পাকস্থলীর আলসার বা গ্যাস্ট্রিক আলসারে সাধারণত বিশেষ জটিলতা দেখা যায় না। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব জটিলতা মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারে। এই জটিলতাগুলো এতটাই গুরুতর যে এগুলো থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
গ্যাস্ট্রিক আলসারের প্রধান জটিলতাগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- আলসার বা ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণ হওয়া
- আলসারের জায়গাটিতে পাকস্থলীর আস্তরণ ফুটো হয়ে যাওয়া—একে ডাক্তারি ভাষায় পারফোরেশন (Perforation) বলে।
- আলসারের কারণে পরিপাকনালীর ভেতর দিয়ে খাবারের চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া—একে বলা হয় গ্যাস্ট্রিক অবস্ট্রাকশন।
আলসার বা ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণ
পাকস্থলীর আলসারের সবচেয়ে কমন জটিলতা হলো পাকস্থলী বা পেটের ভেতরের অংশে রক্তপাত। একে অভ্যন্তরীণ রক্তপাত বা Internal Bleeding বলা হয়৷ পাকস্থলীর ভেতরে কোনো রক্তনালীর গায়ে কিংবা নালীর আশেপাশে আলসার হলে সেক্ষেত্রে এমন রক্তপাত হতে পারে।
এই রক্তপাতের ধরনে ভিন্নতা থাকে। কারো কারো ক্ষেত্রে একটানা অনেকদিন ধরে অল্প অল্প রক্তপাত হতে পারে। আবার কারো কারো আলসার থেকে হঠাৎ করেই অনেক বেশি রক্তক্ষরণ হতে পারে। এই দুই ধরনের রক্তপাতের ফলাফলও ভিন্ন হয়। যেমন—
অনেকদিন ধরে অল্প অল্প রক্তপাত হলে: এটি হয়ে রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া দেখা দিতে পারে। এর ফলে নিচের লক্ষণগুলো দেখা যায়—
- ক্লান্তি
- সহজেই হাঁপিয়ে ওঠা
- শ্বাসকষ্ট বা দম আটকে আসছে এমন অনুভব করা
- ত্বক ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া
- হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে যাওয়া—হার্টবিট এত দ্রুত হয়ে যেতে পারে যে রোগী নিজেই বুক ধড়ফড় করছে এমন অনুভব করবেন।
ক্রমাগত রক্তশূন্যতার উপসর্গ দেখা দিতে থাকলে ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। ডাক্তার যদি ধারণা করেন যে রোগীর পাকস্থলীর আলসার হয়েছে তাহলে তিনি কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরামর্শ দিবেন। প্রয়োজনে একজন গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করা হতে পারে। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আলসারের উপস্থিতি পেলে সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিবেন।
হঠাৎ অনেক বেশি রক্তপাত হলে: এক্ষেত্রে সাধারণত নিচের লক্ষণগুলো দেয়—
- বমির হওয়া ও বমির সাথে গাঢ় লাল, খয়েরি বা কফি দানার মতো রক্ত যাওয়া।
- কালচে, আঠালো, আলকাতরার মত পায়খানা হওয়া। আঠালো হওয়ায় রোগীর মল কমোড বা প্যানে লেগে থাকতে পারে। পানি ঢাললে বা ফ্লাশ করলে লাল রক্তের মতো পানি দেখা যেতে পারে।
এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে দেরী না করে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে যেতে হবে।
রক্তক্ষরণ সনাক্তকরণ ও চিকিৎসা
রক্তপাতের কারণ ও উৎস জানার জন্য এন্ডোস্কোপি করে দেখা হয়। এন্ডোস্কোপি এমন একটি পরীক্ষা যেখানে মুখের ভেতর দিয়ে বিশেষ উপায়ে ক্যামেরা প্রবেশ করিয়ে পেটের ভেতরের অংশ দেখা হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে পরিপাকতন্ত্রের ঠিক কোন অংশে রক্তপাত হচ্ছে তা নির্ণয় করা যায় এবং প্রয়োজনে ক্ষতস্থানের চিকিৎসা করে রক্তপাত বন্ধ করাও সম্ভব হয়।
কখনো কখনো এক্সরের সাহায্যে রক্তপাতের স্থান চিহ্নিত করা হয়। এরপর বিশেষ পদ্ধতিতে সার্জারি ছাড়া সেই আলসারটি মেরামতের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তবে রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলে পরবর্তীতে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।
রক্তপাতের ফলে যেই রক্তশূন্যতা দেখা দেয় তা পূরণের জন্য অনেক সময়ে রোগীকে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
আলসারের জায়গাতে পাকস্থলীর আস্তরণ ফুটো হয়ে যাওয়া
এই জটিলতাটি তুলনামূলকভাবে বিরল। এক্ষেত্রে পাকস্থলীর আবরণে যেই জায়গাটিতে আলসার হয়েছে সেখানে ছিদ্র বা ফুটোর মত হয়ে যায়৷ এই ঘটনাকে ডাক্তারি ভাষায় পারফোরেশন (Perforation) বলা হয়।
পারফোরেশন একটি মারাত্মক জটিলতা। পারফোরেশনের ফলে পাকস্থলীর ভেতরের ব্যাকটেরিয়াগুলো আলসারের ফুটো দিয়ে পাকস্থলীর বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। এভাবে এসব ব্যাকটেরিয়া পেটে ছড়িয়ে পড়ে পেটের ভেতরের আবরণের (Peritoneum) ইনফেকশন করতে পারে। পেটের আবরণের এই ইনফেকশনকে পেরিটোনাইটিস বলা হয়৷
পেরিটোনাইটিস হলে এই ইনফেকশন রক্তের মাধ্যমে খুব দ্রুত শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে কিডনি, ফুসফুস, লিভার, ব্রেইনসহ শরীরের একাধিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হতে পারে। এমনকি সময়মতো চিকিৎসা না করালে রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
পেরিটোনাইটিস এর সবচেয়ে কমন লক্ষণ হলো পেটে হঠাৎ করে ব্যথা শুরু হওয়া যা ক্রমশ খারাপের দিকে যেতে থাকে৷ এমন ব্যথা অনুভব করলে দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে যাওয়া জরুরি। পেরিটোনাইটিসকে একটি ইমারজেন্সি বা জরুরি অবস্থা হিসেবে গণ্য করা হয়। এই জটিলতা দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে।
পরিপাকনালীর ভেতর দিয়ে খাবারের চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া
কিছু ক্ষেত্রে পরিপাকনালীর যে অংশে আলসার হয়েছে সেই জায়গাটি প্রদাহের কারণে ফুলে যায় অথবা ক্ষত সেরে গিয়ে টিস্যু মোটা হয়ে যায়। এসব কারণে পরিপাকনালীর মধ্যে খাবারের চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়। একে গ্যাস্ট্রিক আউটলেট অবস্ট্রাকশন বলা হয়।
গ্যাস্ট্রিক আউটলেট অবস্ট্রাকশনের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- বারবার প্রচুর পরিমাণে বমি হওয়া। এর কারণ হলো পরিপাকনালীর ভেতর দিয়ে খাবারগুলো নিচে যেতে না পারায় সেগুলো উল্টোদিকে এসে বমির চাপ সৃষ্টি করে।
- সবসময় পেট ফাঁপা বা পেট ভরে আছে এমন বোধ করা
- স্বাভাবিকের চেয়ে কম পরিমাণে খেলেও পেট পুরোপুরি ভরে গেছে এমন অনুভূতি হওয়া
- কোনো প্রচেষ্টা ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া
পরিপাকনালীর কোনো অংশে আদৌ এমন বাধা সৃষ্টি হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য এন্ডোস্কোপি করা হতে পারে৷ পাকস্থলীতে প্রদাহের কারণে এই অবস্ট্রাকশন হয়ে থাকলে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর বা এইচ২ রিসেপ্টর ব্লকার দিয়ে এর চিকিৎসা করা যেতে পারে। এর ফলে প্রদাহ হওয়া অংশের সাথে পাকস্থলীর এসিডের সংস্পর্শ কমে এবং ফোলা কমে আসে।
ক্ষত সেরে গিয়ে টিস্যু মোটা হয়ে যাওয়ার কারণে অবস্ট্রাকশন হয়ে থাকলে অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে। তবে কখনো কখনো বিকল্প হিসেবে এন্ডোস্কোপির সময়ে নলের ভেতর দিয়ে ছোট একটি বেলুন ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এরপর অবস্ট্রাকশনের স্থানে বেলুন ফুলিয়ে জায়গাটি বড় করা হয়। ফলে আটকে থাকা জায়গাটি প্রসারিত হয় এবং পরিপাকনালীর মধ্যে পুনরায় খাবারের চলাচল সুগম হয়।