উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণসমূহ ও নির্ণয়ের পদ্ধতি

অনেকে ধারণা করেন, রক্তচাপ বেশি হলেই মাথা ধরা, ঘাড় ব্যথা, মাথা ঘুরানো বা বুক ধড়ফড় করার মতো লক্ষণ দেখা যাবে। তবে এ ধারণাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। উচ্চ রক্তচাপ হলে সাধারণত বিশেষ কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তাই কেউ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে কি না তা জানার কার্যকর উপায় হলো নিয়মিত রক্তচাপ মেপে দেখা।

কখন রক্তচাপ মাপবেন

সাধারণত চল্লিশোর্ধ সুস্থ ব্যক্তিদের প্রতি ৫ বছরে অন্তত একবার রক্তচাপ মেপে দেখার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে যাদের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে তাদের ক্ষেত্রে বছরে অন্তত একবার রক্তচাপ মেপে দেখা উচিত। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে সহজেই মারাত্মক নানান স্বাস্থ্য জটিলতা ও মৃত্যুঝুঁকি এড়ানো সম্ভব।

যাদের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি

  • যাদের পরিবারে নিকটাত্মীয় (যেমন: বাবা, মা, ভাই অথবা বোন) উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন
  • যাদের শরীরের ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি
  • যারা নিয়মিত শরীরচর্চা করেন না অথবা অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয় এমন কাজ করেন
  • যারা নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে ফল-মূল অথবা শাকসবজি খান না
  • যারা কিডনির রোগ, ডায়াবেটিস অথবা হৃদরোগে ভুগছেন

কোথায় রক্তচাপ মাপা যায়? 

বাড়িতে প্রেসার মাপার মেশিন থাকলে ঘরে বসেই রক্তচাপ মেপে দেখা যায়। তাছাড়া বেশিরভাগ ফার্মেসিতে রক্তচাপ মাপার ব্যবস্থা থাকে। হাসপাতাল ও ডাক্তারের চেম্বারেও রক্তচাপ মাপা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে স্বাস্থ্য বিষয়ক ক্যাম্পেইনে বিনামূল্যে রক্তচাপ মেপে নেওয়া যেতে পারে।

ব্লাড প্রেসার মাপার সঠিক নিয়ম

পূর্বে সাধারণত স্টেথোস্কোপ, আর্ম কাফ, পাম্প ও ডায়াল ব্যবহার করে রক্তচাপ মাপা হতো। তবে এখন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ও ডিজিটাল ডিসপ্লের প্রচলন বেড়ে গিয়েছে। ফলে রক্তচাপ মেপে দেখার কাজটিও অনেক সহজ হয়েছে।

নিজে নিজে রক্তচাপ মাপতে আপনার পছন্দ অনুযায়ী একটি ভালো মানের প্রেসার মাপার যন্ত্র বেছে নিন। এবার নিচের ৬টি ধাপ অনুসরণ করে রক্তচাপ মাপুন—

১. প্রেসার মাপার পূর্বপ্রস্তুতি: রক্তচাপ মাপার আগে ৫ মিনিট ধরে চেয়ারে শান্ত হয়ে বসে বিশ্রাম নিবেন। এই সময়ে কথা বলবেন না। 

২. বসার স্থান নির্বাচন করুন: প্রথমে একটা চেয়ারে সোজা হয়ে বসুন। চেয়ারের ক্ষেত্রে কাঠের শক্ত একটি চেয়ার বেছে নিন, যেখানে হেলান দেয়া যায় কিন্তু পিঠ সোজা হয়ে থাকে। সাধারণত ডাইনিং টেবিলের চেয়ারগুলো এমন হয়। নরম স্থান (যেমন: সোফায়) বসে রক্তচাপ মাপা উচিত নয়, এতে সঠিক ফলাফল নাও আসতে পারে।

৩. যেভাবে বসবেন: বসে থাকা অবস্থায় পায়ের পাতা দুটো মাটির সাথে সমান ভাবে রাখবেন। পা একটার উপর আরেকটা উঠিয়ে বসবেন না, এটি রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। 

৪. হাত যেভাবে রাখবেন: যেই হাতে রক্তচাপ মাপবেন, সেটা একটি টেবিলের ওপর অথবা চেয়ারের হাতলের ওপর রাখবেন। বাহু যেন আপনার হার্ট বরাবর থাকে। 

৫. প্রেসার মাপা: এরপর বাহুতে রক্ত সঞ্চালন সীমিত করার জন্য কাফ (Cuff) ফোলাতে হবে। কাফ হলো যন্ত্রের সেই অংশ যা বাহুর চারিদিকে মোড়ানো হয়। কাফ ফোলানোর সময়ে আপনার কিছুটা অস্বস্তি হতে পারে। ডিজিটাল মেশিনে সাধারণত বোতাম টিপেই কাফ ফোলানো যায়। স্বয়ংক্রিয় নয় এমন যন্ত্রে পাম্প করে কাফ ফোলাতে হয়।

৬. ফলাফল নির্ণয়: কাফের ভেতরে যে চাপ বাড়ানো হয়েছিল তা ধীরে ধীরে বাতাস ছেড়ে এবার কমিয়ে আনা হয়। এ সময়ে ডিটেক্টর স্বয়ংক্রিয়ভাবে রক্তনালীর ভেতরে স্পন্দন বা পালস সনাক্ত করতে পারে। ডিজিটাল ব্যতীত অন্যান্য মেশিনে স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করে এই স্পন্দন বুঝতে হয়।

ডিজিটাল মেশিনের ডিসপ্লেতে রক্তচাপ কত সেটি সাথে সাথে দেখা যায়। আর্ম কাফ, স্টেথোস্কোপ দিয়ে কেউ আপনার রক্তচাপ মেপে দিলে তার থেকে রক্তচাপ কত তা জেনে নিয়ে লিখে রাখুন। 

বাসায় নিজে নিজে ব্লাড প্রেসার মাপার আগে দুইটি জিনিস আপনার ডাক্তারের কাছ থেকে নিশ্চিত হয়ে নিন—

১. যে মেশিন ব্যবহার করবেন, সেটা ব্যবহার করে সঠিকভাবে রক্তচাপ মাপা যায় কি না

২. মেশিনের কাফটি আপনার জন্য সঠিক সাইজের কি নামেশিনের কাফের মাপ নির্ভর করবে আপনার হাতের মাপের ওপর। কাফ যদি বেশী বড় হয়, তাহলে রক্তচাপ সঠিক মাত্রার চেয়ে কম আসবে। আবার কাফ বেশি ছোট হলে ব্লাড প্রেসার আসল রিডিং-এর চেয়ে বেশি দেখাবে।

রক্তচাপের ‘রিডিং’ বা পরিমাপ বুঝবেন কীভাবে?

রক্তচাপ মাপার ক্ষেত্রে রক্ত মাপার যন্ত্র দ্বারা দুইটি সংখ্যা রেকর্ড করা হয়—

  • সিস্টোলিক প্রেসার বা চাপ: দুটি রিডিং এর মধ্যে বড় সংখ্যা বা ওপরের মানটি হলো সিস্টোলিক চাপ। হৃৎপিণ্ড থেকে প্রতি স্পন্দনে সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালনের সময়ে এই চাপ সৃষ্টি হয়।
  • ডায়াস্টোলিক প্রেসার বা চাপ: রিডিং দুটির মধ্যে ছোট সংখ্যা বা নিচের মানটি হলো ডায়াস্টোলিক চাপ। রক্ত সঞ্চালনের বিরুদ্ধে রক্তনালীর বাধা থেকে এই চাপের সৃষ্টি।

রক্তচাপকে মিলিমিটার (পারদ) বা mmHg এককে মাপা হয়। ধরে নেওয়া যাক আপনার রক্তচাপ ১২০/৮০ মিলিমিটার (পারদ)। তাহলে সিস্টোলিক চাপ হবে ১২০ এবং ডায়াস্টোলিক চাপ হবে ৮০।

মানুষের রক্তচাপ একে অপরের থেকে কিছুটা ভিন্ন হয়ে থাকে। একজনের জন্য যেই রক্তচাপ বেশি অথবা কম, তা অন্যজনের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হতে পারে। রক্তচাপ যদি ৯০/৬০ থেকে ১২০/৮০—এই সীমার মধ্যে থাকে তাহলে তা স্বাভাবিক রক্তচাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

প্রেসার কত হলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বলে? 

সাধারণত রক্তচাপ ১৪০/৯০ অথবা এর বেশি হলে হাই ব্লাড প্রেসার বা উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়। ডাক্তারি ভাষায় উচ্চ রক্তচাপকে হাইপারটেনশন বলে। ৮০ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে রক্তচাপ ১৫০/৯০ অথবা এর বেশি হলে উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়।

রক্তচাপের রিডিং যদি ১২০/৮০ থেকে ১৪০/৯০ এর মধ্যে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য দ্রুত সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে।

একবার রক্তচাপ মাপতে গিয়ে দেখা গেল আমার প্রেসার ১৫০/৯০। এর মানেই কী আমি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছি?

না। দিনের বিভিন্ন সময়ে রক্তচাপ বিভিন্ন রকম হতে পারে। আবার মানসিক পরিস্থিতির ওপরেও রক্তচাপ নির্ভর করে। এজন্য ওপরের নিয়মে স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক অবস্থায় রক্তচাপ মাপলে সঠিক ফলাফল পাওয়া যাবে।

আপনার উচ্চ রক্তচাপ আছে কি না জানতে যা করণীয়

দিনে অন্তত দুই বার রক্তচাপ মাপবেন। আদর্শ হল সকাল ও বিকালে খালি পেটে রক্তচাপ মাপা।

প্রতিবারে দুটি মান নিবেন। পরপর দুইবার রক্তচাপ মাপার মাঝে ১ মিনিট সময় রাখবেন। এভাবে দিনে দুইবার করে টানা ৭ দিন রক্তচাপ মেপে দেখবেন। একটি কাগজে বা ফোনে তথ্যগুলো লিখে রাখলে সবচেয়ে ভালো হয়।

ডাক্তার এসব তথ্য ব্যবহার করে আপনার গড় রক্তচাপ নির্ণয় করবেন এবং আপনি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত কি না তা নিশ্চিত করবেন। রক্তচাপ বেশি দেখালেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া সরাসরি ফার্মেসি থেকে ঔষধ কিনে খাওয়া শুরু করা ঠিক নয়।

পড়ুন: উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা