গ্যাস্ট্রিক আলসার বা পেটের আলসারের চিকিৎসা কেমন হবে তা মূলত নির্ভর করে ঠিক কোন কারণে আলসারটি হয়েছে সেটির ওপর। সঠিক চিকিৎসা পেলে অধিকাংশ পেটের আলসারই সাধারণত এক থেকে দুই মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ সেরে ওঠে।
বেশিরভাগ আলসার চিকিৎসায় প্রথমে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর (পিপিআই) গ্রুপের ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। এগুলোকে আমরা সাধারণত গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ হিসেবে চিনি। যেমন: ওমিপ্রাজল ও ইসোমিপ্রাজল। পিপিআই পাকস্থলী হতে গ্যাস্ট্রিক এসিডের নিঃসরণ কমিয়ে দেয়, ফলে আলসার বা ক্ষতস্থানটি নিজে নিজে সেরে ওঠে।
নন স্টেরয়ডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস বা NSAIDs গ্রুপের ঔষধ (যেমন: ন্যাপ্রক্সেন, অ্যাসপিরিন, এসিক্লোফেনাক ও ডাইক্লোফেনাক) সেবনের ফলে আলসার হলে পিপিআই সেবন করতে হয়।
আপনি NSAIDs-জাতীয় ঔষধ সেবন চালিয়ে যাবেন কি না সেই বিষয়েও ডাক্তার আপনার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিবেন। প্রয়োজনে এসব ঔষধের পরিবর্তে প্যারাসিটামলের মতো বিকল্প প্রদাহনাশক বা ব্যথানাশক ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হতে পারে।
হেলিকোব্যাকটার পাইলোরি (H. pylori) ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ইনফেকশনের কারণে আলসার হয়ে থাকলে পিপিআই এর পাশাপাশি অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়।
কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তার পিপিআই জাতীয় ঔষধের বিকল্প হিসেবে ‘এইচ টু (H2) রিসেপ্টর ব্লকার’ গ্রুপের ঔষধ (যেমন: ফ্যামোটিডিন) সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন। কখনো কখনো এন্টাসিড জাতীয় ঔষধও দেওয়া হয়। এন্টাসিড বুক জ্বালাপোড়া ও গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা দ্রুত উপশম করে৷
নিয়মিত ঔষধ সেবনের ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ পরে আবার এন্ডোস্কোপি করে আলসারের স্থানটি পর্যবেক্ষণ করা হয়।
আলসারের ঔষধ খাওয়ার সময় কোনো বিশেষ নিয়ম মেনে চলার প্রয়োজন হয় না। তবে মশলাদার খাবার, ধূমপান, মদ্যপান ও দুশ্চিন্তা এড়িয়ে চললে তা আলসার সারাতে সহায়ক হতে পারে।
চিকিৎসা নিয়ে সেরে ওঠার পরেও পাকস্থলীতে আবার আলসার হতে পারে। তবে যে কারণে আলসার হয়েছিল তা নির্মূল করা সম্ভব হলে পরবর্তীতে আবার আলসারের সমস্যা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
পেটের আলসারের ঔষধ
১. প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর বা পিপিআই
পিপিআই-জাতীয় ঔষধগুলো মূলত পাকস্থলীতে এসিডের উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে কাজ করে। এতে আলসারের সাথে এসিডের সংস্পর্শ কমে যায়। ফলে ঘা দ্রুত সেরে ওঠে।
সাধারণত ৪ থেকে ৮ সপ্তাহ পর্যন্ত পিপিআই সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। পেটের আলসারের চিকিৎসায় সর্বাধিক ব্যবহৃত পিপিআই-এর মধ্যে রয়েছে—
- ওমিপ্রাজল
- ইসোমিপ্রাজল
- র্যাবেপ্রাজল
- প্যান্টোপ্রাজল
- ল্যানসোপ্রাজল
পিপিআই গ্রুপের ঔষধগুলোর মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। যেমন—
- মাথাব্যথা
- ডায়রিয়া অথবা কোষ্ঠকাঠিন্য
- বমি বমি ভাব
- পেটে ব্যথা
- মাথা ঘুরানো
- শরীরে র্যাশ (লালচে দানা বা চাকা) হওয়া
ঔষধ সেবন শেষ হওয়ার পর সাধারণত এই লক্ষণগুলোও চলে যায়।
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কিছুদিন পরপর অথবা দীর্ঘ সময় ধরে ‘গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ’ খেলে হজমের সমস্যা থেকে শুরু করে অস্টিওপোরোসিস (হাড় ক্ষয়) ও ভিটামিন বি ১২ এর অভাবজনিত রক্তশূন্যতা পর্যন্ত দেখা দিতে পারে।
২. অ্যান্টিবায়োটিক
হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি নামক ব্যাকটেরিয়ার ইনফেকশন থেকে আলসার হলে সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। সেই সাথে প্রোটোন পাম্প ইনহিবিটর জাতীয় একটি ঔষধ ও দেওয়া হয়। যেমন: ওমিপ্রাজল, পেন্টোপ্রাজল ইত্যাদি।
হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি ইনফেকশনের ক্ষেত্রে সাধারণত দুটি অ্যান্টিবায়োটিকের একটি কোর্স দেওয়া হয়। কোর্সে প্রতিটি অ্যান্টিবায়োটিক দিনে দুইবার করে মোট এক সপ্তাহ সেবন করতে হয়। অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে সাধারণত অ্যামক্সিসিলিন, ক্ল্যারিথ্রোমাইসিন ও মেট্রোনিডাজল ব্যবহার করা হয়। অ্যান্টিবায়োটিক এই ব্যাকটেরিয়াগুলোকে মেরে ফেলার মাধ্যমে বার বার আলসার হওয়া প্রতিরোধ করে।
অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ফলে মৃদু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে। যেমন—
- মাথা ঘুরানো
- বমি বমি ভাব বা বমি করা
- ডায়রিয়া
- মুখে ধাতব স্বাদ পাওয়া
- কোষ্ঠকাঠিন্য
অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পন্ন করার কমপক্ষে ৪ সপ্তাহ পরে পুনরায় H. pylori-এর উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। পেটে এই ব্যাকটেরিয়া থেকে গেলে ভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের সমন্বয়ে আরেকটি নতুন কোর্সে ঔষধ সেবন করতে দেওয়া হয়।
৩. এইচ২ রিসেপ্টর ব্লকার
এই গ্রুপের ঔষধগুলোর কার্যপদ্ধতি কিছুটা পিপিআই এর মতো। এগুলো গ্যাস্ট্রিক এসিডের উৎপাদন কমিয়ে আলসার সারাতে সাহায্য করে৷ পেটের আলসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কমন H2 রিসেপ্টর ব্লকার হলো ফ্যামোটিডিন, সিমেটিডিন ও নিজাটিডিন।
এই ঔষধগুলোতে সাধারণত তেমন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকে না। কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে নিচের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো দেখা দিতে পারে—
- ডায়রিয়া
- মাথাব্যথা
- মাথা ঘুরানো
- গায়ে র্যাশ (লালচে দানা বা চাকা) হওয়া
- ক্লান্তি
৪. এন্টাসিড ও অ্যালজিনেট
অ্যান্টিবায়োটিক, পিপিআই এবং H2 রিসেপ্টর ব্লকার সেবনের পর কাজ শুরু করতে কয়েক ঘন্টা সময় লাগে। তাই এসব ঔষধের পাশাপাশি আলসারের ব্যথার তাৎক্ষণিক চিকিৎসায় অনেক সময়ে এন্টাসিড-জাতীয় ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়।
এন্টাসিড পাচক রসের অম্লত্ব বা এসিডিটি কমিয়ে তৎক্ষণাৎ কিছু সময়ের জন্য আরাম দিতে পারে। তবে এটি দীর্ঘ সময়ব্যাপী ব্যথার ক্ষেত্রে কার্যকর নয়৷
কিছু কিছু এন্টাসিডে অ্যালজিনেট নামক একটি উপাদান থাকে, যা পাকস্থলীর গায়ে একটি প্রতিরক্ষা আবরণী তৈরি করে। এভাবে এসব এন্টাসিড আলসারের ব্যথা উপশমে সাহায্য করে। অ্যালজিনেটযুক্ত এন্টাসিড গুলো সাধারণত খাবারের পরে সেবন করলেই সবচেয়ে ভালো কাজ করে। ডাক্তার আপনার রোগের মাত্রা ও ধরণ বিবেচনা করে সঠিক এন্টাসিড বাছাই করবেন।
আলসারের জ্বালাপোড়া বা ব্যথা শুরু হলে তখন সেটি উপশমের জন্য এন্টাসিড সেবন করা হয়৷ এছাড়া গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে (যেমন: খাবার পরে অথবা রাতে শোয়ার আগে) ব্যথা শুরু হওয়ার আগেও এন্টাসিড সেবন করা যায়।
এই ঔষধগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে—
- ডায়রিয়া অথবা কোষ্ঠকাঠিন্য
- পেট ফাঁপা
- বায়ুর সমস্যা
- পেট কামড়ানো বা পেটে মোচড় দিয়ে ব্যথা করা
- বমি বমি ভাব অথবা বমি হওয়া
অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস এর ব্যবহার পুনর্বিবেচনা করে দেখা
নন স্টেরয়ডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস (NSAIDs) গ্রুপের ঔষধগুলো প্রদাহনাশক হিসেবে কাজ করে। যদি এসব ঔষধ দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারের ফলে পাকস্থলীতে আলসার হয়ে থাকে, তাহলে ডাক্তার এগুলো সেবন চালিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কি না তা বিবেচনা করে দেখবেন।
NSAIDsগুলো সাধারণ মানুষের কাছে ‘ব্যথার ঔষধ’ হিসেবে পরিচিত। এই জাতীয় ঔষধের মধ্যে বহুল ব্যবহৃত ৫টি ঔষধ হলো—
- আইবুপ্রোফেন
- অ্যাসপিরিন
- ন্যাপ্রোক্সেন
- ডাইক্লোফেন্যাক
- এসিক্লোফেন্যাক
এক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে আলসার সৃষ্টি করে না এমন ব্যথানাশক (যেমন—প্যারাসিটামল) সেবনের পরামর্শ দেওয়া হতে পারে। এছাড়া NSAIDs গ্রুপের ঔষধের মধ্যে ‘কক্স -2- ইনহিবিটর’ নামক কিছু ঔষধ আছে (যেমন: সেলেকক্সিব) যেগুলো সাধারণত আলসার সৃষ্টি করে না। বিকল্প হিসেবে এসব ঔষধও বেছে নেওয়া হতে পারে।
কিছু রোগের চিকিৎসার অংশ হিসেবে রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি কমাতে হয় (যেমন: হৃদরোগ)। রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধে কম ডোজে অ্যাসপিরিন সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। ডোজ কম হলেও অ্যাসপিরিন এক ধরনের NSAID, তাই পেটের আলসার হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই আলসারের রোগী এই ঔষধ সেবন করলে তা বন্ধ করা উচিত কি না সেটা ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে নিন।
অ্যাসপিরিন সেবন বন্ধ করা সম্ভব না হলে অ্যাসপিরিনের পাশাপাশি দীর্ঘ সময়ের জন্য পিপিআই বা H2 রিসেপ্টর ব্লকার সেবন করতে দেয়া হয়। ফলে পরবর্তীতে পুনরায় আলসার হওয়ার ঝুঁকি কমে আসে।
দীর্ঘদিন ধরে NSAIDs সেবনের ঝুঁকিগুলো জেনে রাখা জরুরি। দীর্ঘদিন ধরে এসব ঔষধ সেবন করতে থাকলে পরবর্তীতে বারবার আলসার হতে পারে। এছাড়া আলসারের মারাত্মক কিছু জটিলতাও (যেমন: পেটের ভেতরের অংশ থেকে রক্তপাত) দেখা দিতে পারে।