ডায়াবেটিসের নানা স্বাস্থ্য জটিলতা ও করণীয়

আপনার যদি টাইপ ২ ডায়াবেটিস থাকে, তবে আপনাকে নিজের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং নিয়মিত ডাক্তারের চেকআপে থাকতে হবে। এর কারণ হলো, টাইপ ২ ডায়াবেটিস হলে আপনার অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতার ঝুঁকি বেড়ে যায়, অনেক সময় নীরবে, কোন লক্ষণ ছাড়াই এমন কিছু রোগ শরীরে বাসা বাঁধে যা আপনি বুঝতে পারেন না।

এই আর্টিকেলে ডায়াবেটিসের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতা সম্পর্কে আপনি জানতে পারবেন, সেই সাথে আপনার করণীয় সম্পর্কেও আলোচনা করা হবে।

ডায়াবেটিসের স্বাস্থ্য জটিলতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হল: 

  • হার্টের সমস্যা ও ব্রেইন স্ট্রোক
  • স্পর্শ ও ব্যথার অনুভূতি কমে যাওয়া (স্নায়ু/নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার লক্ষণ) 
  • পায়ের সমস্যা, যেমন ঘা, ক্ষত ও ইনফেকশন
  • দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া এবং অন্ধত্ব
  • গর্ভপাত (গর্ভের শিশু নষ্ট হওয়া বা মারা যাওয়া) এবং মৃত সন্তান প্রসব করা
  • কিডনির সমস্যা 
  • যৌন সমস্যা (ইরেকশন না হওয়া, অর্থাৎ লিঙ্গ শক্ত না হওয়া কিংবা শক্ত অবস্থা ধরে রাখতে না পারা)

আপনি আপনার রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখলে এবং নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চললে এ ধরনের জটিলতার ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।       

প্রতি ৩ মাস পর পর রক্তের সুগার পরীক্ষা (HbA1C test) 

এই পরীক্ষাটির মাধ্যমে আপনার রক্তে থাকা সুগারের গড় (average) পরিমাণ বের করা হয়। এভাবে আপনার সুগারের পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রার কতটা কাছাকাছি তা নির্ধারণ করা যায়।

আপনি নতুন করে টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে প্রতি ৩ মাস পর পর এই পরীক্ষাটি করাতে হবে। পরবর্তীতে আপনার ডায়াবেটিস মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে চলে আসলে ৬ মাস পর পরও এই পরীক্ষা করানো যাবে।

বছরে একবার চেকআপ

হার্ট, কোলেস্টেরল ও কিডনির পরীক্ষা      

ডায়াবেটিস আপনার হার্টের রোগ, কিডনির রোগ এবং ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়, তাই হাই প্রেশার ও হাই কোলেস্টেরল যত তাড়াতাড়ি ধরে ফেলে চিকিৎসা শুরু করা যায় ততই ভালো। এসব রোগ নীরবে আপনার দেহে বাসা বাঁধে। গুরুতর হয়ে ওঠার আগে সাধারণত এসব রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় না, তাই পরীক্ষা করানোর আগে এসব সমস্যা ধরাও পড়ে না।

বছরে কমপক্ষে একবার আপনার ব্লাড প্রেশার ও রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা (রক্তে চর্বির পরিমাণ) পরীক্ষা করিয়ে নিন।

যদি আপনি আগে থেকেই হাই প্রেশার বা কোলেস্টেরলের জন্য ওষুধ সেবন করে থাকেন, তবে সেই ওষুধ সেবন করা চালিয়ে যান।  

এসব ছাড়াও হৃৎপিণ্ডের ওপর ধূমপানের নেতিবাচক প্রভাবকে ডায়াবেটিস আরও ভয়াবহ করে তোলে, তাই ডায়াবেটিস রোগীদের বিশেষভাবে ধূমপান থেকে বিরত থাকা উচিত।

ধূমপান থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় জানতে আমাদের ভিডিওটি দেখতে পারেন:

https://youtu.be/CP5PJ_jFx00

হাত-পায়ের বোধশক্তি বা অনুভূতি কমে যাওয়া   

আপনার হাত ও পায়ে কোন ধরনের অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ করলে তা ডাক্তারকে জানান।  

ডায়াবেটিস আপনার নার্ভ বা স্নায়ুর ক্ষতি করতে পারে, একে বলা হয় ‘ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি’। সাধারণত পায়ে, বিশেষ করে পায়ের পাতায় এর প্রভাব দেখা যায়। তবে শরীরের অন্যান্য অংশেও এই ক্ষতির প্রভাব পড়তে পারে, ফলাফল হিসেবে আক্রান্ত জায়গায় নিচের সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে: 

  • অবশ বা অসাড় লাগা
  • ব্যথা
  • ঝিমঝিম বা খচখচ করা (tingling)  
  • যৌন সমস্যা
  • কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া 

দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলে এই ক্ষতি অনেকটাই রোধ করা যায়।

পায়ের যত্ন     

প্রতিদিন আপনার পায়ে, বিশেষ করে পায়ের পাতায় কোনো সমস্যা দেখা দিচ্ছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখুন। নিয়মিত পায়ের যত্ন নিন, কোন অস্বাভাবিকতা দেখা দিচ্ছে কিনা তা খেয়াল করুন। 

ডায়াবেটিস আপনার পায়ে রক্ত সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে পায়ের যেকোনো অংশকে অবশ করে দিতে পারে। এতে পায়ে কোনো আঘাত পেলে বা ঘা-ক্ষত হলে তা সেরে উঠতে বেশ বেগ পেতে হয়। অনেকসময় এসব ক্ষত বা ঘা ঠিকমত সেরে ওঠে না, আবার পায়ের কোন অংশে ক্ষত হলে বা অবশ হয়ে গেলে তা সহজে বোঝাও যায় না। এর ফলে পায়ে আলসার বা ইনফেকশনের মত সমস্যা দেখা দিতে পারে। 

তাই আপনার দুই পায়ে ঠিকমতো বোধ পাচ্ছেন কি না অর্থাৎ স্পর্শ, ব্যথা, ঠাণ্ডা-গরম ইত্যাদি অনুভব করতে পারছেন কিনা সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। সেই সাথে নিয়মিত খেয়াল রাখতে হবে যে পায়ের কোন অংশ অবশ হয়ে গেছে কিনা। এছাড়াও পায়ে কোন ধরনের ক্ষত, আলসার বা ইনফেকশন দেখা দিয়েছে কিনা সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। 

এসব সমস্যা এড়াতে কিছু ছোটখাটো বিষয় মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ, যেমন:

  • পা, বিশেষ করে পায়ের পাতা পরিষ্কার ও শুকনো রাখা – এতে আপনার ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি কমবে  
  • কাটাছেঁড়া বা আঁচড় এড়াতে খালি পায়ে বাইরে না যাওয়া 
  • ভালো মত ফিট হয় এমন, অর্থাৎ সঠিক সাইজের জুতা পরা – খুব আঁটসাঁট বা টাইট নয়, আবার বেশি ঢিলাও নয়

আপনার পায়ে নিচের সমস্যাগুলোর মত কোন অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন:

  • কাঁটাছেড়া
  • ঘা বা ক্ষত
  • পা ফাটা
  • ফোস্কা পড়া
  • ব্যথা হওয়া বা পা ঝিমঝিম/খচখচ করা (tingling)
  • পায়ের পাতা ও আঙ্গুল অবশ হয়ে যাওয়া, অর্থাৎ সেখানে বোধ না পাওয়া 

প্রত্যেক বছর নিয়ম করে ডাক্তারের কাছে গিয়ে পা পরীক্ষা করিয়ে নিন। 

পায়ের ক্ষত, ঘা বা ইনফেকশনের জায়গায় দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা না হলে সেখানে পচন (গ্যাংগ্রিন) ধরতে পারে, ফলে পায়ের ঐ অংশটি বা সম্পূর্ণ পা অপারেশন করে কেটে ফেলার প্রয়োজন হতে পারে।

আরও পড়ুন: ডায়াবেটিস হলে পায়ের যত্ন কীভাবে নিবেন

চোখ পরীক্ষা 

ডায়াবেটিস হলে চোখের রক্তনালীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা থেকে দৃষ্টিশক্তির সমস্যা (ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি), এমনকি অন্ধত্বও দেখা দিতে পারে। তাই প্রতিবছর চোখ পরীক্ষা করিয়ে দেখা উচিত চোখের রক্তনালীগুলো স্বাভাবিক আছে কিনা।

১২ বছর বা তার বেশি বয়সের সব ডায়াবেটিস রোগীকেই বছরে একবার চোখ পরীক্ষা করানো উচিত।

নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করালে দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগেই আপনার চোখের সমস্যাটি ধরে ফেলা যাবে। ৩০ মিনিটের একটি ছোট পরীক্ষার সাহায্যে স্ক্রিনিং (Screening) করে চোখের পেছনের অংশ দেখার মাধ্যমে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি আগেভাগেই ধরে ফেলা যায়, ফলে এর চিকিৎসা আরও বেশি কার্যকর হয়। চোখের রক্তনালির সমস্যার দ্রুত চিকিৎসা করা হলে দৃষ্টিশক্তির সমস্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।

আপনি আপনার চোখের দৃষ্টিতে নিচের ৩টি সমস্যাসহ যেকোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ করলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যান:

  1. চোখে ঝাপসা দেখা, বিশেষ করে রাতের বেলায়,
  2. চোখের সামনে ছোট ছোট বিভিন্ন আকৃতির কিছু ভেসে বেড়াচ্ছে বলে মনে হওয়া (ফ্লোটার্স),
  3. আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যাওয়া।

গর্ভাবস্থা ও ডায়াবেটিস       

আপনি সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করলে ডাক্তারের সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করে নিন৷ টাইপ ২ ডায়াবেটিস নিয়েও আপনি নিরাপদে গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসব করতে পারবেন৷ তবে এজন্য অবশ্যই গর্ভকালীন সময়ে নিয়মিত ডাক্তারের বিশেষ চেকআপে থাকতে হবে।