হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা

হার্ট অ্যাটাক এর ধরনের ওপর নির্ভর করে সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়।

হার্টে রক্ত সরবরাহকারী প্রধান রক্তনালীগুলোকে করোনারি ধমনী বলা হয়। হার্ট অ্যাটাক হলে করোনারি ধমনীতে বড় ধরনের বাধা বা ব্লকের সৃষ্টি হয়। এই ব্লকের কারণে হার্টের কেমন ক্ষতি হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে হার্ট অ্যাটাককে তিনটি প্রধান ধরনে ভাগ করা হয়—

  • এসটিই এমআই (ST Segment Elevation Myocardial Infarction)
  • নন-এসটিই এমআই (Non-ST Segment Elevation Myocardial Infarction)
  • আনস্টেবল অ্যানজাইনা (Unstable Angina)

১. এসটিই এমআই: এটি হার্ট অ্যাটাকের সবচেয়ে গুরুতর ধরন। এক্ষেত্রে করোনারি ধমনী পুরোপুরি ব্লক বা বন্ধ হয়ে হার্টের রক্ত সরবরাহে লম্বা সময় ধরে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে হার্টের বড় একটি অংশজুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। তাই হাসপাতালে ভর্তির পরে যত দ্রুত সম্ভব রোগীর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

২. নন-এসটিই এমআই: এক্ষেত্রে করোনারি ধমনী কেবল আংশিকভাবে ব্লকড বা বাধাগ্রস্ত হয়ে হার্টের তুলনামূলকভাবে ছোটো একটি অংশের ক্ষতি করে। এটি ‘এসটিই এমআই’ এর তুলনায় কিছুটা কম গুরুতর হতে পারে। তবে সময়মতো চিকিৎসা না পেলে রোগীর অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে পারে।

৩. আনস্টেবল অ্যানজাইনা: এই ধরনটি সবচেয়ে কম গুরুতর। এক্ষেত্রেও হার্টের নিজস্ব রক্ত চলাচল মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়, তবে হার্টের পেশীগুলোর স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। তবে এটিও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। তাই আনস্টেবল অ্যানজাইনাতেও দ্রুত যথাযথ চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

এসটিই এমআই এর চিকিৎসা পদ্ধতি অপর দুই ধরনের হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে কিছুটা ভিন্ন।

যদি একজন রোগী হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে আসে এবং ইসিজিতে এসটিই এমআই ধরা পড়ে, তাহলে করোনারি ধমনীর ব্লকের চিকিৎসা শুরু করা হবে। এজন্য প্রথমে রোগীর অবস্থা মূল্যায়ন করে এরপর ব্লকের চিকিৎসায় সঠিক পদ্ধতিটি বেছে নেওয়া হবে।

রোগীকে কোন পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেওয়া হবে সেটি লক্ষণগুলো কতক্ষণ আগে শুরু হয়েছে এবং কত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হবে তার ওপর নির্ভর করবে।

  • রোগী যদি লক্ষণ শুরু হওয়ার ১২ ঘন্টার মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছে তাহলে চিকিৎসার জন্য সাধারণত পিসিআই (প্রাইমারি পারকিউটেনিয়াস করোনারি ইন্টারভেনশন) পদ্ধতি বেছে নেওয়া হয়
  • লক্ষণ শুরু হওয়ার ১২ ঘন্টার মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছালেও চিকিৎসাকেন্দ্রে দ্রুত পিসিআই এর ব্যবস্থা করা সম্ভব নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে রোগীকে রক্তনালীর ভেতরে থাকা ব্লক বা জমাট বাঁধা রক্ত ভেঙে ফেলার ঔষধ দেওয়া হবে।
  • লক্ষণ শুরু হওয়ার পরে ১২ ঘণ্টা পার হয়ে গেলে রোগীর জন্য ভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি বেছে নেওয়া হতে পারে। বিশেষ করে যদি রোগীর অবস্থার উন্নতি হয় তাহলে এমন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।

এক্ষেত্রে অ্যানজিওগ্রাম বা করোনারি অ্যানজিওগ্রাফি নামক একটি পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে করোনারি ধমনীগুলোর অবস্থা দেখে রোগীর জন্য সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি নির্বাচন করা হয়। চিকিৎসাটি হতে পারে ঔষধ, পিসিআই অথবা বাইপাস সার্জারি।

  • রোগী পিসিআই পদ্ধতির জন্য উপযুক্ত না হলে রোগীকে রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধের জন্য অ্যান্টিপ্লাটিলেট গ্রুপের ঔষধ (যেমন: অ্যাসপিরিন ও ক্লপিডগরেল) সেবনের পরামর্শ দেওয়া হতে পারে।

প্রাইমারি পারকিউটেনিয়াস করোনারি ইন্টারভেনশন (পিসিআই)

পিসিআই হলো এসটিই এমআই এর ইমারজেন্সি চিকিৎসা পদ্ধতি। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ব্লক অথবা সংকুচিত হয়ে যাওয়া করোনারি ধমনীকে প্রসারিত করা হয়। যেই পদ্ধতিতে করোনারি ধমনী প্রসারিত করা হয় সেটির নাম ‘করোনারি অ্যানজিওপ্লাস্টি’।

পিসিআই এর জন্য প্রথমে করোনারি অ্যানজিওগ্রাফি করে রোগী পিসিআই পদ্ধতির জন্য উপযুক্ত কি না সেটি নির্ধারণ করা হয়।

করোনারি ধমনীতে রক্ত জমাট বেঁধে যেন আরও ব্লক বা বাধা সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য রোগীকে রক্ত পাতলা করার ঔষধ দেওয়া হতে পারে। যেমন: লো-ডোজ অ্যাসপিরিন।

পিসিআই এর পরে আরও কিছুদিন রোগীকে ঔষধ সেবন করা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

করোনারি অ্যানজিওপ্লাস্টি

করোনারি অ্যানজিওপ্লাস্টি একটি জটিল চিকিৎসা পদ্ধতি। এর জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসা কর্মীর দল ও বিশেষ সরঞ্জাম প্রয়োজন হয়। সব হাসপাতালে এসব ব্যবস্থা থাকে না।

বাংলাদেশে নির্দিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে অ্যানজিওপ্লাস্টি করা হয়। ঢাকার মধ্যে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট, বিএসএমএমইউ (পিজি হাসপাতাল), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনসহ কিছু হাসপাতালে তুলনামূলকভাবে কম খরচে এই সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে।

করোনারি অ্যানজিওপ্লাস্টিতে একটি ক্ষুদ্র টিউব বা নল রোগীর বাহু অথবা কুঁচকির একটি বড় রক্তনালীতে প্রবেশ করানো হয়। নলটির এক মাথায় হাতের আঙুলের আকারের একটি বেলুন (বেলুন ক্যাথেটার) লাগানো থাকে। এই বেলুন ক্যাথেটারকে রক্তনালীর ভেতর দিয়ে এক্স-রের সহায়তায় বাইরে থেকে দেখে দেখে হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত পৌঁছানো হয়।

ক্যাথেটারটি করোনারি ধমনীর ব্লকের জায়গায় এসে পৌঁছালে বেলুনটি ফোলানো হয়। এতে বন্ধ হয়ে যাওয়া জায়গাটি খুলে যায়।

জায়গাটিতে পুনরায় ব্লক সৃষ্টি হওয়া প্রতিরোধ করতে সাধারণত ধমনীর ভেতরে একটি নমনীয় ধাতব মেশ বা স্টেন্ট বসানো হয়। সচরাচর এই প্রক্রিয়াকে ‘রিং পরানো’ বলা হয়ে থাকে।

করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফট (সিএবিজি)

করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফট হার্টের এক ধরনের অপারেশনের নাম। একে সচরাচর বাইপাস সার্জারি অথবা ‘ক্যাবেজ’ বলা হয়ে থাকে।

কিছু রোগীর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু কারণে করোনারি অ্যানজিওপ্লাস্টি করা সম্ভব হয় না। তখন বিকল্প হিসেবে এই অপারেশন বেছে নেওয়া হতে পারে। যেমন—

  • যদি রক্তনালীগুলোর গঠন অস্বাভাবিক হয়
  • যদি একাধিক করোনারি ধমনীতে ব্লক ও সংকোচন থাকে
  • যদি করোনারি ধমনীতে অনেকগুলো জায়গা সংকীর্ণ হয়ে যায়
  • যদি রক্তনালী থেকে বেরিয়ে আসা অসংখ্য শাখা-প্রশাখাগুলোতেও ব্লক থাকে

এই অপারেশনে শরীরের অন্য কোনো স্থানের (সাধারণত বুক, পা অথবা বাহুর) রক্তনালীর কিছু অংশ নেওয়া হয়। এরপর এগুলোকে করোনারি ধমনীর সংকীর্ণ অথবা ব্লক হয়ে যাওয়া স্থানগুলোর ওপরে ও নিচে জুড়ে দেওয়া হয়।

নতুন তৈরি হওয়া এই রক্তনালীকে ‘গ্রাফট’ বলা হয়। এই ‘গ্রাফট’ রক্তনালীর সংকুচিত অথবা ব্লক হয়ে যাওয়া জায়গাটি এড়িয়ে এর পাশ দিয়ে বিকল্প পথে রক্ত চলাচলের ব্যবস্থা করে। ফলে হার্টের পেশীগুলোতে রক্ত সরবরাহ উন্নত হয় এবং হার্টের অক্সিজেন সরবরাহ বেড়ে যায়।

ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা

রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধে করণীয়

রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করার জন্য সাধারণত দুই ধরনের ঔষধ ব্যবহার করা হয়। এগুলো হলো—১) অ্যান্টিপ্লাটিলেট ও ২) অ্যান্টিকোয়্যাগুলেন্ট।

এসব ঔষধ সাধারণত ট্যাবলেট হিসেবে সেবন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এগুলো রক্তনালীর ভেতর দিয়ে রক্তের প্রবাহকে সহজ করে। ফলে রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা কমে আসে।

তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনোক্রমেই এ ধরনের ঔষধ সেবন করা যাবে না। কারও কারও ক্ষেত্রে এসব ঔষধ সেবনে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তাই রোগীর অবস্থা বিবেচনায় রেখে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক মাত্রায় ঔষধ সেবন করতে হবে।

জমাট বাঁধা রক্ত ভাঙার ঔষধ

জমাট বাঁধা রক্ত ভাঙার ঔষধগুলোকে থ্রম্বোলাইটিক বা ফাইব্রিনোলাইটিক বলা হয়। এসব ঔষধ সাধারণত ইনজেকশন হিসেবে রোগীকে দেওয়া হয়।

এই ঔষধগুলো রক্তের ফাইব্রিন নামের একটি উপাদান খুঁজে খুঁজে ভেঙে ফেলে। ফাইব্রিন এক ধরনের শক্ত প্রোটিন। এটি রক্তের চারপাশে এক ধরনের তন্তুময় জাল তৈরী করে। এই জালটি শক্ত হয়ে রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।

যেসব রোগীর ভবিষ্যতে পুনরায় হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি, তাদের থ্রম্বোলাইটিক বা ফাইব্রিনোলাইটিকের পাশাপাশি আরেক ধরনের ঔষধ দেওয়া হতে পারে। এগুলোকে বলা হয় ‘গ্লাইকোপ্রোটিন ২বি/৩এ ইনহিবিটর’।

এই ধরনের ঔষধ জমাট বাঁধা রক্তকে ভাঙে না। বরং রক্ত জমাট বাঁধার চলমান প্রক্রিয়ায় বাধা দেয়। এভাবে এটি ইতোমধ্যে জমাট বেঁধে যাওয়া রক্ত বা ব্লকটির আকারে আরও বড় হয়ে ওঠাকে প্রতিরোধ করে। রোগীর হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলো খারাপের দিকে যাওয়াকে প্রতিরোধ করতে এই ঔষধ কার্যকর ভূমিকা রাখে।

নন-এসটিই এমআই ও আনস্টেবল অ্যানজাইনার চিকিৎসা

ইসিজিতে নন-এসটিই এমআই অথবা আনস্টেবল অ্যানজাইনা ধরা পড়লে সাধারণত রক্ত পাতলা করার ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। যেমন: লো-ডোজ অ্যাসপিরিন।

কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ঔষধের মাধ্যমে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পরবর্তী চিকিৎসার অংশ হিসেবে করোনারি অ্যানজিওপ্লাস্টি অথবা করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফট করানোর পরামর্শ দেওয়া হতে পারে।