সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করলে কয়েক মাস আগে থেকেই কিছু প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। এতে করে মা ও শিশুর সুস্থ থাকার সম্ভাবনা বাড়ে।
ফলিক এসিড
সুস্থ সন্তান জন্মানোর জন্য ফলিক এসিড খুব গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের দেহে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলিক এসিড না থাকলে শিশুর ব্রেইন ও মেরুদণ্ডে গুরুতর জন্মগত ত্রুটি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
গর্ভে সন্তান আসার অন্তত ১ মাস আগে থেকেই মায়ের দেহে পর্যাপ্ত ফলিক এসিড থাকা প্রয়োজন।[১] তাই এই পদক্ষেপটা গর্ভধারণের কয়েক মাস আগে থেকেই নিতে হয়। আপনি যখন সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করবেন, তখন থেকেই ফলিক এসিড ট্যাবলেট খাওয়া শুরু করে দিবেন।
খাবার থেকে ফলিক এসিডের চাহিদা পূরণ সম্ভব?
কিছু খাবার থেকে আমরা ফলিক এসিড পাই। যেমন: পালংশাক ও পাতাকপি। তবে গর্ভের সন্তানের জন্য যে পরিমাণ ফলিক এসিড শরীরে থাকা প্রয়োজন তা শুধুমাত্র খাবার থেকে সাধারণত পূরণ করা সম্ভব হয় না। তাই আলাদা করে ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
কী পরিমাণে ফলিক এসিড খেতে হয়?
ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেটের ডোজ হবে অন্তত ৪০০ মাইক্রোগ্রাম। তবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে বেশি ডোজ খাওয়া লাগতে পারে। যেমন—
- আপনার ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হলে
- ডায়াবেটিস থাকলে
- খিঁচুনির ওষুধ চলতে থাকলে
- স্বামী- স্ত্রী দুজনের কারো পরিবারে অথবা আগের সন্তানের যদি ব্রেইনে অথবা মেরুদণ্ডে জন্মগত ত্রুটি থাকে
এগুলোর মধ্যে কোনোটি থাকলে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেটের ডোজের মাত্রা জেনে নিতে হবে।
পড়ুন: ফলিক এসিড খাওয়ার নিয়ম
টিকা
টিকা মা ও গর্ভে থাকা সন্তানকে বিভিন্ন রোগ থেকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। তাই সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা থাকলে যদি কোনো টিকা না নেওয়া থাকে সেটি নিতে হবে।
হেপাটাইটিস বি টিকা
গর্ভবতী অবস্থায় হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মারাত্মক রোগ দেখা দিতে পারে। মায়ের থেকে সন্তানও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। তাই হেপাটাইটিস বি টিকা নেওয়া বিশেষভাবে জরুরি।
হেপাটাইটিস বি টিকা দেয়ার আগে একটা রক্ত পরীক্ষা করে দেখা হয় যে আপনি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন কি না। আক্রান্ত না হয়ে থাকলে ৩ ডোজ টিকা দেওয়া হয়। পূর্ণ টিকা নিতে কয়েক মাস সময় লাগে। তাই দ্রুত টিকা নেওয়া শুরু করতে পারলে ভালো। গর্ভবতী অবস্থায়ও এই টিকা নেওয়া যায়।
টিটেনাস টিকা
পূর্বে যদি টিটেনাস টিকার কোর্স সম্পন্ন না করে থাকেন, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শে এই টিকার কোর্স শুরু করুন।[২] এই টিকা অনেকের কাছে ‘টিটি টিকা’ নামে পরিচিত। এই টিকা আপনাকে এবং আপনার নবজাতককে ধনুষ্টংকার রোগ থেকে সুরক্ষা দিতে সাহায্য করবে।
এই টিকার প্রথম ডোজের এক মাস পরে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়। সন্তান প্রসবের অন্তত দুই সপ্তাহ আগে দুই ডোজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন। দুই ডোজ নেয়ার ৬ মাস পরে তৃতীয় ডোজ দেয়া হয়। তিন ডোজ টিকা অন্তত ৫ বছরের জন্য ধনুষ্টংকার থেকে সুরক্ষা দিতে সাহায্য করে।[৩]
অন্যান্য টিকা
এ ছাড়াও আগে যদি অন্যান্য প্রয়োজনীয় টিকাগুলো না নেওয়া থাকে তাহলে তা চিকিৎসককে জানাতে হবে। যেমন ২ ডোজ ‘এমএমআর টিকা’ না দেওয়া থাকলে গর্ভের শিশু রুবেলাতে আক্রান্ত হতে পারে। ফলে তার হার্ট, ব্রেইন, চোখ ও কানে সমস্যা হতে পারে—এমনকি গর্ভপাত হতে পারে।
‘এমএমআর টিকা’ গর্ভবতী নারীদেরকে দেওয়া যায় না। এটি গর্ভধারণের পূর্বেই দিতে হয়। টিকা দেওয়ার পর ১ মাস পর্যন্ত বাচ্চা নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হয়।[৪]
আয়রন
আমাদের দেশে অনেক নারী আয়রনের অভাবে রক্তস্বল্পতায় ভোগেন, কিন্তু জানেন না যে তারা এই রোগে ভুগছেন।[৫] খাবারে পর্যাপ্ত আয়রনের অভাব, মাসিকের সময় রক্ত যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে আয়রনের অভাব হতে পারে।
গর্ভবতী অবস্থায় আয়রনের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা না থাকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভবতী মায়েরা এই রোগে ভুগলে নানান জটিলতা হতে পারে। যেমন—
- প্রিম্যাচিউর বাচ্চা হওয়া, অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই বাচ্চা প্রসব করা
- বাচ্চার ওজন কম হওয়া
- মৃত বাচ্চা জন্মানোর ঝুঁকি
তাই বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা করলে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে দেখুন আপনার এই রোগটি আছে কি না। যদি রোগ ধরা পরে, তাহলে মাত্র কয়েক মাস আয়রন ট্যাবলেট সেবন করে এই রোগ সম্পূর্ণভাবে সারিয়ে তোলা যায়।
ভিটামিন ডি
ভিটামিন ডি দেহের হাড়, দাঁত ও মাংসপেশি সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। গর্ভের বাচ্চার দাঁত ও দেহের হাড়সহ বিভিন্ন অঙ্গের সুস্থ গঠনের জন্য মায়ের পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি প্রয়োজন।[৬]
বাংলাদেশের একটি জাতীয় জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজন নারীর ভিটামিন ডি এর ঘাটতি আছে।[৭] শুধুমাত্র খাবার থেকে ভিটামিন ডি এর অভাব পূরণ করা খুব দুষ্কর। সাধারণত রোদে গেলে শরীর ভিটামিন ডি তৈরি করে নেয়। রোদে না যাওয়া, রোদে গেলেও শরীরের প্রায় সবটুকু কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা—এসব কারণে অনেক নারীর ভিটামিন ডি এর ঘাটতি থাকে।
চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে দেহে ভিটামিন ডি এর ঘাটতে আছে কি না জেনে নিন। ভিটামিন ডি এর ঘাটতি থাকলে তা সহজেই পূরণ করা সম্ভব। ডাক্তার বলে দিতে পারবেন কোন মাত্রায় ভিটামিন ডি খেলে অভাব পূরণ হবে।
ক্যাফেইন
গর্ভাবস্থায় মা ক্যাফেইন খেলে বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের ক্যাফেইন গ্রহণের সাথে শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করার সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছে অনেকগুলো গবেষণায়।[৮][৯] ওজন কম হওয়ার ফলে শিশুর নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় ক্যাফেইন খেলে মিসক্যারেজ বা গর্ভপাতের সম্ভাবনাও বাড়তে পারে।
তাই গর্ভাবস্থায় ক্যাফেইন আছে এমন খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দেয়া হয়। একেবারে এড়িয়ে চলতে না পারলেও দিনে ২০০ মিলিগ্রামের বেশি ক্যাফেইন না খেতে চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেয়।[১০]
হুট করে ক্যাফেইন খাওয়া কমিয়ে দেওয়া অনেকের জন্য কষ্টকর হতে পারে। তাই চা-কফি খাওয়ার অভ্যাস থাকলে আগে থেকেই ক্যাফেইন খাওয়া কমানোর চেষ্টা করুন।
ক্যাফেইনযুক্ত খাবারগুলো হলো—
- চা-কফি
- কোক
- সফট ড্রিঙ্কস
- এনার্জি ড্রিঙ্কস
- চকলেট
কতটুকু চা-কফিতে ২০০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে?
সাধারণত ৩৫০ মিলিলিটারের এক কাপ চায়ে ৭৫ মিলিগ্রাম এবং সমপরিমাণ ইনস্ট্যান্ট কফিতে ১০০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে। তাই গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন ২.৫ কাপ চা অথবা ২ কাপ কফির বেশি খাবেন না। তবে এসব ছাড়াও অন্যান্য ক্যাফেইনযুক্ত খাবার খেলে সেই অনুযায়ী চা-কফি খাওয়াও কমাতে হবে। একেবারে এড়িয়ে চলতে পারলে সবচেয়ে ভালো।
ওজন
গর্ভধারণের আগে মায়ের স্বাভাবিক ওজন থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।[১১] সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করলে দেখে নিতে হবে ওজন ঠিক আছে কি না।
ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে
দেহের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে গর্ভবতী অবস্থায় অনেক রোগ দেখা দিতে পারে। যেমন: ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেসার ও প্রি-এক্লাম্পসিয়া।
এ ছাড়া সন্তান প্রসবের সময় বাচ্চার কাঁধ আটকে যেতে পারে, প্রসবের পরে অনেক রক্তপাত হতে পারে এবং প্রসব নরমাল না হয়ে সিজার করা লাগতে পারে।
ওজন স্বাভাবিক থাকলেও এই সমস্যাগুলো হতে পারে। তবে ওজন বেশি হলে এগুলো হওয়ার ঝুঁকি ২ থেকে ৪ গুন পর্যন্ত বেঁড়ে যায়।
যদিও অতিরিক্ত ওজন নিয়ে গর্ভধারণ করলে ঝুঁকি বেশি, তবে কোনো ভাবেই গর্ভাবস্থায় ওজন কমানোর চেষ্টা করা যাবে না।
ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলে
ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলেও কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন: শিশুর ওজন কম হতে পারে, প্রিম্যাচিউর হতে পারে, অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই প্রসব হতে পারে।
আপনার সঠিক ওজন বুঝার জন্য বিএমআই ক্যালকুলেটরে ওজন ও উচ্চতা বসিয়ে দেখে নিতে পারেন। স্বাভাবিকের চেয়ে ওজন কম অথবা বেশি হলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবেন।
স্বাস্থ্যকর খাবার
সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করলে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সাধারণত প্লেটে বেশী ভাত নেই এবং সাথে অল্প তরকারি দিয়ে খাই। কিন্তু এভাবে পরিপূর্ণ পুষ্টির চাহিদা সাধারণত পূরণ হয় না।
পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে যা করবেন
প্লেটে আগে ভাত না নিয়ে, আগে বেশি করে সবজি নিবেন। চেষ্টা করবেন প্লেটের অর্ধেক শাকসবজি আর ফলমূল দিয়ে পূরণ করতে।
খাওয়ার সময় আমরা সাধারণত প্লেটে ফল নেই না। খাওয়ার আগে অথবা পরে কিংবা নাস্তায় ফল খাবেন, এবং মনে মনে চিন্তা করবেন সেটুকু প্লেটে রাখলে সবজির সাথে ফল মিলে প্লেটের অর্ধেক ভরে কি না।
তারপর প্লেটের চার ভাগের এক ভাগে নিবেন আমিষ জাতীয় খাবার। যেমন: মাছ, মুরগির মাংস, ডাল। আর প্লেটের বাকি অংশে, অর্থাৎ চার ভাগের এক ভাগে নিবেন ভাত বা রুটি। সাদা চাল, সাদা আটার পরিবর্তে লাল চাল, লাল আটা ব্যবহার করবেন।
কিছু খাবার এড়িয়ে চলবেন। যেমন—
- ফাস্ট ফুড
- ‘হাইলি প্রসেসড ফুড’, অর্থাৎ অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার
- অতিরিক্ত তেল-চর্বি, চিনি ও লবণযুক্ত খাবার
দোকানের খাবারগুলো মুখরোচক করার জন্য সেসবে অনেক বেশি তেল-চর্বি, চিনি ও লবণ দেওয়া হয়। তাই বাইরে থেকে কিছু কিনে খাওয়ার আগে দেখে নিবেন খাবারে এসব কী পরিমাণে ব্যবহার করা হয়েছে।
ব্যায়াম
গর্ভধারণ থেকে বাচ্চা প্রসব করা পর্যন্ত অনেক লম্বা একটা সময়। এই দীর্ঘ সময়ে মায়ের শরীরের ওপর প্রচুর ধকল যায়। এই ধকলের জন্য শরীরকে প্রস্তুত করতে পারেন ব্যায়াম করার মাধ্যমে।
এ ছাড়াও ব্যায়াম প্রেগন্যান্ট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় এবং গর্ভকালীন বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কমায়। যেমন: প্রি-এক্লাম্পসিয়া, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস।
ধূমপান
ধূমপান নারী-পুরুষ উভয়ের সন্তান জন্মদানের ক্ষমতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি গর্ভবতী মায়ের আশেপাশেও যদি কেউ ধূমপান করে তাহলে গর্ভের সন্তানের ওজন কম হবার সম্ভাবনা ২০ শতাংশ বেড়ে যায়।
তাই পরিবারের কেউ যদি ধূমপান করে, সেটা বন্ধ করতে হবে। সহজেই কোনো ঔষধ ছাড়াই ধূমপান ছাড়তে নিচের ভিডিওটি দেখতে পারেন।
রোগ নিয়ন্ত্রণ
কিছু রোগ আছে যা গর্ভধারণের সময়ে নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।[১২] একজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলো বুঝে নিন। যেমন—
- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও খিঁচুনি আছে কি না এবং থাকলে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন?
- পরিবারের অন্যান্যদের কী কী রোগ আছে?
- কোনো ঔষধ চলতে থাকলে গর্ভধারণের জন্য তাতে কী পরিবর্তন আনতে হবে?
- আগের প্রেগন্যান্সিতে কোনো সমস্যা হয়ে থাকলে এখন কী করতে হবে?
একজন চিকিৎসক এসকল বিষয়ে কী করতে হবে তা জানাবেন। খেয়াল রাখতে হবে যেন আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কোনো বিষয় চিকিৎসককে জানানো বাদ না যায়।