শিশুদের জন্য ব্যথানাশক হিসেবে বহুল ব্যবহৃত একটি ঔষধ হলো প্যারাসিটামল। এটি প্রায়ই মাথাব্যথা, পেট ব্যথা, কানের ব্যথা ও সর্দিকাশির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া জ্বর কমাতেও সচরাচর প্যারাসিটামল ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
শিশুদের প্যারাসিটামল সাধারণত ট্যাবলেট ও সিরাপ হিসেবে পাওয়া যায়। এ ছাড়া পেডিয়াট্রিক ড্রপস, সাপোজিটরি (পায়ুপথ দিয়ে দেওয়ার ঔষধ) ও ইনজেকশন হিসেবেও এটি কিনতে পাওয়া যায়।
এই আর্টিকেলে ১২ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য প্যারাসিটামল সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ১২ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য প্যারাসিটামলের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্যারাসিটামল’ আর্টিকেলটি পড়ুন।
শিশুদের ক্ষেত্রে প্যারাসিটামলের ব্যবহার সংক্রান্ত মূল পাঁচটি তথ্য
- শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্যারাসিটামল রয়েছে। শিশুর বয়সের ওপর, এমনকি কখনো কখনো শিশুর ওজনের ওপর কোন শক্তিমাত্রার প্যারাসিটামল কত ডোজে খাওয়াতে হবে—সেটি নির্ভর করে। তাই শিশুকে প্যারাসিটামল খাওয়ানোর আগে সবসময় ঔষধের সাথে থাকা নির্দেশিকা ভালো করে পড়ে নিতে হবে।
- সাধারণত ট্যাবলেট অথবা সিরাপ খাওয়ানোর আধা ঘণ্টার মধ্যে শিশু কিছুটা সুস্থ বোধ করতে শুরু করে। সাপোজিটরি পুরোপুরি কাজ করতে এক ঘন্টা পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
- শিশুকে প্যারাসিটামল খাওয়ানোর সময়ে তাকে প্যারাসিটামল মেশানো অন্য কোনো ঔষধ দেওয়া যাবে না। কফ ও সর্দিকাশির কিছু ঔষধে প্যারাসিটামল মেশানো থাকে, তাই এগুলো খাওয়ানোর ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। এসব ঔষধ খাওয়ানোর আগে প্যাকেটের ভেতরে থাকা নির্দেশিকা ভালোভাবে পড়ে প্যারাসিটামল মেশানো আছে কি না সেটি দেখে নিতে হবে।
- প্যারাসিটামল ছোটো-বড় সবার ব্যথা ও জ্বরের চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত একটি ঔষধ। তবে অন্য সব ঔষধের মতো এটিও মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে সেবন করলে তা শিশুর জন্য বিপদজনক হতে পারে। তাই প্যারাসিটামল সহ সব ধরনের ঔষধ সবসময় শিশুদের নাগালের বাইরে রাখতে হবে।
- বাংলাদেশে প্যারাসিটামলের পরিচিত ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে নাপা, এইস, ফাস্ট, এটিপি, প্যারাপাইরল, পাইরালজিন, রিসেট, রেনোভা, ট্যামেন, এক্সেল ও এক্সপা।
শিশুকে কোন বয়সে কোন ধরনের প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে
শিশুদের ২ মাস বয়স থেকে সিরাপ খাওয়ানো যাবে এবং সাপোজিটরিও ব্যবহার করা যাবে। ৬ বছর বয়স থেকে শিশুকে ট্যাবলেট খাওয়ানো যায়। তবে ট্যাবলেট গিলতে সমস্যা হলে সিরাপ খাওয়ানো যেতে পারে।
২ মাসের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে সতর্কতা
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ২ মাসের কম বয়সী শিশুদের প্যারাসিটামল দেওয়া উচিত নয়।
নিচের পাঁচটি ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া শিশুকে প্যারাসিটামল খাওয়াবেন না—
- ১. শিশু বয়সের তুলনায় আকারে ছোটো অথবা ওজনে কম হলে
- ২. লিভার অথবা কিডনির সমস্যা থাকলে
- ৩. খিঁচুনি বা এপিলেপসি রোগের ঔষধ সেবন করলে
- ৪. যক্ষ্মা বা টিবি রোগের জন্য ঔষধ সেবন করলে
- ৫. ওয়ারফারিন নামক রক্ত পাতলা করার ঔষধ সেবন করলে
শিশুদের বিভিন্ন ধরনের প্যারাসিটামলের ডোজ
প্যারাসিটামল বিভিন্ন শক্তিমাত্রার ট্যাবলেট, সিরাপ, সাপোজিটরি ও ইনজেকশন হিসেবে ফার্মেসিতে পাওয়া যায়।
শিশুকে তার বয়স অনুযায়ী নির্দিষ্ট ডোজের ঔষধ খাওয়াতে হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় কম ডোজের ঔষধ প্রয়োজন হয়।
শিশুকে কোন ডোজে প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে সেটি নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
সিরাপের ডোজ
সাধারণত ৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের সিরাপ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। শিশুর বয়স ৬ বছরের বেশি হলেও যদি ট্যাবলেট গিলতে অসুবিধা হয় সেক্ষেত্রে সিরাপ খাওয়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
প্রতি চা চামচ সিরাপে পাঁচ মিলিলিটার (ml) বা ১২০ মিলিগ্রাম (mg) প্যারাসিটামল থাকে।
সাধারণত শিশুদের বয়স অনুযায়ী কতটুকু প্যারাসিটামল সিরাপ খাওয়াতে হয় সেটি নিচের তালিকায় তুলে ধরা হয়েছে—
বয়স | ডোজ | পরিমাণ (mg) |
---|---|---|
২ মাস (টিকা দেওয়ার পরে আসা জ্বর কমাতে) | আধা চা চামচ | ৬০ |
৩ মাস–১ বছরের আগ পর্যন্ত | আধা থেকে ১ চা চামচ | ৬০–১২০ |
১–৫ বছর | ১ থেকে ২ চা চামচ | ১২০–২৪০ |
৬–১২ বছর | ২ থেকে ৪ চা চামচ | ২৪০–৪৮০ |
এক ডোজ প্যারাসিটামল খাওয়ানোর কমপক্ষে চার ঘন্টা পরে পরবর্তী ডোজ খাওয়ানো যাবে।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
ঔষধ খাওয়ানোর সময়ে ঔষধের সাথে যেই চামচ অথবা কাপ দেওয়া হয় সেটিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ ঔষধ মেপে নিয়ে শিশুকে খাওয়াতে হবে। কখনও ঘরের কাজে ব্যবহৃত সাধারণ চা চামচ দিয়ে শিশুকে ঔষধ খাওয়াবেন না। এতে ঔষধের পরিমাণ ভুল হয়ে নানান জটিলতা দেখা দিতে পারে।
পেডিয়াট্রিক ড্রপস এর ডোজ
দুই মাসের কম বয়সী শিশুদের জন্য ভিন্ন শক্তিমাত্রার বিশেষ ধরনের তরল প্যারাসিটামল পাওয়া যায়। এগুলোকে ‘পেডিয়াট্রিক ড্রপস’ (Paediatric Drops) বলা হয়। দুই মাসের বেশি বয়সী শিশুদেরকেও এটি খাওয়ানো যাবে।
প্রতি মিলিলিটার (ml) পেডিয়াট্রিক ড্রপ–এ ৮০ মিলিগ্রাম (mg) প্যারাসিটামল থাকে।
বয়স অনুযায়ী পেডিয়াট্রিক ড্রপস এর ডোজগুলো নিম্নরূপ—
বয়স | ডোজ (ml) | পরিমাণ (mg) |
৩ মাস পর্যন্ত | ০.৫ | ৪০ |
৪–১১ মাস | ১.০ | ৮০ |
১ বছর–২ বছর হওয়ার আগ পর্যন্ত | ১.৫ | ১২০ |
২–৩ বছর | ২.০ | ১৬০ |
৪–৫ বছর | ৩.০ | ২৪০ |
এক ডোজ প্যারাসিটামল খাওয়ানোর কমপক্ষে চার ঘন্টা পরে পরবর্তী ডোজ খাওয়ানো যাবে।
ট্যাবলেট এর ডোজ
প্যারাসিটামলের একেকটি ট্যাবলেট সাধারণত ৫০০ মিলিগ্রাম শক্তিমাত্রার হয়ে থাকে। যদি শিশুকে এর চেয়েও কম ডোজে ঔষধ দিতে হয় তাহলে ট্যাবলেটটি ভেঙে নিয়ে প্রয়োজনীয় পরিমাণটুকু খাওয়াতে হবে।
সাধারণত ৬ বছরের চেয়ে বড় শিশুদের ট্যাবলেট সেবন করতে দেওয়া হয়।
৬ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের প্রতি ডোজে অর্ধেক থেকে একটি ৫০০ মিলিগ্রাম এর ট্যাবলেট সেবন করতে দেওয়া হয়। এভাবে ২৪ ঘন্টায় তিন থেকে চার বার প্যারাসিটামল খাওয়ানো যায়।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
শিশুকে ২৪ ঘন্টায় চার ডোজের বেশি প্যারাসিটামল দেওয়া যাবে না। শিশুর বয়স অনুযায়ী উপযুক্ত ডোজ বেছে নিতে হবে। একটি ডোজের কমপক্ষে চার ঘন্টা পরে পরবর্তী ডোজ সেবন করা যাবে।
সাপোজিটরি এর ডোজ
প্যারাসিটামল সাপোজিটরি ছোটো কাঠির মতো এক ধরনের ঔষধ যা শিশুর পায়ুপথ (পায়খানার রাস্তা) দিয়ে দিতে হয়।
যেসব শিশুর ট্যাবলেট অথবা সিরাপ গিলতে অসুবিধা হয় তাদের ব্যথা ও জ্বর কমাতে সাপোজিটরি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া শিশুর বারবার বমি হলেও প্যারাসিটামল সাপোজিটরি বেছে নেওয়া হয়।
বয়স অনুযায়ী সাপোজিটরি এর ডোজগুলো নিম্নরূপ—
বয়স | প্রতি ডোজ (mg) |
৩ মাস থেকে ১ বছরের কম | ৬০–১২৫ |
১ বছর থেকে ৫ বছরের কম | ১২৫–১৫০ |
৫ থেকে ১২ বছর | ২৫০–৫০০ |
জ্বর অথবা ব্যথা না কমলে ৪ থেকে ৬ ঘন্টা পর পরবর্তী ডোজ দেওয়া যাবে। ২৪ ঘন্টায় সর্বোচ্চ ডোজের সংখ্যা চারটি।
বিশেষ তথ্য
২–৩ মাস বয়সী শিশুদের টিকা দেওয়ার পর জ্বর আসলে ৬০ মিলিগ্রাম ডোজ এর সাপোজিটরি দেওয়া যাবে। প্রয়োজনে চার থেকে ছয় ঘন্টা পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া যাবে।
অতিরিক্ত ডোজে প্যারাসিটামল সেবনের ফলাফল
যদি আপনি ভুলবশত শিশুকে প্যারাসিটামলের একটি মাত্র অতিরিক্ত ডোজ দিয়ে থাকেন তাহলে পরবর্তী ডোজ দেওয়ার আগে অন্তত ২৪ ঘন্টা অপেক্ষা করুন।
জরুরি তথ্য
শিশু যদি কোনো কারণে প্যারাসিটামলের দুটি অতিরিক্ত ডোজ সেবন করে ফেলে তাহলে তাকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে অথবা নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
অতিরিক্ত প্যারাসিটামল সেবনের ফলাফল মারাত্মক হতে পারে এবং জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
নিকটস্থ হাসপাতালে অথবা চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সময়ে যেই প্যাকেট অথবা পাতা থেকে ঔষধ খাওয়া হয়েছে তাতে বাকি থাকা ঔষধগুলো সাথে করে নিয়ে যেতে হবে। প্যাকেট অথবা প্যাকেটের ভেতরে থাকা নির্দেশিকাও সাথে নিয়ে যাওয়া উচিত।
প্রয়োজনে সরকারি স্বাস্থ্য বাতায়নের ১৬২৬৩ নাম্বারে ফোন করে পরামর্শ নিন।
শিশুদের কীভাবে প্যারাসিটামল দিতে হবে?
আমরা সচরাচর ভরাপেটে প্যারাসিটামল খাওয়ার পরামর্শ পেয়ে থাকি। তবে প্যারাসিটামল খালিপেটে সেবন করাও নিরাপদ। তাই শিশুকে খালিপেটে অথবা ভরাপেটে—দুই অবস্থাতেই প্যারাসিটামল খাওয়ানো যাবে।
সিরাপ ও পেডিয়াট্রিক ড্রপস খাওয়ানোর নিয়ম
শিশুকে সিরাপ খাওয়ানোর আগে ১০ সেকেন্ড ধরে বোতলটি ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে নিতে হবে। এরপর ঔষধের সাথে থাকা চামচ অথবা কাপ কিংবা ড্রপারে নির্দিষ্ট পরিমাণ ঔষধ মেপে নিতে হবে।
ঔষধ খাওয়ানোর সময়ে কখনও ঘরে ব্যবহৃত সাধারণ চা চামচ ব্যবহার করবেন না—এতে ঔষধের পরিমাণ ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
শিশুর যদি ঔষধের স্বাদ ভালো না লাগে তাহলে ঔষধ খাওয়ানোর পরপরই তাকে দুধ অথবা ফলের রস খেতে দিন।
ট্যাবলেট খাওয়ানোর নিয়ম
ট্যাবলেট খাওয়ানোর সময়ে এক গ্লাস পানি, দুধ অথবা ফলের জুস দিন। এগুলো দিয়ে শিশুকে ট্যাবলেটটি গিলে ফেলতে বলুন। শিশু যেন ট্যাবলেট চিবিয়ে না খায় সেই বিষয়টি নিশ্চিত করুন।
সাপোজিটরি ব্যবহারের নিয়ম
প্যারাসিটামল সাপোজিটরি পায়ুপথ দিয়ে দিতে হয়। সঠিকভাবে দেওয়ার নিয়ম জানতে ঔষধের সাথে থাকা নির্দেশিকা ভালোভাবে পড়ে নিন।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
শিশুকে সঠিক ডোজে প্যারাসিটামল খাওয়ালে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবার সম্ভাবনা খুবই বিরল। বিশেষ কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে চিন্তিত হলে অথবা অস্বাভাবিক কিছু খেয়াল করলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
মারাত্মক অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন
বিরল কিছু ক্ষেত্রে প্যারাসিটামল সেবনের ফলে মারাত্মক অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন হতে পারে।
নিচের ৫টি লক্ষণের যেকোনো একটি দেখা দেওয়ার সাথে সাথে নিকটস্থ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যান—
- চামড়ায় চুলকানিসহ লাল লাল ফুসকুঁড়ি বা র্যাশ দেখা দিলে
- চামড়া ফুলে উঠলে অথবা ফোস্কা পড়লে কিংবা শরীরের কিছু জায়গা থেকে চামড়া উঠে আসার মতো অবস্থা হলে
- হাঁপানি রোগীদের মত শোঁ শোঁ শব্দ করে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হলে
- বুক অথবা গলা আঁটসাঁট হয়ে বা আটকে আসছে এমন অনুভব করলে
- কথা বলতে অথবা শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে সমস্যা হলে
- মুখ, ঠোঁট, জিহ্বা অথবা গলা ফুলে যেতে শুরু করলে
এখানে প্যারাসিটামলের সবগুলো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া উল্লেখ করা নেই। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ তালিকার জন্য ঔষধের সাথে থাকা নির্দেশিকা পড়ুন।
ভিন্ন ব্যথানাশক ঔষধের সাথে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা
শিশুদের ক্ষেত্রে প্যারাসিটামলের পাশাপাশি নিরাপদে ব্যবহারের উপযুক্ত একমাত্র ব্যথানাশক ঔষধ হলো আইবুপ্রোফেন।
তবে শিশুকে একসাথে একই সময়ে প্যারাসিটামল ও আইবুপ্রোফেন খাওয়ানো যাবে না।
কোনো বিশেষ কারণে দুটি ঔষধই একই সময়ে খাওয়াতে হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাওয়াতে হবে।
জ্বরের চিকিৎসায়
প্যারাসিটামল খাওয়ানোর এক ঘন্টা পরও যদি শিশুর জ্বর থাকে তাহলে তাকে আইবুপ্রোফেন দেওয়া যেতে পারে। যদি তাতে জ্বর কমে তাহলে প্যারাসিটামলের পরিবর্তে আইবুপ্রোফেনই চালিয়ে যেতে হবে।
আইবুপ্রোফেন সবসময় ভরাপেটে খাওয়াতে হয়। এটি কীভাবে ও কোন ডোজে দিতে হবে তা জানতে ঔষধের সাথে থাকা নির্দেশিকাটি ভালোভাবে পড়ে নিন।
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কখনোই জ্বরের চিকিৎসায় একবার প্যারাসিটামল ও আরেকবার আইবুপ্রোফেন ব্যবহার করবেন না।
কোনো অবস্থাতেই শিশুকে ২৪ ঘন্টায় সর্বোচ্চ অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি প্যারাসিটামল অথবা আইবুপ্রোফেন দেওয়া যাবে না।
প্যারাসিটামল ও আইবুপ্রোফেন দুটোই খাওয়ানোর পরেও যদি কোনো উপকার না হয় তাহলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
দাঁত ওঠার ব্যথাসহ সব ধরনের ব্যথার চিকিৎসায়
শিশুকে প্যারাসিটামল খাওয়ানোর ২ ঘন্টা পরেও যদি ব্যথা না সারে তাহলে আইবুপ্রোফেন দেওয়া যেতে পারে।
এতে কাজ হলে পর্যায়ক্রমে দিনে এক বেলায় প্যারাসিটামল ও অন্য বেলায় আইবুপ্রোফেন—এভাবে ঔষধ খাওয়াতে হবে। তবে কোনো অবস্থাতেই দুটো ঔষধ একসাথে খাওয়ানো যাবে না। একটি নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়ানোর জন্য এই দুটি ঔষধের মধ্যে কেবল একটি ঔষধ বেছে নিতে হবে।
শিশুকে দিনে কতবার ঔষধ খাওয়াতে হবে সেটি নির্ভর করবে শিশুর কী পরিমাণ ব্যথা হচ্ছে তার ওপর। এটি বুঝতে অসুবিধা হলে ডাক্তারের কাছ থেকে পরামর্শ নিন।
কোনো অবস্থাতেই শিশুকে ২৪ ঘন্টায় সর্বোচ্চ অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি প্যারাসিটামল ও আইবুপ্রোফেন দেওয়া যাবে না।
প্যারাসিটামল ও আইবুপ্রোফেন পর্যায়ক্রমে খাওয়ানোর পরও যদি ব্যথা না কমে তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এ ছাড়া শিশুর ব্যথার কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত না হতে পারলে সেই বিষয়েও ডাক্তারের সাথে আলোচনা করা জরুরি।
নিচের দুটি ক্ষেত্রে শিশুকে আইবুপ্রোফেন দেওয়া যাবে না—
- চিকেনপক্স হলে
- হাঁপানি বা অ্যাজমার সমস্যা থাকলে (ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত)
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কখনও ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুকে অ্যাসপিরিন দেওয়া যাবে না।
প্যারাসিটামলের সাথে প্যারাসিটামল মেশানো অন্যান্য ঔষধ সেবন
কোনো ঔষধের সাথে প্যারাসিটামল মেশানো থাকলে শিশুকে সেই ঔষধের পাশাপাশি আলাদাভাবে প্যারাসিটামল দেওয়া যাবে না। প্যারাসিটামলযুক্ত দুটি ভিন্ন ঔষধ একত্রে খেলে প্যারাসিটামলের ডোজ মাত্রাতিরিক্ত সীমায় পৌঁছে যাওয়ার, অর্থাৎ, ওভারডোজ হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
ফার্মেসিতে পাওয়া যায় এমন অনেক ঔষধের অন্যতম উপাদান হিসেবে প্যারাসিটামল ব্যবহার করা হয়। কফ ও সর্দিকাশির বিভিন্ন ঔষধে এভাবে প্যারাসিটামল মেশানো থাকে। তাই শিশুকে এসব ঔষধ দেওয়ার আগে ঔষধের সাথে থাকা নির্দেশিকা থেকে উপাদানগুলো ভালোমতো দেখে নিন।
প্যারাসিটামলের সাথে অন্যান্য ঔষধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা
বেশিরভাগ ঔষধের সাথে নিরাপদে প্যারাসিটামল সেবন করা যায়। এমনকি বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক সেবন চলাকালে প্যারাসিটামল সেবন করা নিরাপদ।
তবে কিছু শিশুর জন্য প্যারাসিটামল সেবন করা উপযুক্ত নয়। নিচের তিনটি ঔষধের মধ্যে কোনো একটি সেবন চলাকালে শিশুকে প্যারাসিটামল খাওয়ানোর প্রয়োজন হলে আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে—
- ১. খিঁচুনি বা এপিলেপসি রোগের ঔষধ
- ২. যক্ষ্মা বা টিবি রোগের ঔষধ
- ৩. ওয়ারফারিন নামক রক্ত পাতলা করার ঔষধ
হারবাল ঔষধ ও অন্যান্য সাপ্লিমেন্টের সাথে প্যারাসিটামল সেবন
শিশুকে যেকোনো ভেষজ বা হারবাল ঔষধ অথবা সাপ্লিমেন্ট দেওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
প্যারাসিটামল সংক্রান্ত সাধারণ জিজ্ঞাসা
প্যারাসিটামলের দুটি অন্যতম কাজ হলো ব্যথা উপশম করা এবং জ্বর কমিয়ে আনা।
ব্যথা উপশম: শরীরের কোনো অংশ কোনো কারণে ব্যথা হলে এই অনুভূতির সিগন্যাল মস্তিষ্কে পৌঁছে আমাদের ব্যথার অনুভব তৈরি হয়। নির্দিষ্ট কিছু রাসায়নিক এই ব্যথার বার্তা মস্তিষ্কে বহন করার কাজটি করে। প্যারাসিটামল এসব রাসায়নিকের বার্তা বহনের কাজে বাধা দেয়। এভাবে এটি ব্যথা উপশম করে।
জ্বর কমানো: মস্তিষ্কের একটি অংশ শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের কাজে নিয়োজিত। এই অংশের যেসব রাসায়নিক বার্তাবাহক থাকে সেগুলোর কাজে প্যারাসিটামল প্রভাব ফেলে এবং জ্বর বা শরীরের তাপমাত্রা কমিয়ে আনে।
প্যারাসিটামল ট্যাবলেট ও সিরাপ কাজ করতে প্রায় ৩০ মিনিট সময় লাগে। সাপোজিটরি কাজ করতে প্রায় ১ ঘন্টা সময় লাগে।
শিশুর ব্যথা যদি তিন দিনের বেশি সময় ধরে থাকে অথবা যদি প্রথমবারের মতো দাঁত ওঠার ব্যথায় প্যারাসিটামল খেয়েও ব্যথা উপশম না হয়, তাহলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
এক ডোজ প্যারাসিটামল খাওয়ার পর যদি শিশু বমি করে ফেলে তাহলে সেই ডোজ আবার দেওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে পরবর্তী ডোজের সময়ের জন্য অপেক্ষা করুন অথবা প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
শিশু যদি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট অথবা সিরাপ খেতে না পারে অথবা বার বার বমি করে দেয় তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সাপোজিটরি ব্যবহার করুন।
সাপোজিটরি দেওয়ার পরপর যদি শিশু আবার বমি করে তাহলে আরেকটি ডোজ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ বমি করে ফেললেও সাপোজিটরি ঠিকমতো কাজ করবে।
প্যারাসিটামল সেবন করার সময় শিশু স্বাভাবিক সব পানীয় ও খাবার খেতে পারবে।
শিশুকে খালিপেটে প্যারাসিটামল দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু আইবুপ্রোফেন কখনোই খালিপেটে দেওয়া যাবে না।
প্যারাসিটামল ও আইবুপ্রোফেন একই ধরনের ব্যথায় ব্যবহৃত হলেও এগুলো ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে কাজ করে। তাই কয়েক ধরনের ব্যথা উপশমের জন্য প্যারাসিটামল আইবুপ্রোফেনের চেয়ে বেশি কার্যকর।
সাধারণত মাথাব্যথা ও পেটব্যথাসহ বেশিরভাগ ব্যথার চিকিৎসায় প্যারাসিটামলকে সর্বোত্তম ব্যথানাশক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া শিশুর চিকেনপক্স থাকলে প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যায় কিন্তু আইবুপ্রোফেন ব্যবহার করা যায় না।
অন্যদিকে আইবুপ্রোফেন জ্বালাপোড়া বা প্রদাহ (লাল হয়ে যাওয়া অথবা ফুলে যাওয়া) কমাতে বেশি কার্যকর। যেমন: দাঁত ওঠার সময়ের ব্যথা অথবা দাঁতের ব্যথা।
শিশুর চিকেনপক্স হয়ে থাকলে তাকে আইবুপ্রোফেন দেওয়া যাবে না।
প্যারাসিটামল সিরাপ ফ্রিজে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। শিশুদের নাগালের বাইরে এবং তাপ ও সূর্যের আলো থেকে দূরে কোথাও রাখলেই যথেষ্ট।