পাইলস বা অর্শ রোগ

পাইলস একটি অতি পরিচিত স্বাস্থ্য সমস্যা। এটি অর্শ রোগ নামেও পরিচিত। অনেকেই এই সমস্যায় দীর্ঘদিন ভুগলেও এ ব্যাপারে পরামর্শ চাইতে বা ডাক্তার দেখাতে সংকোচ বোধ করেন। ক্ষেত্রবিশেষে পাইলস এর সঠিক চিকিৎসার বদলে হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি ঔষধ ও অন্যান্য টোটকা গ্রহণ করেন। এসব কারণে পাইলস ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করে। তাই পাইলস বা অর্শ রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে এ সম্বন্ধে সচেতন হওয়া জরুরি।

পড়ুন: কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার উপায় ঘরোয়া উপায়

পাইলস বা অর্শ রোগ কী?

পায়ুপথ বা পায়খানার রাস্তার মুখ যদি কোনো কারণে ফুলে যায় এবং সেখান থেকে রক্ত পড়ে কিংবা পায়খানার রাস্তায় যদি গোটার মত হয় তখন একে বলা হয় পাইলস। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম হেমোরয়েড। জটিল আকার ধারণ করার আগে অপারেশন ছাড়া অর্শ রোগের চিকিৎসা সম্ভব।

https://www.youtube.com/watch?v=u2ZvTnmOKbw&ab_channel=DrTasnimJara

পাইলস এর লক্ষণগুলো কী?

পাইলস বা অর্শ রোগের অন্যতম চারটি লক্ষণ নিচে তুলে ধরা হলো। এসব লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসা শুরু করা জরুরি।

১. পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া

পাইলস হলে পায়খানার সাথে উজ্জ্বল লাল বর্ণের অর্থাৎ তাজা রক্ত যেতে পারে। সাধারণত পায়খানার পরে টয়লেট পেপার ব্যবহার করলে সেখানে রক্তের ফোটা লেগে থাকতে পারে। অথবা কমোডে বা প্যানের গায়ে টকটকে লাল রক্তের ছোপ দেখা যেতে পারে।। পাইলস হলে পায়ুপথের মুখে থাকা অ্যানাল কুশনগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হয়। এই রক্ত বেরিয়ে গিয়ে জমাট বাধার সুযোগ পায় না। এ কারণে এক্ষেত্রে তাজা লাল রঙের রক্ত দেখা যায়।

কিন্তু যদি কোনো কারণে পায়খানার সাথে গাঢ় খয়েরী রঙের রক্ত যায়, বা আলকাতরার মতো কালো ও নরম পায়খানা হয়, তবে তা সাধারণত পাইলস এর কারণে নয়। পরিপাকতন্ত্রের কোনো অংশে রক্তপাতের কারণে পায়খানার সাথে এমন গাঢ় রক্ত যেতে পারে, তাই এমনটা হলে রক্তপাতের কারণ জানার জন্য দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।

২. পায়ুপথের মুখের অংশগুলো বেরিয়ে আসা

পাইল হলে সাধারণত মলত্যাগের পরে অ্যানাল কুশনগুলো নরম গোটার মতো বের হয়ে আসে। এগুলো কিছু সময় পর নিজে নিজেই ভেতরে ঢুকে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে এগুলো আঙ্গুল দিয়ে ভেতরে ঢোকানোর প্রয়োজন হতে পারে। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে পাইলস এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে আঙ্গুল দিয়েও গোটাগুলো ভেতরে ঢোকানো যায় না।

৩. পায়খানার রাস্তায় ব্যথা হওয়া

পাইলস রোগে সাধারণত তীব্র ব্যথা হয় না। তবে যদি পায়ুপথের গোটা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে সেগুলো আঙুল দিয়ে ঠেলেও ভেতরে ঢোকানো না যায়, এবং সেগুলোতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে অনেক সময় তীক্ষ্ণ বা তীব্র ব্যথা হতে পারে। এই ব্যথা সাধারণত ১-২ দিন স্থায়ী হয়। ব্যথা বেশি হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এছাড়া বিশেষ প্রয়োজনে ঘরোয়া উপায়ে ব্যথার চিকিৎসা করা যায়।

৪. পায়খানার রাস্তায় চুলকানি

পাইলস হলে কখনো কখনো পায়ুপথে বা এর মুখের আশেপাশে চুলকানি হতে পারে। এছাড়া পায়ুপথ দিয়ে মিউকাস বা শ্লেষ্মা-জাতীয় পিচ্ছিল ও আঠালো পদার্থ বের হতে পারে। অনেক সময় মলত্যাগ করে ফেলার পরও বারবার মনে হতে পারে যে পেট পরিষ্কার হয় নি, আবার মলত্যাগ করা প্রয়োজন।

পাইলস ও এনাল ফিসার-এর মধ্যে কিভাবে পার্থক্য করবেন? 

পাইলস ও এনাল ফিসার বা গেজ রোগের লক্ষণগুলোর মধ্যে কিছুটা মিল থাকলেও এই দুইটি পৃথক দুইটি রোগ। দুটি রোগেই পায়ুপথে চুলকানি হতে পারে এবং টাটকা লাল রক্ত যেতে পারে। তবে এনাল ফিসারে রক্ত খুব অল্প পরিমাণে যায়। পাইলস এবং এনাল ফিসার এই দুইটির মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে—

পাইলস হলে পায়ুপথে নরম গোটার মত দেখা দেয়। গোটাগুলো সাধারণত মলত্যাগের পরে বের হয়ে আসে, আবার কিছু সময় পর নিজে নিজেই ভেতরে ঢুকে যায় অথবা আঙ্গুল দিয়ে ভেতরে ঢোকাতে হয়। এছাড়া পাইলস হলে পায়ুপথে শ্লেষ্মার মতো দেখতে পিচ্ছিল কিছু পদার্থ বের হতে পারে।

এনাল ফিসার বা গেজ রোগের ক্ষেত্রে সাধারণত এসব লক্ষণ দেখা যায় না। আর এক্ষেত্রে প্রতিবার মলত্যাগের সময়ই তীব্র ব্যথা হয়। পাইলসে সাধারণত ব্যথা হয় না। 

এনাল ফিসার বা গেজ রোগের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে আমাদের আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।

পাইলস কেন হয়?

কিছু কিছু জিনিস পাইলস এর ঝুঁকি বাড়ায়, সেই সাথে ইতোমধ্যে কারো পাইলস রোগ হয়ে থাকলে তার তীব্রতাও বাড়িয়ে দেয়, যেমন—

  • শক্ত বা কষা পায়খানা
  • মলত্যাগের সময় জোরে চাপ দেয়া
  • অনেক সময় ধরে মলত্যাগের কসরত করা
  • পায়খানার বেগ আটকে রাখা
  • শারীরিক পরিশ্রম না করা 
  • অতিরিক্ত ওজন 

এছাড়া গর্ভাবস্থায় নানান শারীরিক পরিবর্তনের কারণেও কারও কারও ক্ষেত্রে পাইলস এর ঝুঁকি বেড়ে যায়।

স্বাভাবিক অবস্থায় পায়খানার রাস্তা বা পায়ুপথের মুখ সাধারণত বন্ধ থাকে। যখন প্রয়োজন হয়, তখন চাপ দিয়ে পায়ুপথের মুখ খুলে শরীর থেকে পায়খানা বা মল বের করে দেওয়া হয়।

পায়ুপথের মুখ বন্ধ রাখতে সেখানে বেশ কিছু জিনিস একসাথে কাজ করে। তার মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হল অ্যানাল কুশন। এই কুশনগুলো ৩ দিক থেকে চাপ দিয়ে পায়ুপথের মুখ বন্ধ রাখতে সাহায্য করে।

যদি কোনো কারণে তিন দিকের এই কুশনগুলো ফুলে যায়, সেগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হয়, সেগুলো নিচের দিকে নেমে যায়, অথবা পায়ুপথের চারপাশে গোটার মত দেখা যায়, তখন তাকে পাইলস বা অর্শ রোগ বলা হয়ে থাকে।

পাইলস এর ব্যথা সারানোর উপায়

পাইলস এর ব্যথা উপশম করতে প্যারাসিটামল ঔষধ খাওয়া যেতে পারে। এই ব্যথায় কার্যকরী অন্যান্য ঔষধ ও মলম পাওয়া যায়, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন। ঘরোয়া পদ্ধতিতে অর্শ রোগের ব্যথা কমানোর ৪টি উপায় নিচে তুলে ধরা হলো—

১. ব্যথার জায়গাটি কুসুম গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখা যায়। ছোট বাচ্চাদের গোসল করানো হয় এমন আকারের একটি বোলে কুসুম গরম পানি নিয়ে সেখানে বসতে পারেন। দিনে ৩ বার পর্যন্ত এটি করা যায়। অন্য সময়ে কোথাও বসতে গেলে একটি বালিশ ব্যবহার করে সেটার ওপর বসা যেতে পারে।

২. একটা প্যাকেটে কিছু বরফ নিয়ে সেটা তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে পায়ুপথে গোটাগুলোর ওপরে লাগানো যায়। এতে আরাম পাওয়া যাবে।

৩. বিছানায় শুয়ে পা উঁচু করে রাখলে পাইলস এর গোটাগুলোতে রক্ত চলাচল সহজ হবে ও ব্যথা উপশম হবে। শোবার সময় পায়ের নিচে বালিশ দিতে পারেন। এছাড়া খাটের পায়ার নিচে কোন কিছু দিয়ে খাটের এক পাশ উঁচু করে সেদিকে পা দেওয়া যেতে পারে।

৪. পায়ুপথ সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও শুকনো রাখতে হবে। মলত্যাগের পর জোরে ঘষাঘষি না করে আলতোভাবে জায়গাটি পরিষ্কার করে নিতে হবে। টয়লেট পেপার হালকা ভিজিয়ে তারপর সেটা দিয়ে মুছতে পারেন।

যেসব ব্যথানাশক ঔষধ ব্যবহার করা যাবে না

ট্রামাডল: এই ঔষধের একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কোষ্ঠকাঠিন্য, তাই অর্শ রোগের জন্য এটি খাওয়া যাবেনা। প্যারাসিটামল ও ট্রামাডল একত্রে আছে এমন ব্যথানাশকও এড়িয়ে চলতে হবে।

আইবুপ্রোফেন: এটি রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই আপনার পায়ুপথে ব্যথার সাথে রক্ত গেলে এটি খাওয়া যাবেনা। 

কখন দ্রুত হাসপাতালে যাবেন?

পাইলস হলে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। যেমন—

  • টানা ৭ দিন বাসায় চিকিৎসা নেয়ার পরেও অবস্থার উন্নতি না হলে
  • বারবার পাইলস এর সমস্যা হলে
  • ৫৫ বছরের বেশি বয়সী কারও প্রথমবারের মত পাইলস এর লক্ষণ দেখা দিলে
  • পাইলস থেকে পুঁজ বের হলে
  • জ্বর বা কাঁপুনি হলে, অথবা খুব অসুস্থ বোধ হলে
  • অনবরত রক্তক্ষরণ হলে
  • অত্যধিক রক্তপাত হলে (উদাহরণস্বরূপ, যদি কমোডের পানি লাল হয়ে যায় বা পায়ুপথ দিয়ে  রক্তের বড় বড় চাকা যায়)
  • তীব্র, অসহনীয় ব্যথা হলে
  • পায়খানার রঙ কালচে বা আলকাতরার মত কালো মনে হলে

পাইলস এর ঘরোয়া চিকিৎসা

পাইলস এর চিকিৎসা জন্য পাইলস হওয়ার কারণগুলো প্রতিরোধ করতে হবে। অর্শ রোগ সারানোর ৬টি কার্যকর ঘরোয়া উপায় নিচে তুলে ধরা হলো—

১. কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে বাঁচতে বেশি বেশি আঁশ বা ফাইবারযুক্ত খাবার খতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে শাকসবজি, ফলমূল, ডাল, লাল চাল ও লাল আটার তৈরি খাবার। সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। ফাইবার পানি শোষণ করার মাধ্যমে পায়খানা নরম করে, তাই ফাইবারকে কাজ করতে হলে সারাদিনে অন্তত দুই লিটার পানি পান করতে হবে।

এই দুটো কাজ করলে সাধারণত কয়েকদিনের মধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়, আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পাইলস এর সব ধরনের লক্ষণ উপশম হয়। ৬ সপ্তাহ অর্থাৎ দেড় মাস ধরে যদি খাবারে যথেষ্ট পরিমাণ ফাইবার নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ৯৫ শতাংশ পাইলস রোগীর পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া কমে আসে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ইসবগুলের ভুসি একটি কার্যকর ঔষধ।

প্রতিদিনের খাবারে ফাইবারের পরিমাণ বাড়ানো নিয়ে বিস্তারিত জানতে নিচের ভিডিওটি দেখতে পারেন।

https://www.youtube.com/watch?v=P56l76NNwmE&ab_channel=DrTasnimJara

২. মলত্যাগের সময় খুব জোরে চাপ দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। পায়খানা যাতে নরম হয় এবং সহজেই মলত্যাগ করা যায়, সেই উপদেশগুলো মেনে চলতে হবে।

৩. মলত্যাগে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা যাবে না। টয়লেটে বসে ম্যাগাজিন, পেপার, মোবাইল-এসবে মনোনিবেশ করা বাদ দিতে হবে।

৪. পায়খানার চাপ আসলে তা আটকে রাখা উচিত না, এতে পায়খানা আরও শক্ত হয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য  দেখা দেয়। চাপ আসলে দেরি না করে বাথরুমে চলে যেতে হবে।

৫. নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করতে হবে। ব্যায়ামের মধ্যে ভারী ব্যায়াম বা প্রতিদিন দৌড়ানো বেছে নিতে হবে, তা নয়। শরীরকে চলমান রাখতে হাঁটাচলা, হালকা স্ট্রেচিং, যোগব্যায়াম ইত্যাদির মধ্যে যেকোনোটাই বেছে নেওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে হাঁটাহাঁটি বা হালকা শরীরচর্চাও কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

প্রয়োজনে অল্প অল্প করে শুরু করতে পারেন। দিনে ২০ মিনিট হাঁটুন। এক বেলা দিয়ে শুরু করুন, এরপর সকাল-সন্ধ্যা দুই বেলা করে হাঁটুন। প্রথমে সপ্তাহে তিন দিন এভাবে হেঁটে আস্তে আস্তে সেটা পাঁচ দিনে নিয়ে আসুন। 

৬. ওজন অতিরিক্ত হলে তা কমিয়ে ফেলতে হবে। ওজন বেশী হলে পাইলস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে, তাই পাইলস এর রোগীদের ওজন কমানোর পরামর্শ দেয়া হয়। ওজন কমানোর কার্যকর উপায় নিয়ে বিস্তারিত জানতে আমাদের এ সংক্রান্ত আর্টিকেলগুলো পড়তে পারেন।

পাইলস এর অপারেশন

ঘরোয়া চিকিৎসার উপদেশ এবং ডাক্তারের ঔষধ সেবনের পরামর্শগুলো সঠিকভাবে মেনে চলার পরেও যদি অর্শ রোগের এর সমাধান না হয়, সেক্ষেত্রে অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে। এ ব্যাপারে আপনার চিকিৎসক আপনাকে পরামর্শ দিবেন। সাধারণত ৩ ধরনের অপারেশন করা হয়ে থাকে—

১. হেমোরয়েডেকটোমি: এই অপারেশনের মাধ্যমে পাইলস এর গোটাগুলো কেটে অপসারণ করা হয়। 

২. স্টেপলড হেমোরয়েডোপেক্সি: এই পদ্ধতিতে সার্জারির মাধ্যমে পাইলস এর গোটাগুলো পুনরায় পায়ুপথের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়।

৩. হেমোরয়েডাল আর্টারি লাইগেশন: এক্ষেত্রে পাইলস এর গোটাগুলোর রক্ত সরবরাহ অপারেশনের মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়া হয়, যাতে গোটাগুলো শুকিয়ে যায়।

এসব অপারেশনের জন্য সাধারণত এনেসথেসিয়া বা চেতনানাশক ব্যবহার করে রোগীকে অজ্ঞান করা হয় এবং সার্জারির পর দুই-একদিন হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন হতে পারে।