টাইপ ১ ডায়াবেটিস বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। একারণে টাইপ ১ ডায়াবেটিসকে পূর্বে ‘জুভেনাইল ডায়াবেটিস’ বা কৈশোরকালীন ডায়াবেটিস বলা হতো। তবে যেকোনো বয়সেই কোনো ব্যক্তির এই রোগ হতে পারে।
ডায়াবেটিস অর্থ আমরা সচরাচর যেটিকে বুঝি তা মূলত টাইপ ২ ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মোট রোগীর মাত্র ৫-১০ শতাংশ টাইপ ১ ডায়াবেটিসে ভোগেন।
আমাদের শরীরে ‘ইনসুলিন’ নামে একটি প্রকার হরমোন তৈরি হয়। ইনসুলিন রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। টাইপ ১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে এ হরমোন যথেষ্ট পরিমাণে তৈরি হয় না। ফলে রক্তে সুগারের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যায়।
এখনো পর্যন্ত টাইপ ১ ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কোনো উপায় আবিষ্কৃত হয়নি। তবে রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও নিয়মিত ডাক্তারের চেকআপের মাধ্যমে সহজেই রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
উল্লেখ্য, বয়স অথবা অতিরিক্ত ওজনের সাথে টাইপ ১ ডায়াবেটিসের কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলোর সাথে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের সংযোগ রয়েছে। তাই অনেক ক্ষত্রে শুধুমাত্র সুস্থ জীবনধারা মেনে চলার মাধ্যমে টাইপ ২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব হলেও, টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীদের সুস্থ জীবনধারার পাশাপাশি ইনসুলিনও নিতে হয়।
পরিচ্ছেদসমূহ
টাইপ ১ ডায়াবেটিসের উপসর্গ
টাইপ ১ ডায়াবেটিসের উপসর্গগুলো তুলনামূলকভাবে দ্রুত দেখা দেয়। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এসব লক্ষণ খুব তাড়াতাড়ি প্রকাশ পায়। লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- অতিরিক্ত তৃষ্ণা
- স্বাভাবিকের তুলনায় ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, বিশেষত রাতের বেলায়
- অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করা
- চেষ্টা ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া
- বারবার ছত্রাকের সংক্রমণ (Thrush) দেখা দেওয়া
- দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া
- কাটা-ছেঁড়া বা অন্যান্য ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া
- নিঃশ্বাসের সময়ে ফলের মতো গন্ধ হওয়া
টাইপ ১ ডায়াবেটিসের পরীক্ষা-নিরীক্ষা
ডায়াবেটিস শনাক্ত করার দুই ধরনের পরীক্ষা আছে—রক্ত পরীক্ষা ও প্রস্রাব পরীক্ষা। এগুলোর মাধ্যমে প্রস্রাবে বা রক্তে কতটুকু সুগার আছে তা দেখা হয়। ডায়াবেটিস শনাক্ত করার জন্য ডাক্তার আপনাকে এ দুটি পরীক্ষার যেকোনো একটি বা দুটি পরীক্ষাই করানোর পরামর্শ দিতে পারেন।
পরীক্ষায় ডায়াবেটিস ধরা পড়লে টাইপ ১ ডায়াবেটিসের অবস্থা মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে ডাক্তার আপনাকে পরবর্তীতে আরও কিছু পরীক্ষা দিতে পারেন। যেমন—
- অটোঅ্যান্টিবডি পরীক্ষা: অটোঅ্যান্টিবডি হলো আমাদের শরীরে তৈরি হওয়া এমন এক ধরনের অ্যান্টিবডি যা দেহের নিজস্ব কোষগুলোকেই আক্রমণ করে। সাধারণত টাইপ ১ ডায়াবেটিস হলে রক্তে এ ধরনের বিশেষ অটোঅ্যান্টিবডি পাওয়া যায়।
- কিটোন বডি পরীক্ষা: এই পরীক্ষার মাধ্যমে প্রস্রাবে কিটোন বডি নামক রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। শরীরে মজুত চর্বি বা ফ্যাট ভেঙ্গে কিটোন বডি তৈরি হয়। প্রস্রাবে কিটোন বডির উপস্থিতি টাইপ ১ ডায়াবেটিস নির্দেশ করে।
টাইপ ১ ডায়াবেটিস শনাক্ত হলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এজন্য নিয়মিত রক্তে সুগারের মাত্রা পরিমাপ করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী ইনসুলিন নিতে হবে। ডাক্তারের কাছ থেকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নিন।
টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীদের যা জানা জরুরি
ডায়াবেটিস নরমাল কত পয়েন্ট
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর রক্তে সুগারের স্বাভাবিক মাত্রা কত পয়েন্টে থাকা উচিত তা ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। আপনার ব্লাড সুগার লেভেল অন্যদের থেকে ভিন্ন হলেও চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এক্ষেত্রে ডাক্তার পরামর্শ অনুযায়ী সুগারের লেভেল নিয়ন্ত্রিত থাকাই যথেষ্ট।
গ্লুকোমিটারের সাহায্যে রক্তের সুগার পরিমাপ করলে সাধারণত নিচের পয়েন্টগুলোকে আদর্শ ধরা হয়। ‘পয়েন্ট’ বলতে মিলিমোল/লিটার (mmol/l) এককটি বোঝানো হয়েছে।
খাওয়ার আগে | ৪ থেকে ৭ পয়েন্ট |
খাওয়ার ২ ঘন্টা পরে | ৮ থেকে ৯ পয়েন্ট |
ঘুমানোর আগে | ৬ থেকে ১০ পয়েন্ট |
রক্তের সুগারের মাত্রা তথা ডায়াবেটিসের মাত্রা যদি রোগীর জন্য আদর্শ পয়েন্টের চেয়ে বেড়ে যায় তখন সেই অবস্থাকে হাইপারগ্লাইসেমিয়া বলা হয়। অন্যদিকে এই মাত্রা যদি রোগীর জন্য নির্ধারিত আদর্শ পয়েন্টের চেয়ে কমে যায় তখন তাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলা হয়।
আপনার রক্তের সুগারের পরিমাণ বিভিন্ন কারণে প্রভাবিত হতে পারে। যেমন—
- মানসিক চাপ
- অসুস্থতা বা কোনো ইনফেকশন
- একেবারেই শারীরিক পরিশ্রম না করা অথবা অতিরিক্ত ব্যায়াম করা
- বিভিন্ন ধরনের ব্যথা
- মাসিক বা পিরিয়ড
- মদ পান করা
রক্তের সুগার কখন মাপবেন
প্রতিদিন নিচের সময়গুলোতে রক্তের সুগারের লেভেল মাপা উচিত—
- সকালের নাস্তার আগে
- খাওয়ার ২-৩ ঘন্টা পরে
- ব্যায়াম করার পূর্বে, মাঝখানে বিরতি চলাকালে ও ব্যায়ামের পরে
- ঘুমাতে যাওয়ার আগে
এভাবে নিয়মিত ব্লাড সুগার পরিমাপ করলে সুগারের লেভেল কীভাবে খাবার ও ব্যায়ামের প্রভাবে ওঠানামা করে তা বোঝা যাবে। এর ফলে ব্লাড সুগার একটি স্থিতিশীল মাত্রায় রেখে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।
তবে ডায়াবেটিস যদি একেবারেই অনিয়ন্ত্রিত থাকে অথবা রোগী অন্য কোনো অসুখে (যেমন: জ্বর, নিউমোনিয়া বা ডায়রিয়া) আক্রান্ত হয়, তাহলে আরও ঘন ঘন ব্লাড সুগার পরিমাপ করতে হবে। বিশেষত হাইপোগ্লাইসেমিয়ার কোনো উপসর্গ দেখা গেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রক্তের সুগার পরিমাপ করে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
রক্তের সুগার পরিমাপ করার পদ্ধতি
একটি গ্লুকোমিটার বা ডায়াবেটিস টেস্টিং কিটের সাহায্যে বাড়িতেই রক্তের সুগার কত পয়েন্ট তা নির্ণয় করা যায়। এক্ষেত্রে একটি সূক্ষ্ম সুঁইয়ের মত যন্ত্রের সাহায্যে আঙুলের ডগায় খোঁচা দেয়া হয়। রক্ত বেরিয়ে আসলে টেস্টিং স্ট্রিপে এক ফোঁটা রক্ত নিয়ে তা মিটারে ঢুকিয়ে সুগার পরীক্ষা করা হয়।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য নিয়মিত রক্তের সুগার পরিমাপ করা অত্যন্ত জরুরি। নিয়মিত সুগারের লেভেল পর্যবেক্ষণে রাখলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। ডায়াবেটিসের বিভিন্ন স্বাস্থ্য জটিলতা এড়াতে রক্তের সুগার মাপার যন্ত্রটি সবসময় হাতের কাছে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
বাসায় বসে ডায়াবেটিস মাপতে যা যা প্রয়োজন—
- ১. গ্লুকোমিটার
- ২. জীবাণুমুক্ত ছোট সুঁই বা ল্যানসেট
- ৩. সুঁই বসানোর প্লাস্টিকের কলম
- ৪. টেস্ট স্ট্রিপ
ফার্মেসিতে গ্লুকোমিটার কেনার সময়ে এগুলো একসাথে কিনে নেওয়া যায়।
ঘরোয়া উপায়ে রক্তের সুগার মাপার ৭টি ধাপ এখানে তুলে ধরা হলো—
১. প্রথমে সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। সাবানের পরিবর্তে অ্যালকোহল প্যাড বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়েও হাত জীবাণুমুক্ত করে নেওয়া যায়। তবে সেক্ষেত্রে আঙ্গুল পুরোপুরি শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
২. গ্লুকোমিটারের নির্ধারিত স্থানে একটি টেস্ট স্ট্রিপ প্রবেশ করাতে হবে। গ্লুকোমিটারের মডেলভেদে স্ট্রিপও ভিন্ন হয়, তাই নির্দিষ্ট মডেল অনুযায়ী সঠিক স্ট্রিপ বেছে নিতে হবে। এছাড়া স্ট্রিপ নকল বা মেয়াদোত্তীর্ন কি না সে বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে।
৩. প্লাস্টিকের কলমের ভেতরে একটি ল্যানসেট সংযুক্ত করে ল্যানসেটের ঢাকনা সরিয়ে ফেলতে হবে। উল্লেখ্য, প্রতিবার ডায়াবেটিস মাপার সময়ে নতুন সুঁই ব্যবহার করতে হবে। কলমটি সহজে ও সঠিকভাবে ব্যবহারের উপায় জানতে গ্লুকোমিটারের মোড়কে বা প্যাকেটের ভেতরে থাকা লিফলেটের নির্দেশনা অনুসরণ করুন।
৪. এবার কলমটি আঙুলের একপাশে ধরে সুঁই দিয়ে আঙ্গুলের অগ্রভাগে ছিদ্র করতে হবে। কলমটি আঙুলের একপাশে ধরলে ব্যথা কম লাগবে। প্রতিবার রক্তের সুগার মাপার সময়ে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গুল ব্যবহার করতে হবে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসা এক ফোঁটা রক্তই গ্লুকোমিটারে ডায়াবেটিস পরিমাপের জন্য যথেষ্ট।
৫. এখন গ্লুকোমিটারে লাগানো টেস্ট স্ট্রিপে রক্তের ফোঁটা বসাতে হবে। আঙুলটি এমনভাবে ধরতে হবে যেন রক্তের ফোঁটা টেস্ট স্ট্রিপের নির্ধারিত অংশকে পূর্ণ করে। রক্তের পরিমাণ খুব কম হলে ভুল রিডিং আসতে পারে অথবা গ্লুকোমিটারের পর্দায় ERROR দেখাতে পারে।
৬. কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গ্লুকোমিটারের পর্দায় রক্তের সুগারে তথা ডায়াবেটিসের পয়েন্ট দেখা যাবে। হিসাবটি সাধারণত mmol/l (মিলিমোল/লিটার) এককে দেখানো হয়। তবে কিছু গ্লুকোমিটারের হিসাবটি mg/dL (মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার) এককে দেখানো হতে পারে।
mg/dL এককে আসা ফলাফলকে ১৮ দিয়ে ভাগ করলে mmol/l এককে ফলাফল বেরিয়ে আসবে। একটি নির্দিষ্ট ডায়েরি বা খাতায় তারিখ ও সময় দিয়ে ফলাফল নোট করে রাখা ভালো।
৭. অবশেষে ব্যবহৃত সুঁই ও স্ট্রিপ ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিতে হবে।
নিয়মিত গ্লুকোমিটারের যত্ন নিন এবং নির্দেশনা অনুযায়ী পরিষ্কার করে রাখুন।
টাইপ ১ ডায়াবেটিসের চিকিৎসা
ইনসুলিন যেভাবে নিবেন
সাতটি সহজ ধাপে আপনি নিজে নিজে ঘরে বসে ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে পারেন। ধাপগুলো হলো—
১) হাত ভালোভাবে ধুয়ে শুকিয়ে নিন।
২) ইনজেকশনটি শরীরের কোন জায়গায় দিবেন তা ঠিক করুন। ইনসুলিন ইনজেকশন নেওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হল শরীরের চর্বিযুক্ত স্থান, যেমন: তলপেট (নাভির নিচের অংশ), উরু বা নিতম্ব।
প্রত্যেকবার ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ইনজেকশন নেওয়া জরুরী। আগে যেখানে ইনসুলিন নিয়েছেন তার থেকে থেকে অন্তত ১ সেন্টিমিটার বা আধা ইঞ্চি দূরে পরের ইনজেকশন দেওয়া উচিত। একই জায়গায় বারবার ইনজেকশন দিলে ওই জায়গাটি শক্ত হয়ে ফুলে যেতে পারে, যা পরবর্তীতে ইনসুলিন শোষণে এবং সঠিকভাবে কাজ করতে বাধা দিবে।
৩) ইনসুলিন পেন এর বাইরের ও ভেতরের ক্যাপ খুলে এতে সুঁইটি লাগিয়ে নিন। ডায়াল ঘুরিয়ে ২ ইউনিটে নিয়ে আসুন। এরপর পেনটিকে সোজা করে ধরুন।
যতক্ষণ পর্যন্ত সুঁইয়ের মাথায় ইনসুলিন না দেখা যায় ততক্ষণ পেনের পেছনে থাকা প্লাঞ্জারে ধীরে ধীরে চাপ দিন। এই কাজটিকে বলা হয় ‘প্রাইমিং’। সুঁই ও ইনসুলিন ভায়াল বা কার্তুজের ভেতরে কোনো বাতাস থাকলে তা এই পদ্ধতিতে বের করা যায়, ফলে ডোজ নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।
৪) এবার ডায়াল ঘুরিয়ে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নির্দিষ্ট ডোজটি বাছাই করুন। যেখানে ইনজেকশনটি নিবেন সেই স্থান পরিষ্কার ও শুকনো আছে কি না তা নিশ্চিত করুন।
৫) সমকোণে বা খাড়াভাবে (৯০ ডিগ্রী কোণে) সুঁইটি শরীরে প্রবেশ করান। ইনজেকশন দেওয়ার আগে ত্বক আস্তে চিমটি দিয়ে উঠিয়ে নিতে পারেন। যতক্ষণ পর্যন্ত ডায়ালটি ০ তে ফেরত না যায়, ততক্ষণ প্লাঞ্জারে চাপ দিয়ে ধরে রাখুন।
৬) সুঁইটি সরানোর আগে ইনসুলিন যেন শরীরে প্রবেশ করার যথেষ্ট সময় পায়, সেজন্য ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গুনে নিন। ত্বকে চিমটি দিয়ে রাখলে তা সরিয়ে নিন।
৭) সুঁইটি সরিয়ে নিরাপদ স্থানে ফেলে দিন।
রক্তে সুগার কমে যাওয়ার লক্ষণ ও করণীয়
রক্তে গ্লুকোজ তথা সুগারের পরিমাণ ন্যূনতম স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কমে গেলে তাকে ‘হাইপোগ্লাইসেমিয়া’ বলা হয়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের, বিশেষ করে ইনসুলিন নিতে হয় এমন ডায়াবেটিস রোগীদের, প্রায়ই হাইপোগ্লাইসেমিয়া দেখা দিতে পারে।
হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণ
হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণ একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হতে পারে। আপনার যদি বারবার সুগার কমে যাওয়ার ইতিহাস থাকে, তাহলে আপনি নিজেই হয়তো নিজের লক্ষণগুলো খেয়াল করলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হচ্ছে কি না তা বুঝতে পারবেন। তবে সময়ের সাথে আপনার লক্ষণগুলোতে ভিন্নতা আসতে পারে।
রক্তে সুগার কমে যাওয়ার লক্ষণগুলোর মধ্যে কিছু শুরুর দিকেই দেখা দেয়। সময়মতো চিকিৎসা শুরু না করলে খিঁচুনি ও জ্ঞান হারানোর মতো মারাত্মক কিছু অবস্থাও দেখা দিতে পারে।
শুরুর দিকের লক্ষণগুলো হলো—
- অতিরিক্ত ঘেমে যাওয়া
- ক্লান্ত অনুভব করা
- মাথা ঘুরানো
- ক্ষুধা লাগা
- ঠোঁটের চারিদিকে পিন বা সুঁই ফোটানোর মত অনুভূতি হওয়া
- শরীরে কাঁপুনি হওয়া
- বুক ধড়ফড় করা
- সহজেই বিরক্ত, অশ্রুসিক্ত, উত্তেজিত বা খামখেয়ালি হয়ে যাওয়া
- ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া
সুগার কমে গেলে ঘরোয়া চিকিৎসা
আপনার রক্তের সুগার যদি ৪ পয়েন্টের নিচে নেমে যায় অথবা হাইপোগ্লাইসেমিয়ার উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে নিচের কাজগুলো করুন—
- ধাপ ১: চিনিযুক্ত খাবার খান বা পানীয় পান করুন
একটি ছোট গ্লাসে কোমল পানীয় অথবা ফলের রস নিয়ে খান। বিকল্প হিসেবে ছোট এক মুঠ মিষ্টি বা চার-পাঁচটি ডেক্সট্রোজ ট্যাবলেট খেতে পারেন।
- ধাপ ২: ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর আপনার রক্তের সুগার পরিমাপ করুন
যদি এটি ৪ পয়েন্ট বা এর উপরে থাকে এবং আপনি আগের তুলনায় ভালো অনুভব করেন, তাহলে তৃতীয় ধাপে যান।
যদি রক্তের সুগার এখনো ৪ পয়েন্টের নিচে থাকে তাহলে আবার প্রথম ধাপে গিয়ে চিনিযুক্ত পানীয় বা খাবার খান। এর ১০-১৫ মিনিট পর আবার সুগার পরীক্ষা করুন।
- ধাপ ৩: যদি আপনার আহারের সময় হয়ে থাকে তাহলে শর্করাযুক্ত খাবারটি খান কিংবা শর্করাযুক্ত কোনো নাস্তা খান। নাস্তাটি হতে পারে একটি টোস্ট, কয়েকটি বিস্কুট অথবা এক গ্লাস দুধ।
আপনি যদি ভালো অনুভব করেন অথবা হাতেগোনা কয়েকবার হাইপোগ্লাইসেমিয়ার উপসর্গ দেখা দেয় তাহলে হাসপাতালে না গেলেও তেমন শঙ্কা নেই। কিন্তু যদি বারবার হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে থাকে অথবা রক্তে সুগার কমে যাওয়ার পরও আপনার কোনো লক্ষণ দেখা না দেয় তাহলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া সম্পর্কে আরও জানতে আমাদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া আর্টিকেলটি পড়ুন।
ডায়াবেটিস রোগীর গাড়ী চালানোর ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা
ডায়াবেটিস রোগীর যদি পেশাগত কারণে কিংবা নিত্যদিনের যাতায়াতে গাড়ি (যেমন: সিএনজি, মোটরগাড়ি, পিকআপ, বাস ও ট্রাক) চালাতে হয়, তাহলে নিচের ৩টি বিষয় নিশ্চিত করা উচিত—
- গাড়ী চালানোর পূর্বের ২ ঘন্টার মধ্যে ব্লাড সুগারের লেভেল পরিমাপ করা
- দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ি চালালে ২ ঘন্টা পর পর ব্লাড সুগারের লেভেল পরিমাপ করা
- যাত্রা শুরু করার সময়ে চিনিযুক্ত হালকা নাস্তা এবং কলা বা আটার রুটির মতো শর্করা জাতীয় খাবার সাথে রাখা
চলন্ত অবস্থায় যদি মনে হয় সুগারের মাত্রা কমে ‘হাইপো’ হয়ে গিয়েছে তাহলে—
- নিরাপদ স্থানে গাড়ি থামিয়ে ফেলতে হবে
- চাবি সরিয়ে নিয়ে গাড়ি বন্ধ করে রাখতে হবে
- চালকের আসন থেকে সরে যেতে হবে
- ব্লাড সুগারের লেভেল মাপতে হবে। যদি হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়ে থাকে তাহলে দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে হবে
- স্বাভাবিক বোধ করার পরে অন্তত ৪৫ মিনিট পর্যন্ত গাড়ি চালানো যাবে না
নিয়মিত চেকআপ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা
ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পরে নিয়মিত ডাক্তারের ফলো-আপে থাকতে হবে। কোনো প্রশ্ন থাকলে তা ডাক্তারের কাছ থেকে নিঃসংকোচে জেনে নিতে হবে।
ডায়াবেটিসের চেকআপে এমন কিছু পরীক্ষা রয়েছে যেগুলো ৬ মাস পরপর করানোর প্রয়োজন হয়। আবার কিছু পরীক্ষা আছে যেগুলো বছরে একবার করালেই হয়।
প্রতি ৬ মাসের পরীক্ষা
এই পরীক্ষাগুলোর মধ্যে রয়েছে রক্ত ও প্রস্রাবের পরীক্ষা। ডায়াবেটিস কতটুকু নিয়ন্ত্রণে আছে তা জানার জন্য এসব পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
সাধারণত ৬ মাস পরপর এসব পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেওয়া হলেও যাদের নতুন করে টাইপ ১ ডায়াবেটিস শনাক্ত হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এসব পরীক্ষা আরও ঘন ঘন করাতে হতে পারে। এসব পরীক্ষার মধ্যে রয়েছে—
- এইচবিএওয়ানসি পরীক্ষা (HbA1C Test): বিগত ২-৩ মাসে ব্লাড সুগার লেভেলের নিয়ন্ত্রণ কেমন ছিল তা জানার জন্য পরীক্ষাটি করানো হয়।
- কোলেস্টেরল (Cholesterol) পরীক্ষা: রক্তে চর্বির পরিমাণ জানার জন্য এই পরীক্ষাটি করানো হয়।
- কিডনির পরীক্ষা (Kidney Function Tests): কিডনি সঠিকভাবে কাজ করছে কি না দেখার জন্য এই পরীক্ষা করানো হয়।
- ইউরিনারি অ্যালবুমিন (Urinary Albumin): প্রস্রাবে অ্যালবুমিন নামক প্রোটিনের পরিমাণ দেখার জন্য পরীক্ষাটি করানো হয়।
এছাড়া রোগীর ওজন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আছে কি না সেটাও পরীক্ষা করে দেখা হয়। পরীক্ষার রিপোর্ট দেখানোর সুযোগে বাড়িতে গ্লুকোমিটারে মাপা সুগারের লেভেলের ব্যাপারেও ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে নিতে পারেন।
বাৎসরিক পরীক্ষা
চোখ পরীক্ষা
বছরে একবার চোখ পরীক্ষা করানো উচিত। এই পরীক্ষায় চোখের পেছনের অংশের একটি ছবি নেয়া হবে এবং ডায়াবেটিসের কারণে চোখে কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখা হবে।
এটি সাধারণ দৃষ্টিশক্তির পরীক্ষার চেয়ে আলাদা। কারণ এই পরীক্ষার মাধ্যমে আপনার চশমা প্রয়োজন কি না সেটি পরীক্ষা করা হয় না।
পায়ের পাতার পরীক্ষা
এক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো লক্ষ্য করতে হবে সেগুলো হলো—
- পায়ের পাতা অবশ হয়ে আসছে কি না
- পায়ে নতুন করে কড়া পড়ছে কি না
- পায়ের কোনো অংশে নতুন করে ইনফেকশন বা ঘা হয়েছে কি না
এই সমস্যাগুলোর কোনোটি দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
চিকিৎসায় পরিবর্তন
টাইপ ১ ডায়াবেটিস সনাক্ত হলে রোগীকে সাধারণত নির্দিষ্ট সময়ে প্রতি বেলার খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। সেই সাথে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ডোজের ইনসুলিন নিতে হয়।
সময়ের সাথে কেউ কেউ ডায়াবেটিসের ওপর ভালো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে নিজস্ব জীবনধারার সাথে মিল রেখে চিকিৎসায় কিছুটা পরিবর্তন আনা যেতে পারে। যার ফলে রোগী নিজের সুবিধামতো সময়ে আহার এবং সেই অনুযায়ী ইনসুলিন নিতে পারে। তবে চিকিৎসায় কোনো পরিবর্তন আনার পূর্বে ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে নিতে হবে।
হানিমুন পিরিয়ড
ডায়াবেটিস সনাক্ত হওয়ার বছরখানেক পর্যন্ত শরীরে কিছুটা ইনসুলিন তৈরি হতে পারে। এই সময়কে ‘হানিমুন পিরিয়ড’ বলা হয়। এই সময়কাল পার হয়ে গেলে রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমস্যা হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
দৈহিক পরিবর্তন
বয়স বাড়ার সাথে সাথে অথবা শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তন আসার কারণে ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। এসব দৈহিক পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে—
- ওজন কমে অথবা বেড়ে যাওয়া
- শারীরিক কোনো অসুস্থতা
- অসুস্থ হয়ে পড়া
- পিরিয়ড বা মাসিক
- গর্ভাবস্থা
- মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া (মেনোপজ)
- মানসিক চাপ
- অন্যান্য ঔষধের প্রভাব