হার্ট অ্যাটাকের ফলে যেসব জটিলতা সৃষ্টি হয় সেগুলো মৃদু সমস্যা থেকে শুরু করে প্রাণঘাতী পর্যন্ত হতে পারে।
কারও কারও ক্ষেত্রে ‘মাইনর’ বা তুলনামূলকভাবে কম গুরুতর হার্ট অ্যাটাক হয়। যদিও ক্ষেত্রবিশেষে এটি মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারে, তবে এ ধরনের হার্ট অ্যাটাকের পরে সাধারণত তেমন জটিলতা দেখা দেয় না।
অন্যদের ক্ষেত্রে গুরুতর প্রকৃতির হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে। যা থেকে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। এসব ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিসরে চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। নিচে হার্ট অ্যাটাক পরবর্তী বিভিন্ন জটিলতা তুলে ধরা হয়েছে।
অ্যারিদমিয়া
অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দনকে অ্যারিদমিয়া (Arrhythmia) বলা হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
- খুব দ্রুত হৃৎস্পন্দন হওয়া (Supraventricular Tachycardia)
- খুব ধীর গতিতে হৃৎস্পন্দন হওয়া (Bradycardia)
- অনিয়মিতভাবে হৃৎস্পন্দন হওয়া (Atrial Fibrillation)
হার্ট অ্যাটাকের কারণে হার্টের পেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত পেশীগুলো হার্টের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণকারী বৈদ্যুতিক সিগন্যাল প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটায়। ফলে এ ধরনের অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন দেখা দিতে পারে।
কিছু অ্যারিদমিয়া আছে যেগুলো তেমন মারাত্মক হয় না। যেমন: ট্যাকিকার্ডিয়া (Tachycardia)। এসব অ্যারিদমিয়া হলে নিচের লক্ষণগুলোর মতো কিছু লক্ষণ দেখা দেয়—
- বুক ধড়ফড় করা
- বুকে ব্যথা
- মাথা ঘুরানো অথবা মাথা ঝিমঝিম করা
- ক্লান্ত লাগা
- শ্বাসকষ্ট
সাধারণত ঔষধ (যেমন: বেটা ব্লকার গ্রুপের ঔষধ) সেবনের মাধ্যমে এসব অ্যারিদমিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
আবার কিছু অ্যারিদমিয়া রয়েছে যেগুলো প্রাণঘাতী হতে পারে। যেমন—
- কমপ্লিট হার্ট ব্লক: এই ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক সিগনাল হার্টের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে ব্যর্থ হয়। ফলে হার্ট ঠিকমতো রক্ত সঞ্চালন করতে পারে না।
- ভেন্ট্রিকুলার অ্যারিদমিয়া: এই ধরনের অ্যারিদমিয়া হলে হার্ট প্রথমে খুব দ্রুত বিট বা পাম্প করতে শুরু করে। এরপর হঠাৎ হার্টে খিঁচুনির মতো অবস্থা শুরু হয়ে যায় এবং হার্ট কাজ করা একেবারেই বন্ধ করে দেয়। এই ঘটনাকে ‘সাডেন (আকস্মিক) কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ বলা হয়।
এ ধরনের মারাত্মক অ্যারিদমিয়া হার্ট অ্যাটাকের পরের প্রথম ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে মৃত্যুর একটি বড় কারণ।
তবে পোর্টেবল ডিফিব্রিলেটর নামক যন্ত্রটি আবিষ্কারের পর থেকে এই ধরনের অ্যারিদিমিয়ার কারণে রোগীদের মৃত্যুহার অনেক কমে গিয়েছে। এই যন্ত্রটি হার্টে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে পুনরায় স্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
ব্র্যাডিকার্ডিয়া এক প্রকার অ্যারিদমিয়া যেখানে খুব ধীর গতিতে হৃৎস্পন্দন হয়। গুরুতর ব্র্যাডিকার্ডিয়া হলে দীর্ঘদিন ধরে লক্ষণগুলোর পুনরাবৃত্তি হতে পারে। এসব লক্ষণের চিকিৎসায় পেসমেকার ব্যবহার করা হয়।
পেসমেকার এক প্রকার বৈদ্যুতিক যন্ত্র যা অপারেশন করে রোগীর বুকে বসানো হয়। এটি হৃৎস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক মাত্রায় আনতে সাহায্য করে।
হার্ট ফেইলিউর
হার্ট যখন শরীরে ঠিকমতো রক্ত সঞ্চালন করতে পারে না তখন সেই অবস্থাকে বলা হয় হার্ট ফেইলিউর। হার্ট অ্যাটাকের ফলে হার্টের পেশী ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরবর্তী জটিলতা হিসেবে হার্ট ফেইলিউর দেখা দিতে পারে। সাধারণত হার্টের বামদিকে (বাম নিলয়ে) হার্ট ফেইলিউর ঘটে থাকে।
হার্ট ফেইলিউরের লক্ষণগুলো হলো—
- শ্বাসকষ্ট
- ক্লান্ত লাগা
- শরীরে পানি আসার কারণে হাত-পা ফুলে যাওয়া
মূলত বিভিন্ন ঔষধ সমন্বয় করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে অপারেশনের মাধ্যমে হার্ট ফেইলিউর এর চিকিৎসা করা হয়।
কার্ডিওজেনিক শক
কার্ডিওজেনিক শক হার্ট ফেইলিউরের মতো একটি জটিলতা। তবে এটি হার্ট ফেইলিউরের চেয়েও গুরুতর। কার্ডিওজেনিক শক হলে হার্টের পেশীগুলো এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে হার্ট স্বাভাবিক শারীরিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ার জন্য দেহে যথেষ্ট পরিমাণ রক্ত সঞ্চালন করতে ব্যর্থ হয়।
কার্ডিওজেনিক শকের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- শ্বাসকষ্ট
- হৃৎস্পন্দন ও শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাওয়া
- ত্বক ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া
- হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া
- প্রস্রাব কমে যাওয়া অথবা একেবারেই প্রস্রাব না হওয়া
- মানসিক বিভ্রান্তি
এই অবস্থার চিকিৎসায় ভেসোপ্রেসর বা আইনোট্রোপ জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করা হতে পারে। এসব ঔষধ রক্তনালীকে সংকুচিত করে। ফলে রক্তচাপ বাড়ে এবং রক্ত সঞ্চালনে উন্নতি হয়।
কার্ডিওজেনিক শকের প্রাথমিক লক্ষণগুলোর চিকিৎসা করে রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল করা হয়। এরপর হার্টের কার্যকারিতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে।
অপারেশনে পারকিউটেনিয়াস করোনারি ইন্টারভেনশন (পিসিআই) এর পাশাপাশি একটি ছোটো পাম্প প্রবেশ করানো হতে পারে। পাম্পটির নাম ‘ইন্ট্রাএওর্টিক বেলুন পাম্প’। এটি হার্ট থেকে রক্তের প্রবাহ বাড়াতে সাহায্য করে।
আরেকটি বিকল্প হলো করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফট বা বাইপাস সার্জারি। এই অপারেশনে শরীরের অন্য কোনো জায়গার রক্তনালীর কিছু অংশ নিয়ে করোনারি ধমনীতে থাকা ব্লকের আগে-পিছে প্রতিস্থাপন করা হয়। এভাবে বিকল্প পথে রক্ত চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়।
হার্ট রাপচার
এটি হার্ট অ্যাটাকের তুলনামূলকভাবে বিরল তবে মারাত্মক একটি জটিলতা। এক্ষেত্রে হার্টের পেশী, দেয়াল অথবা ভেতরের ভালভগুলোর যেকোনোটি ছিঁড়ে বা ফেটে যেতে পারে।
হার্ট অ্যাটাকের ফলে হার্ট মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এই অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। সাধারণত হার্ট অ্যাটাক হওয়ার এক থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে এই জটিলতা দেখা দিতে পারে।
এক্ষেত্রে কার্ডিওজেনিক শকের অনুরূপ লক্ষণ দেখা দেয়। হার্ট রাপচারের চিকিৎসার জন্য সাধারণত ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হয়।
হার্ট রাপচারের পরে রোগীদের মৃত্যুহার অনেক বেশি। হার্ট রাপচার হয়েছে এমন রোগীদের আনুমানিক প্রতি দুইজনের মধ্যে একজন হার্ট রাপচার হওয়ার পাঁচ দিনের মাঝে মৃত্যুবরণ করেন।