আগের আর্টিকেলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস কী, কাদের হয়, এবং তা থেকে মা ও গর্ভের শিশুর কী ধরনের জটিলতা হয় তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই আর্টিকেলে সেগুলোর সমাধান, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের নানা স্বাস্থ্য জটিলতার সম্ভাবনা কমিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য আপনার রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এছাড়াও গর্ভাবস্থায় এবং প্রসবের সময়ে আপনার চিকিৎসা সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, কিংবা কোন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে কিনা তা বোঝার জন্য আপনাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রোগীর সুগারের মাত্রা পরিমাপ
একটি গ্লুকোমিটার বা টেস্টিং কিটের সাহায্যে আপনি আপনার রক্তের সুগারের পরিমাণ নির্ণয় করতে পারেন। এখানে একটি সূক্ষ্ণ, সুঁইয়ের মত যন্ত্রের (ল্যানসেট) সাহায্যে আঙুলের ডগায় খোঁচা দেয়া হয়। রক্ত বেরিয়ে আসলে টেস্টিং স্ট্রিপে এক ফোঁটা রক্ত নিয়ে তা মিটারে ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হয়। এক্ষেত্রে নিচের ৩টি ব্যাপার অবশ্যই জানা থাকতে হবে:
- কীভাবে সঠিক উপায়ে রক্তের সুগার মাপা যায়?
- কখন এবং কতক্ষণ পরপর এই সুগার মাপতে হবে? গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে সকালের নাশতার আগে ও প্রতিবেলার খাবার খাওয়ার এক ঘন্টা পরে ব্লাড সুগার মেপে দেখতে বলা হয়।
- আপনার রক্তে সুগারের মাত্রা কেমন হওয়া উচিত? এই হিসাবটি গ্লুকোমিটারে mmol/l এককে দেখানো হয়।
আপনার জন্য ব্লাড সুগারের আদর্শ মাত্রা কত হওয়া উচিত তা ডাক্তার আপনাকে জানাবেন। উপরের ৩টি বিষয় আপনার না জানা থাকলে কিংবা এ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন থাকলে ডাক্তার বা নার্সের কাছ থেকে বুঝে নিন।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রোগীর খাবার
খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনে ব্লাড সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আপনি প্রয়োজনে একজন পুষ্টিবিদের শরণাপন্ন হতে পারেন। তিনি আপনাকে যথাযথ খাদ্যাভাস ও স্বাস্থ্যকর খাবার সম্পর্কে পরামর্শ দিতে পারবেন।
পরামর্শগুলো হতে পারে এমন:
- নিয়মিত খাবার খাওয়া
সারাদিনে নিয়মিত ৩ বেলা খাবার খেতে হবে এবং কোনবেলার খাবার যেন বাদ না যায় সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। - শ্বেতসারযুক্ত এবং লো-গ্লাইসেমিক ইনডেক্স-এর খাবার খাওয়া
লাল চাল (ব্রাউন রাইস) ও আটা, ঢেঁকিছাঁটা চাল, ডাল, মটর, শিম, যব ইত্যাদি হলো লো-গ্লাইসেমিক ইনডেক্স-এর শ্বেতসার। এগুলো রক্তে ধীরে ধীরে সুগার নিঃসরণ করে, হঠাৎ করে ব্লাড সুগার বাড়িয়ে দেয় না। - বেশিবেশি ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া
- চিনি দেওয়া, মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলা
চিনি খাওয়া পুরোপুরি বাদ দেয়ার প্রয়োজন নেই, তবে চিনিযুক্ত খাবারের বদলে ফল বা বাদামজাতীয় স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস করা উচিত। - কোমল পানীয় এড়িয়ে চলা
ফলের জুস বা স্মুদিতে অনেক বেশি চিনি থাকতে পারে, “no added sugar” অর্থাৎ “অতিরিক্ত কোন চিনি নেই” লেখা পানীয়গুলোতেও কিছু পরিমাণে চিনি থাকতে পারে। তাই পান করার আগে লেবেলটি পড়ে দেখতে হবে বা উপযুক্ত কাওকে জিজ্ঞাসা করে নিতে হবে। - কম চর্বিযুক্ত (lean) আমিষের উৎস বেছে নেয়া
এমন আমিষের উৎস হতে পারে মাছ, চর্বিছাড়া মাংস ইত্যাদি। তবে যেসব খাবার গর্ভাবস্থায় এড়িয়ে চলা উচিত (যেমন নির্দিষ্ট কিছু মাছ বা পনিরজাতীয় কিছু খাবার) সেসব যেন খাওয়া না হয় সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রোগীর ব্যায়াম
নিয়মিত শরীর সচল রাখার মাধ্যমে রক্তে সুগারের পরিমাণ কমানো যায়, তাই ব্যায়ামের মাধ্যমে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। সাধারণত সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট (২ ঘন্টা ৩০ মিনিট) মাঝারি ধরনের ব্যায়াম করার পরামর্শ দেয়া হয়, সাথে সপ্তাহে ২ দিন বা তার বেশি সময় তুলনামূলকভাবে ভারী ব্যায়ামের (strength exercises) পরামর্শ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে গর্ভাবস্থায় নিরাপদে ব্যায়াম করার নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রোগীর ওষুধ
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও নিয়মিত শরীরচর্চা করার ১-২ সপ্তাহ পরেও রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে না আসলে, অথবা আপনার রক্তে সুগারের মাত্রা অনেক বেশি থাকলে আপনাকে ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেয়া হবে। গর্ভাবস্থায় সময়ের সাথে সাথে আপনার রক্তে সুগারের মাত্রা আরো বাড়তে পারে, তাই শুরুর দিকে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পরবর্তীতে হয়তো আপনার ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হতে পারে। তবে সন্তান জন্মদানের পর আপনার সাধারণত আর ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হয় না। ওষুধটি হতে পারে ট্যাবলেট বা ইনসুলিন ইনজেকশন।
ট্যাবলেটের মধ্যে সাধারণত মেটফরমিন সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। কখনো কখনো মেটফরমিনের পরিবর্তে ডাক্তার আপনাকে গ্লিবেনক্ল্যামাইড নামের ট্যাবলেট সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন।
মেটফরমিন ট্যাবলেট সাধারণত খাবারের সাথে বা খাবার খাওয়ার পরে (ভরাপেটে) দিনে মোট ৩ বার পর্যন্ত সেবন করার পরামর্শ দেয়া হয়। এর কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারে, যেমন:
- বমিবমি ভাব
- বমি হওয়া
- পেট কামড়ানো
- ডায়রিয়া
- খাওয়ার রুচি কমে যাওয়া
কিছু ক্ষেত্রে ইনসুলিন নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। যদি—
- আপনি মেটফরমিন সেবন করতে না পারেন,
- মেটফরমিন সেবন করলে আপনার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় ,
- মেটফরমিন সেবনের পরেও আপনার ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে না আসে,
- আপনার রক্তে সুগারের মাত্রা খুবই বেশি থাকে,
- আপনার সন্তান আকারে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বড় হয়, বা
- আপনার গর্ভে অতিরিক্ত অ্যামনিওটিক তরল জমে থাকে (পলিহাইড্রামনিওস)।
ইনসুলিন সাধারণত ইনজেকশন হিসেবে নেয়া হয়। আপনার কতটুকু ইনসুলিন নিতে হবে তা আপনার ডাক্তার আপনাকে জানাবেন। কিভাবে নিজে নিজে বাড়িতেই এই ইনজেকশন নেওয়া যায় তা আপনার ডাক্তার বা নার্সের কাছ থেকে দেখে নিবেন।
আপনাকে কী ধরনের ইনসুলিন নেওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে সেটার উপর ভিত্তি করে খাওয়ার আগে, শোবার সময় বা ঘুম থেকে ওঠার পরে আপনার ইনসুলিন নিতে হতে পারে। গর্ভাবস্থায় সাধারণত সময়ের সাথে রক্তের সুগার বাড়তে থাকে, তাই সময়ের সাথে ইনসুলিনের পরিমাণও বাড়াতে হতে পারে৷
ইনসুলিনের প্রভাবে ব্লাড সুগার একেবারেই কমে যেতে পারে। এই অবস্থাকে বলা হয় হাইপোগ্লাইসেমিয়া, যা ইনসুলিনের কমন তবে গুরুত্বপূর্ণ একটি পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া। এর কিছু উপসর্গ হল:
- কাঁপুনি
- অনবরত ঘামতে থাকা
- ক্ষুধা লাগা
- চেহারা ফ্যাকাশে বা মলিন হয়ে যাওয়া
- কোনকিছুতে মনযোগ দিতে কষ্ট হওয়া
হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে দ্রুত ব্লাড সুগার মেপে দেখতে হবে এবং সুগারের মাত্রা বেশি কমে গেলে সাথে সাথে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে হবে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রোগীর পর্যবেক্ষণ
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের প্রভাবে আপনার গর্ভের সন্তানের বিভিন্ন স্বাস্থ্য জটিলতার ঝুঁকি বাড়ে, যেমন আকারে স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হওয়া। এ কারণে গর্ভাবস্থায় আপনাকে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বার ডাক্তার দেখাতে (antenatal appointments) হবে, যাতে করে আপনার গর্ভের শিশুকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা যায়।
এসব অ্যাপয়েন্টমেন্টে থাকবে:
- গর্ভের ১৮-২০ সপ্তাহ সময়কালে একটি আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান, যাতে করে গর্ভের সন্তানের কোন অস্বাভাবিকতা থাকলে তা ধরা পড়ে।
- গর্ভের ২৮, ৩২ ও ৩৬ সপ্তাহে আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান – এতে করে শিশুর বৃদ্ধি ও গর্ভে অ্যামনিওটিক তরলের পরিমাণ দেখা হবে।
- পরবর্তীতে ৩৮ সপ্তাহের পর থেকে নিয়মিত চেকআপ করা হবে।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রোগীর সন্তান প্রসব
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়েদের জন্য সন্তান জন্মদানের আদর্শ সময়কাল হল ৩৮ থেকে ৪০ সপ্তাহ। যদি আপনার ব্লাড সুগার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং আপনার ও আপনার সন্তানের সুস্বাস্থ্য নিয়ে কোন দুশ্চিন্তার কারণ না থাকে, তবে প্রসববেদনা স্বাভাবিকভাবে শুরু হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে পারেন। তবে সাধারণত যদি ৪০ সপ্তাহ ৬ দিনের মধ্যে আপনি প্রাকৃতিকভাবে সন্তান প্রসব না করে থাকেন, তবে আপনাকে কৃত্রিমভাবে ওষুধ দিয়ে প্রসব প্রক্রিয়া শুরু করার বা সিজারিয়ান অপারেশন করার পরামর্শ দেয়া হবে। যদি আপনার বা সন্তানের স্বাস্থ্য বিষয়ক কোন জটিলতা থাকে বা আপনার ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে না থাকে, সেক্ষেত্রে আরও আগেই প্রসবের ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হতে পারে।
আপনার অবশ্যই হাসপাতালে সন্তান প্রসব করা উচিত, যেখানে যথাযথভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ ডাক্তার ও নার্স আপনার সন্তানের উপযুক্ত যত্ন নিতে পারবেন। প্রসবের জন্য হাসপাতালে যাওয়ার সময় আপনার ব্লাড সুগার মাপার যন্ত্র ও আপনি যেসব ওষুধ সেবন করেন সেগুলো সাথে নিয়ে যাবেন। সাধারণত প্রসববেদনা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত বা সিজারিয়ান অপারেশনের আগে ডাক্তার ওষুধ সেবন নিষেধ না করা পর্যন্ত নিয়মিত ব্লাড সুগার মেপে প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন করা চালিয়ে যেতে হয়।
সন্তান প্রসবের পুরো প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে আপনার ব্লাড সুগার পর্যবেক্ষণ করে নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে। প্রয়োজনে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে আপনাকে ইনসুলিন দেয়া হতে পারে।
সন্তান জন্মদানের পর করনীয়
সাধারণত সন্তান জন্মদানের পরপরই আপনি তাকে দেখতে, কোলে নিতে বা বুকের দুধ পান করাতে পারবেন। সন্তান জন্মদানের পর যত দ্রুত সম্ভব (৩০ মিনিটের মধ্যে) তাকে বুকের দুধ পান করানো গুরুত্বপূর্ণ। এরপর ২-৩ ঘন্টা পরপরই তাকে নিয়মিত দুধ পান করাতে হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত তার ব্লাড সুগারের পরিমাণ স্থিতিশীল না হচ্ছে।
জন্মের ২-৪ ঘন্টা পর হতে নিয়মিত আপনার সন্তানের ব্লাড সুগার পরিমাপ করা হবে। যদি সুগারের মাত্রা কম থাকে, তবে সাময়িকভাবে নল বা ড্রপের সাহায্যে তাকে দুধ খাওয়ানোর প্রয়োজন হতে পারে। যদি শিশুটি অসুস্থ থাকে বা নিবিড় পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন পড়ে, তবে তাকে দেখভালের জন্য নবজাতকদের বিশেষ ইউনিটে (যেমন নিওনেটাল আইসিইউ) রাখা হতে পারে৷
গর্ভাবস্থায় ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করতে আপনি যে ওষুধ সেবন করছিলেন, প্রসবের পর তা সাধারণত আর সেবন করতে হয় না। তবে প্রসবের পরের ১-২ দিন আপনাকে নিয়মিত ব্লাড সুগার মেপে দেখার পরামর্শ দেয়া হবে। যদি মা ও সন্তান দুইজনেই সুস্থ থাকেন, তবে প্রসবের ২৪ ঘন্টা পরে আপনি ও আপনার সন্তান বাড়ি চলে যেতে পারবেন।
সন্তান জন্মদানের ৬ থেকে ১৩ সপ্তাহ পরে ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য রক্ত পরীক্ষা করা উচিত, কারণ গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে ভোগা স্বল্প সংখ্যক মহিলার ক্ষেত্রে সন্তান জন্ম দেওয়ার পরেও ব্লাড সুগার উচ্চমাত্রায় থেকে যায়। যদি এই রক্ত পরীক্ষার ফলাফল স্বাভাবিক আসে, তবে সাধারণত বছরে একবার ডায়াবেটিস পরীক্ষা করে দেখার পরামর্শ দেয়া হয়। এর কারণ হল, যাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকে তাদের পরবর্তীতে টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। এটি এমন একটি রোগ যা খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক পরিশ্রম এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে না রাখলে সারাজীবন আপনাকে ভোগাতে পারে।