হঠাৎ হাত থেকে কিছু ফসকে যাওয়া অথবা অসচেতনভাবে হোচট খাওয়া—এ ধরনের বেখেয়ালি ঘটনাগুলো অনেক গর্ভবতী নারীরই হয়ে থাকে। প্রথম দিকে অল্প থাকলেও গর্ভাবস্থার শেষ দিকে, বিশেষ করে শেষ তিন মাসে এ ধরনের সমস্যাগুলো অনেকের জন্যই ভোগান্তি তৈরি করতে পারে। কিছু সহজ উপায় মেনে চললে এ সমস্যাগুলো অনেকটাই প্রতিরোধ করা যায়।
গর্ভাবস্থায় বেখেয়ালি হয়ে যাওয়ার কারণ
গর্ভকালীন সময়ে আপনার মধ্যে শারীরিক ও মানসিক কারণে নানান রকম পরিবর্তন হয়। অনেকসময় এসব পরিবর্তন বেখেয়ালি বা ক্লামজি বোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এরকম কিছু পরিবর্তন হচ্ছে—
- অতিরিক্ত ওজন: গর্ভাবস্থার অতিরিক্ত ওজন আপনার জন্য ক্লান্তিদায়ক হতে পারে। এসময়ে আপনার স্তন ও পেটের আকার বড় হতে থাকার কারণে আপনার শরীরের ভারসাম্য ধরে রাখতে কষ্ট হতে পারে। পেটের আকার বড় হয়ে যাওয়ার কারণে অনেকক্ষেত্রে হাঁটার সময় পা না-ও দেখা যেতে পারে। ফলে অসাবধানতাবশত দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়তে পারে।[১]
- শারীরিক পরিবর্তন: গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে একটি হাড়ের সাথে আরেকটি হাড় সংযোগকারী লিগামেন্ট ঢিলা হয়ে হাড়গুলোর সন্ধি বা জয়েন্টে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে।[২] এ ছাড়া এসময়ে শরীরে পানি জমে হাত-পা ফুলে যেতে পারে। এসব কারণেও এসময় শরীরের ভারসাম্য ধরে রাখতে কষ্ট হতে পারে।
- ভুলোমনা হয়ে যাওয়া: গর্ভাবস্থায় ভুলে যাওয়া একটি কমন উপসর্গ। কোথায় কোন জিনিস আছে তা মনে করতে না পারার কারণেও হবু মায়েরা অনেকসময় বেখেয়ালি হয়ে যান।[৩]
- দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তন: গর্ভকালীন সময়ে কখনো কখনো চোখের দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তন আসার কারণেও আপনি অসাবধানতাবশত পড়ে যেতে পারেন।[৪]
- মাথা ঘুরানো: গর্ভাবস্থায় মাথা ঘুরানো কমন একটি উপসর্গ। কখনো কখনো গর্ভাবস্থায় মাথা ঘুরানোর কারণে ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এগুলো ছাড়াও জীবনযাত্রার মান ও অন্যান্য রোগের ওপরেও গর্ভাবস্থার এই বেখেয়ালি বোধ নির্ভর করে। অলস জীবনযাত্রা, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত বমিভাব—এগুলোর কারণেও বেখেয়ালি বোধ এবং হোচট খাওয়ার হার বেড়ে যায়।
সমস্যা প্রতিরোধে করণীয়
গর্ভাবস্থায় হঠাৎ ভারসাম্য হারানোর এত কারণ দেখে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। কিছু ঘরোয়া সমাধান মেনে সাবধান থাকলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনাই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
১. দৈনন্দিন কাজ ধীরেসুস্থে করুন
গর্ভাবস্থায় যে আপনার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে, এটা বুঝেই দৈনন্দিন কাজ করার চেষ্টা করুন। হাঁটার সময় খেয়াল করুন পথে কোথাও ভেজা, পিছলে অথবা উঁচুনিচু স্থান আছে কি না। হাতে কোনো জিনিস থাকলে সেটি খেয়াল করে চলুন। তাড়াহুড়া করে চলাফেরা করলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এজন্য দেখে ও বুঝে ধীরেসুস্থে চলাচল করার চেষ্টা করুন।
২. গর্ভাবস্থার উপযোগী হালকা ব্যায়াম বেছে নিন
শারীরিক ব্যায়াম গর্ভাবস্থায় পড়ে যাওয়া প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গর্ভাবস্থার উপযোগী হালকা ব্যায়াম মাংসপেশি শক্ত করে এবং ভারসাম্য রক্ষাতেও সাহায্য করে।[৫] হাঁটাহাঁটি, দৌড়ানো, জগিং অথবা সাঁতার কাটা—এ ধরনের ব্যায়াম এসময়ে করতে পারেন।
৩. গর্ভাবস্থার জন্য উপযোগী কোমরের বেল্ট ব্যবহার করুন
ভারসাম্য রক্ষার জন্য ম্যাটারনিটি সাপোর্ট বেল্ট ব্যবহার করা একটি কার্যকরী উপায়। এটি গর্ভাবস্থায় পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।[৬] এটি যেকোনো ফার্মেসি অথবা বড় সুপার মার্কেটে পেতে পারেন।
৪. ঝুঁকিপূর্ণ কাজ এড়িয়ে চলুন
ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজ দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। এজন্য গর্ভকালীন সময়ে এ ধরনের কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। যেমন: মই বেয়ে ওঠা, চেয়ারের ওপর উঠে কোনো কাজ করা। এ ধরনের কোনো কাজ করার সময়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য এ ধরনের কাজের প্রয়োজন হলে পরিবার অথবা কাছের কোনো মানুষকে করে দিতে বলুন।
৫. ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত সাবধান থাকুন
যেসব পরিস্থিতিতে ঝুঁকি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে, সেখানে অতিরিক্ত সাবধানতা মেনে চলাচল করুন। যেমন: সিঁড়ি দিয়ে ওঠা অথবা নামার সময় সবসময় রেলিং ধরে ওঠানামা করুন, অন্ধকার অথবা কম আলোর রাস্তায় চলাচল করবেন না।
আপনি আগে অতিরিক্ত ব্যায়াম ও খেলাধুলায় অভ্যস্ত থাকলেও গর্ভাবস্থার সময়টাতে ঝুঁকিপূর্ন খেলা কমিয়ে দিন। যেমন: ব্যাডমিন্টন, উঁচুনিচু স্থানে জগিং, ঘোড়ায় ওঠা, জিমন্যাস্টিকস—এ ধরনের খেলায় দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৬. আরামদায়ক জুতা বেছে নিন
অনেক নারীরই হিল জুতা পরতে ভালো লাগতে পারে। কিন্তু গর্ভকালীন সময়ে হিলজুতা অথবা পিছলে যেতে পারে এমন ধরনের জুতা পরা থেকে বিরত থাকুন। এগুলো চলাফেরার অসুবিধা করার সাথে সাথে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ায়। বরং এমন ধরনের জুতা বেছে নিন যাতে চলাফেরা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
৭. পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নিন
গর্ভাবস্থায় ক্লান্তি কমাতে রাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানোর চেষ্টা করুন এবং দিনেও প্রয়োজন অনুযায়ী বিশ্রাম নিন। এটি ক্লান্তির কারণে তৈরি হওয়া বেখেয়ালি বোধ কমাতে সাহায্য করবে।
৮. পায়ের গোড়ালির ব্যায়াম করুন
পায়ের গোড়ালির ফুলে যাওয়ার কারণে সমস্যা তৈরি হলে একটি সহজ ব্যায়াম করতে পারেন। এটি গোড়ালি ফুলে যাওয়া কমাতে সাহায্য করে। ব্যায়ামের নিয়ম জানতে আমাদের পায়ের গোড়ালির ব্যায়াম লেখাটি পড়ুন।
৯. সম্ভাব্য রোগের চিকিৎসায় ডাক্তারের পরামর্শ নিন
‘কার্পাল টানেল সিনড্রোম’ অথবা অন্য কোনো রোগের কারণে আপনি বেখেয়ালি হয়ে যাচ্ছেন বলে মনে হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ডাক্তার রোগ অনুযায়ী উপযুক্ত পরামর্শ দিয়ে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে পারবেন।
কখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত?
গর্ভাবস্থায় বেখেয়ালি হয়ে যাওয়া একটি কমন উপসর্গ। শুধুমাত্র এই উপসর্গ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার তেমন কারণ নেই সাধারণত। তবে যদি বেখেয়ালি হওয়ার সাথে সাথে বিশেষ কিছু লক্ষণ দেখা যায়, সেটি অন্য কোনো রোগের কারণবশত হতে পারে। এমন কিছু লক্ষণ হচ্ছে—
- প্রচন্ড মাথাব্যথা
- চোখে দেখতে সমস্যা হওয়া। যেমন: দৃষ্টি ঘোলা হয়ে যাওয়া বা চোখের সামনে আলোর ঝলকের মত দেখতে পাওয়া
- বমি হওয়া
- পাঁজরের হাড়ের ঠিক নিচে তীব্র ব্যথা
- শরীরের বিভিন্ন জায়গা (যেমন: পায়ের পাতা, গোড়ালি, মুখ ও হাত) হঠাৎ ফুলে যাওয়া
এগুলো প্রি-এক্লাম্পসিয়ার লক্ষণ হতে পারে। প্রি-এক্লাম্পসিয়া গর্ভাবস্থার জরুরি একটি অবস্থা। এজন্য এ ধরনের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
সাধারণ জিজ্ঞাসা
অন্যান্য সময়ের চেয়ে গর্ভাবস্থায় নারীদের পড়ে গিয়ে ব্যথা পাওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।[৭] এতে হবু মা ও শিশু উভয়েরই ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। হাড়, জয়েন্ট ও মাংসপেশিতে আঘাতের সম্ভাবনা থাকে। এ ছাড়াও শরীরের অভ্যন্তরীণ রক্তপাত, মাথায় আঘাত—এসব প্রসবসংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হতে পারে, এমনকি মা ও শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। এজন্য গর্ভাবস্থায় পড়ে যাওয়া থেকে সাবধান থাকা খুবই জরুরি।[৮][৯]
ভারসাম্য আগের মতো স্বাভাবিক হতে প্রসবের পর কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।[১০] ততদিন পর্যন্ত ওপরে বর্ণিত প্রতিরোধ উপায়গুলো অনুযায়ী সাবধান থাকা জরুরি।