকুড়ির চুলকানি কমায় এবং ফুসকুড়ি ছড়িয়ে পড়তে বাঁধা দেয়।
পেমফিগয়েড গেস্টশোনিসএটি
একটি বিরল সমস্যা। এ ধরনের ফুসকুড়ি সাধারণত গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ত্রৈমাসিকে দেখা যায়।[৬] আবার কখনো কখনো সন্তান জন্মদানের ঠিক পর পর এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।[৭] অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রসবের সপ্তাহখানেক হতে মাস তিনেকের মধ্যে এই সমস্যা কমে আসে।[৮] পরবর্তী গর্ভাবস্থায় এ ধরনের ফুসকুড়ি আবারও হতে পারে।
পেমফিগয়েড গেস্টশোনিস এর ফুসকুড়ি সাধারণত ব্লিস্টার বা ফোস্কার মতো হয়। এ ধরনের ফোস্কা প্রথমে নাভির চারপাশে বা পেটে দেখা দেয় এবং পরবর্তীতে জটিল ক্ষেত্রে সারা শরীরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।[৯] এর সাথে অনেক বেশি চুলকানি হতে পারে।
সতর্কতা
পেমফিগয়েড গেস্টশোনিস এর সাথে অকাল প্রসব কিংবা গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত হবার সম্পর্ক থাকতে পারে।[১০] এ ছাড়া জন্মের পর নবজাতকের শরীরেও এ জাতীয় ফোস্কা বা ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।[১১] তাই গর্ভাবস্থায় এ ধরনের ফুসকুড়ি দেখা গেলে নিয়মিত চর্মরোগ ও গাইনী ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে থাকার চেষ্টা করুন।
চিকিৎসা
সাধারণত স্টেরয়েড জাতীয় ক্রিম আর মুখে খাওয়ার এন্টিহিস্টামিন জাতীয় ঔষধ দিয়ে এর চিকিৎসা করা হয়। তবে খুব জটিল ক্ষেত্রে মুখে স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ খাওয়ারও প্রয়োজন হতে পারে।[১২] গর্ভাবস্থায় মুখে স্টেরয়েড সেবন নিরাপদ কি না তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি—তাই একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত মুখে স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ সেবন করা যাবে না।
প্রুরাইগো
এ ধরনের ফুসকুড়িগুলো ছোটো ছোটো এবং পোকার কামড়ের মতো দেখায়।[১৩] এক্ষেত্রে চুলকানিও হতে পারে। ধারণা করা হয় গর্ভাবস্থায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের ফুসকুড়ি দেখা যায়। প্রথমে অল্প কয়েকটি হয় এবং পরবর্তীতে সংখ্যায় বাড়তে থাকে। গর্ভাবস্থার যেকোনো সময়েই এই ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।[১৪]
এ ধরনের ফুসকুড়ি বেশ কয়েকমাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে এমনকি প্রসবের পরও কিছুদিন থাকতে পারে।[১৫]
চিকিৎসা
অন্যান্য চামড়ার ফুসকুড়ির মতোই এক্ষেত্রেও ঘরোয়া পদ্ধতিতে অস্বস্তি কমাতে পারেন। এর পাশাপাশি মশ্চারাইজার, চুলকানি দূর করার ক্রিম, মুখে খাওয়ার এন্টিহিস্টামিন, ত্বকে লাগানোর স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধও দিতে পারেন আপনার চিকিৎসক।
প্রুরাইটিক ফলিকুলাইটিস
এটি গর্ভাবস্থায় একটি বিরল সমস্যা। এ ধরনের ফুসকুড়ি সাধারণত গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় বা তৃতীয় ত্রৈমাসিকে, অর্থাৎ চতুর্থ থেকে নবম মাসের মধ্যে হয়ে থাকে।[১৬]
এ ধরনের ফুসকুড়ি শরীরের অনেক বেশি জায়গা জুড়ে ছড়ানো থাকে। এটি সাধারণত শরীরের মাঝ বরাবর, বুকে, ঘাড়ে, পেছনের দিকে, হাত ও পায়ে হয়ে থাকে যেটি কিছুটা লাল রঙের ব্রণের মতো দেখায়।
চিকিৎসা
প্রসবের দুই সপ্তাহ থেকে দুই মাসের মধ্যেই এ ধরনের ফুসকুড়ি সেরে যায়। এটির চিকিৎসায় মূলত ত্বকে লাগানোর ব্রণের ঔষধ ‘বেনজোইল পার অক্সাইড’ ব্যবহার করা হয়। কখনো কখনো চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মুখে খাওয়ার এন্টিহিস্টামিন এবং ত্বকে লাগানোর স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ দিতে পারেন।
ভাইরাল সংক্রমণ
গর্ভাবস্থার সাথে সম্পর্কহীন কারণ ছাড়াও নিচের ভাইরাল সংক্রমণের কারণে গর্ভাবস্থায় ফুসকুড়ি দেখা যায়—
- রুবেলা
- পারবো ভাইরাস বি ১৯
- মিজেলস
- ইপস্টেইন বার ভাইরাস
- সাইটোমেগালো ভাইরাস
- এন্টারোভাইরাস
- ভেরিসেলা ভাইরাস
চিকিৎসা
গর্ভাবস্থার যেকোনো সময় চামড়ায় ফুসকুড়ি দেখা গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আপনার আগে থেকেই ফুসকুড়ির কোনো সমস্যা থাকলে কিংবা গর্ভাবস্থার যেকোনো সময় ফুসকুড়ি আছে এমন কোনো অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলে—এসব বিষয়েও চিকিৎসককে সঠিকভাবে জানান।
চিকিৎসক আপনার ফুসকুড়ি দেখে এবং রক্ত পরীক্ষাসহ প্রয়োজনীয় পরীক্ষার পর আপনার চিকিৎসা করবেন।
ফুসকুড়ির সাথে আপনার চুলকানি হলে চুলকানি কমানোর জন্য চিকিৎসক বিভিন্ন ঔষধ দিতে পারেন। যেমন—
- ময়েশ্চারাইজার[১৭]
- মুখে খাওয়ার এন্টিহিস্টামিন
- ত্বকে লাগানোর ট্রপিকাল স্টেরয়েড
গর্ভাবস্থায় চুলকানির জন্য যে ধরনের ঔষধ সেবন করবেন না
অন্য সাধারণ সময় ফুসকুড়ির জন্য চিকিৎসক আপনাকে মুখে খাওয়ার স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ দিলেও, গর্ভাবস্থায় এসব ঔষধ মুখে খাওয়া আপনার জন্য নিরাপদ নয়। তাই এসময় আপনাকে শুধুমাত্র ত্বকে লাগানোর জন্য স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ দেওয়া হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় ফুসকুড়ির সমস্যা কমাতে নিচের ঘরোয়া উপায়ও অবলম্বন করতে পারেন—
- ফুসকুড়িগুলো সুগন্ধিবিহীন সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলুন
- ফুসকুড়িতে জ্বললে হালকা ভেজা নরম সুতি কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে পারেন
- আরামদায়ক পাতলা সুতির কাপড় পরুন, যেন বারবার ফুসকুড়িতে ঘষা না লাগে[১৮]
প্রতিরোধ
গর্ভাবস্থায় ফুসকুড়ির তেমন কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেই। তবে গর্ভাবস্থার সাথে সম্পর্কিত কারণে আপনার ফুসকুড়ি হলে প্রসবের পর পর কিংবা কিছুদিনের মাঝেই তা ঠিক হয়ে যাবে।
ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ফুসকুড়ি প্রতিরোধের জন্য নিচের উপায় অবলম্বন করে সংক্রমণ এড়িয়ে চলতে পারেন—
১. পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা মেনে চলুন: গর্ভাবস্থায় আপনার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা বিশেষভাবে জরুরি। এসময় খাবার আগে ও পরে, পায়খানা করার পর এবং অন্যদের ব্যবহার্য যেকোনো কিছু (যেমন: দরজার হাতল, লিফটের বাটন, টাকা) ধরার পর ভালো করে সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুয়ে নিন।
২. ভিড় ও অসুস্থ মানুষ এড়িয়ে চলুন: গর্ভাবস্থায় আপনার রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এসময় যেকোনো ধরনের অসুস্থ মানুষ এড়িয়ে চলুন। জনসমাগম পূর্ণ জায়গায় যাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৩. টিকা নিন: গর্ভাবস্থায় চিকিৎসক এর পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন টিকা নিলে সংক্রমণ অনেকটা এড়াতে পারবেন। গর্ভাবস্থায় নিচের টিকাগুলো গ্রহণ করা আপনার জন্য জরুরি—
- ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু ভ্যাক্সিন
- ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, পারটুসিস ভ্যাক্সিন বা ডিপিটি
- হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিন
- হেপাটাইটিস এ ভ্যাক্সিন
- নিউমোকক্কাল ভ্যাক্সিন
টিকা গ্রহণে বিশেষ সতর্কতা
গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন জীবিত ভাইরাস থেকে তৈরি হওয়া টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্ক হোন। মিসেলস, মাম্পস ও রুবেলার টিকা জীবিত ভাইরাস থেকে তৈরি হয়। গর্ভাবস্থায় এসব টিকা নিলে আপনার অকাল প্রসব বা গর্ভপাতের আশঙ্কা থাকে। কাজেই এসব টিকা নেওয়ার আগে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করে নিন।[১৯]
নিচের টিকাগুলোও গর্ভাবস্থায় নেওয়া নিরাপদ নয়—
- হিউমান প্যাপিলোমা ভাইরাস ভ্যাক্সিন
- চিকেন পক্স ভ্যাক্সিন[২০]
সাধারণ জিজ্ঞাসা
পেমফিগয়েড গেস্টশোনিসেরস ক্ষেত্রে আপনার অকাল প্রসবের ঝুঁকি থাকে এবং স্বাভাবিকের চেয়ে ছোটো সন্তান প্রসব হতে পারে বা শিশুর বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।[২১] এর ফলে কখনো কখনো প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল আপনার শিশুকে সঠিক পরিমাণে অক্সিজেন এবং পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করতে ব্যর্থ হতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনার গর্ভেই শিশুর মৃত্যু ঘটতে পারে বা নবজাতকের বিভিন্ন জটিলতা হতে পারে।[২২]
কিছু ক্ষেত্রে আপনার শিশুর শরীরেও আপনার মতো ব্লিস্টার বা ফোস্কা দেখা দিতে পারে।