চিকিৎসাবিজ্ঞানে একটা প্রবাদ আছে, “আমরা যা জানি না, সেটা চোখে দেখি না”। এই প্রবাদটা করোনাকালে শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। বড়রা অসুস্থতার কথা যেভাবে প্রকাশ করতে পারে, শিশুরা সেটা পারে না। শিশুদের এই অসুস্থতাগুলো সঠিক সময়ে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থাকে বড়দের ওপর, যেমন বাবা-মা, বড় ভাই-বোন।
এই লেখাটির উদ্দেশ্য বড়দেরকে এই দেখভালের কাজে সহযোগিতা করা। তুলে ধরবো করোনা সংক্রান্ত মানসিক চাপের কারণে শিশুদের মাঝে দেখা যাচ্ছে এমন দশটি লক্ষণ। এগুলো যদিও মানসিক, তবে শারীরিক প্রভাবও ফেলে। আপনি যদি জেনে রাখেন, তাহলে আপনার চোখও সেটা দেখতে পারবে।
দশটা লক্ষণ তুলে ধরার পরে পাঁচটা সমাধানের উপায় দেয়া থাকবে, যেগুলো আপনি বাসায় বসেই করতে পারবেন শিশুর স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য।
শিশুদের মাঝে করোনা সংক্রান্ত মানসিক চাপের ১০টি লক্ষণ
- শিশুরা বড় হবার সময় একটার পর একটা ধাপ পার করে। প্রথমে খাবার খাইয়ে দিতে হয়, তারপর নিজে নিজে খাওয়া শিখে। নিজে নিজে বাথরুমে যাওয়া শিখে। যে কাজগুলো শিশুটা শিখে ফেলেছে, যে ধাপ পার করে ফেলেছে, তার পেছনের ধাপে যদি আবার ফেরত যায়। যেমন, যে শিশু ছয় মাস ঘুমে প্রস্রাব করে নি, সে যদি আবার তা করা শুরু করে।
- শিশুটার মন খারাপ হয়েই থাকছে, কষ্ট পাচ্ছে, কিছুতেই মন ভালো হচ্ছে না।
- যেসব কাজ করতে আগে শিশুটার ভালো লাগত, এখন সেগুলো সে এড়িয়ে চলে।
- ছোট শিশুরা খুব বেশি কান্না করছে বা সব সময় বিরক্ত হয়ে আছে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। টিনেজ বয়সী শিশুরা খারাপ ব্যবহার করছে, চিল্লাচিল্লি বা ঝগড়া করছে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে।
- শিশুটার মনোযোগ কমে যাচ্ছে, একটা জিনিসে মনোযোগ ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে।
- স্কুলের পড়াশুনায় খারাপ করছে বা স্কুলে যেতে চাইছে না।
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠছে। স্বাভাবিকের চেয়ে কম বা খুব বেশি খাবার খাচ্ছে।
অস্বাস্থ্যকর ঘুমের অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে, ঘুম কম হচ্ছে, ঘুমাতে কষ্ট হচ্ছে বা অনেক বেশী ঘুমাচ্ছে। - কোন অসুখ ছাড়াই মাথা ব্যথা, পেটে ব্যথা, গায়ে ব্যথা ইত্যাদি হওয়া। মানসিক চাপ থেকেও এসব শারীরিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
- শিশুটা বেশি বেশি দুশ্চিন্তা করছে বা মন খারাপ করছে।
- সিগারেট, মদ, বা মাদকে আসক্ত হয়ে পরছে।
এসব লক্ষণ দেখা দেয়া মানেই যে স্বাস্থ্যে ব্যঘাত ঘটেছে, সেটা না। লকডাউনের সময়ে প্রায় সবারই রুটিন উল্টাপাল্টা হয়েছে। ঘুমের অভ্যাস অনেকেরই পরিবর্তন হয়েছে। তাই ঢালাওভাবে সবার ক্ষেত্রে এটা বলা যাবে না যে মানসিক চাপের কারণেই এই পরিবর্তন হয়েছে।
তবে আমাদেরকে সচেতন থাকতে হবে। কারণ ঘুমাতে কষ্ট হওয়া বা স্বাভাবিকের চেয়ে ঘুম বেড়ে যাওয়া শিশুদের মধ্যে ডিপ্রেশনেরও একটা লক্ষণ।
যে ৫টি উপায়ে শিশুর স্বাস্থ্য ভালো রাখার চেষ্টা করবেন
যদি আপনার শিশুর মধ্যে মানসিক চাপের লক্ষণগুলো দেখতে পান, তখন নিচের কাজগুলো করার চেষ্টা করবেন। আর প্রয়োজনে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন।
- শিশুর সাথে করোনা মহামারী নিয়ে কথা বলুন। বয়স অনুযায়ী সে যা বুঝতে পারবে, সেই ভাষায় তাকে তথ্য দিন। সে নিরাপদে আছে এই ব্যাপারে তাকে আশ্বস্ত করুন।
করোনা নিয়ে যে মন খারাপ লাগা স্বাভাবিক, সেটা তাকে বলুন। আর বোঝান যে আপনি তার পাশে আছেন। যে কোন সময়ে সে তার প্রশ্ন, দুশ্চিন্তা, ভয়গুলো নিয়ে আপনার কাছে এসে কথা বলতে পারে এবং আপনি তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।
কথা বলার সময় নিজে শান্ত থাকবেন। আপনি যা বলবেন, শিশু সেটা শুনবে। যে ভাবে বলবেন, সেটাও কিন্তু সে খেয়াল করবে। - বাসায় করোনা মহামারীর খবর সীমিত রাখার চেষ্টা করুন। টিভিতে, ইউটিউবে, ফেসবুকে সারাক্ষণ মহামারী আর মৃত্যুর খবর দেখতে থাকলে শিশুর মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে।
আবার অনেক ধরণের ভুল তথ্য এসব জায়গায় ঘোরাফেরা করে। এসব খবর বুঝতে না পেরে, ভুল বুঝে, বা ভুল খবর দেখে, সে কিন্তু ভয় পেয়ে যেতে পারে। শিশুকে আগে থেকেই বলে রাখবেন যে ফেসবুকে বা টিভিতে করোনা মহামারী নিয়ে যা বলা হয়, সবকিছুই সত্য নয়। - শিশুর সাথে সুন্দর সময় কাটান। তার সাথে বই পড়তে পারেন, খেলাধুলা করতে পারেন, ব্যায়াম করতে পারেন।
আর যতটা সম্ভব, শিশুর স্বাভাবিক রুটিন বজায় রাখার চেষ্টা করবেন। যেমন, স্কুলে যাওয়ার কথা কিন্তু স্কুল বন্ধ থাকলে স্কুলের রুটিনের আদলে একটা পড়ার শিডিউল, টিফিন আর খেলাধুলার শিডিউল করতে পারেন।
তার বন্ধুবান্ধবের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিন। সেটা ফোন দিয়ে বা ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে হোক। শিশুকে তার স্বাভাবিক জীবনের যত কাছাকাছি নেয়া যায়, তত ভালো। - শিশুকে শেখান সে কিভাবে নিজেকে আর অন্যদেরকে করোনা থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে। যেমন, বার বার হাত ধুতে হবে। যে কাশছে বা যে অসুস্থ, তার কাছে যাওয়া যাবে না। এই বিষয়গুলো জানা থাকলে তারা আরেকটু সাহসী এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে।
- আপনাকে আপনার শিশুর জন্য রোল মডেল হতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা, বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনের সাথে ফোনে বা ইন্টারনেটে যোগাযোগ রাখা, বার বার হাত ধোওয়া, চোখ নাক মুখে হাত না দেয়া – আপনাকে এগুলো করে যেতে হবে। শিশুও আপনাকে দেখে শিখবে।
নিজের খেয়াল রাখবেন। শিশুর স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে এমন কোন লক্ষণ দেখলে ঘাবড়ে যাবেন না। একটা পরিকল্পনা করে এগোবেন।