গর্ভাবস্থায় নাক দিয়ে রক্ত পড়া

গর্ভাবস্থায় নাক দিয়ে রক্ত পড়া খুব কমন এবং সাধারণত দুশ্চিন্তার কারণ নয়। ঘরোয়া কিছু উপায় অবলম্বন করে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।

গর্ভাবস্থায় মায়েদের শরীরে কিছু পরিবর্তন আসে যা নাক দিয়ে রক্ত পড়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। নাক থেকে রক্ত পড়লে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে যান। তবে গর্ভাবস্থায় এমনটা হওয়া খুব কমন এবং সাধারণত দুশ্চিন্তার কারণ নয়।[১] ঘরোয়া কিছু উপায় অবলম্বন করে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এই আর্টিকেলে গর্ভকালীন সময়ে নাক দিয়ে রক্ত পড়ার কারণ ও সমাধানগুলো সহজ ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে।

গর্ভকালের কোন সময়ে নাক থেকে রক্ত পড়তে পারে?

গর্ভাবস্থায় নাক থেকে রক্ত পড়ার কোনো নির্দিষ্ট সময়কাল নেই। এই সমস্যা গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে শুরু হয়ে পুরো গর্ভকাল জুড়ে চলতে পারে। গর্ভাবস্থায় কতদিন ধরে এই সমস্যা থাকবে সেটা গর্ভবতীর শারীরিক অবস্থা ও তার জীবনধারার মতো কিছু বিষয়ের সাথে জড়িত। তাই একেকজনের ক্ষেত্রে এই সময়কাল একেকরকম হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় নাক দিয়ে কেন রক্ত পড়ে?

গর্ভধারণের পর আপনার শরীরে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন হয়। এমন কিছু পরিবর্তনের কারণে গর্ভবতীদের নাক দিয়ে রক্ত পড়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।[২] গর্ভাবস্থায় নাক থেকে রক্ত পড়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—

১. শরীরে রক্তের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া: গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে রক্তের পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়।[৩] বাড়তি রক্ত প্রবাহের কারণে নাকের ভেতরের আবরণ কিছুটা ফুলে যায়।[৪] এ ছাড়া এই আবরণে চিকন চিকন, পাতলা রক্তনালী থাকে, যার সংখ্যাও বেড়ে যায়।[৫] রক্ত বেড়ে যাওয়াতে এগুলোও দুর্বল হয়ে যায়। সব মিলিয়ে ভেতরের আবরণ শুকিয়ে এবং রক্তনালী ফেটে গিয়ে রক্তক্ষরণ হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।

২. হরমোনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া: গর্ভাবস্থায় কিছু হরমোনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে আপনার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মতো নাকেও পরিবর্তন আসে। এসময়ে নাকের ভেতরের আবরণ পুরু হয়ে ওঠে এবং শুকিয়ে যায়। ফলে আবরণ থেকে সহজেই রক্তক্ষরণ হতে পারে।

৩. পানিশূন্যতা: গর্ভাবস্থায় শরীরের পানির চাহিদা বেড়ে যায়। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি না খাওয়া হলে সহজেই পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন তৈরি হতে পারে। এমন অবস্থায় আপনার নাকের ভেতরের আবরণ শুষ্ক হয়ে ফেটে যেতে পারে। এই কারণেও নাক থেকে রক্ত পড়তে পারে।

৪. এলার্জি অথবা ঠাণ্ডা-সর্দি: এলার্জি অথবা সর্দি হলে, নাকের ভেতরের আবরণে প্রদাহ হয়। ফলে সেখান থেকে সহজেই রক্তক্ষরণ হতে পারে।

উল্লেখ্য, গর্ভাবস্থায় নাক দিয়ে রক্ত পড়ার পাশাপাশি নাক বন্ধ থাকার সমস্যাও বেশ কমন।

নাক দিয়ে রক্ত পড়া তাৎক্ষণিক থামানোর উপায়

সহজ কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করে আপনি নাক থেকে রক্ত পড়া দ্রুত বন্ধ করতে পারেন। নাক থেকে রক্ত পড়লে করণীয়[৬]

  • শুয়ে না থেকে উঠে সোজা হয়ে বসুন অথবা দাঁড়ান। এতে করে নাকের রক্তনালীতে রক্তের চাপ কিছুটা কমে আসে, যা রক্তপাত কমাতে সাহায্য করে।
  • বসা অবস্থায় নাকের নরম অংশ, অর্থাৎ নাকের হাড়ের ঠিক নিচে ও নাকের ছিদ্রের ঠিক উপরের অংশটি নিচের ছবির মতো ভালোমতো চেপে ধরুন। নাকে ব্যথা না দিয়ে সর্বোচ্চ যতটুকু চাপ দেওয়া সম্ভব ততটুকুই চাপ দিবেন। এভাবে একটানা চাপ দিয়ে ১০–১৫ মিনিট ধরে থাকুন।
ছবি: নাক চেপে ধরা
  • মাথা কিছুটা সামনে ঝুঁকান এবং মুখ দিয়ে শ্বাস নিন। এতে করে রক্ত গলার ভেতর দিয়ে না নেমে নাক দিয়ে বের হয়ে যাবে। এভাবে রক্ত গিলে ফেলার সম্ভাবনা কমানো যাবে।
  • একটা রুমালে ফ্রোজেন মটরশুঁটি, কোনো সবজির প্যাকেট কিংবা আইস প্যাক পেঁচিয়ে নাকের ওপর ধরে রাখতে পারেন। এটি নাকের রক্ত প্রবাহ কমিয়ে রক্ত পড়া থামাতে সাহায্য করতে পারে।
  • যদি এসব উপায়ে রক্ত পড়া বন্ধ না হয় তাহলে জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

নাক থেকে রক্ত পড়া থেমে যাওয়ার পর কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা নাক ঝাড়া, নিচে ঝুঁকে কিছু করা ভারী কাজ করা ও গরম পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করবেন।

গর্ভাবস্থায় নাক দিয়ে রক্ত পড়া প্রতিরোধের উপায়

নাক থেকে রক্ত পড়া প্রতিরোধে আপনি নিচের ঘরোয়া উপায়গুলো অবলম্বন করতে পারেন—

১. নাকের ভেতরের আবরণকে শুষ্কতা থেকে রক্ষা করুন: নাকের ভেতরের আবরণ শুষ্ক হয়ে গেলে সেখানে রক্তনালী ফেটে গিয়ে রক্তক্ষরণ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই নাকের ভেতরটাকে ভেজা ভেজা রাখতে পারলে নাক থেকে রক্ত পড়ার প্রবণতা কমে আসতে পারে। নাককে শুষ্কতা থেকে রক্ষা করার জন্য—

  • নাকের ভেতর হালকা করে স্যালাইন ড্রপ বা স্প্রে ও ভ্যাসলিন ব্যবহার করুন। তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অন্য কোনো নাকের ড্রপ বা ঔষধ ব্যবহার করবেন না।[৭]
  • পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার খেয়ে নিজেকে পানিশূন্যতা থেকে রক্ষা করুন। একজন সুস্থ-স্বাভাবিক গর্ভবতীর প্রতিদিন গড়ে ২–৩ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। কাপ কিংবা গ্লাসের হিসাবে আপনাকে সারাদিনে মোট ৮–১২ গ্লাস পানি পান করতে হবে। তবে এই বিষয়ে কখনো যদি ডাক্তার কোনো বিশেষ পরামর্শ দিয়ে থাকেন তাহলে সেটিই অনুসরণ করবেন।
  • শুষ্ক বাতাস নাকের ভেতরের ত্বককে আরও শুষ্ক করতে পারে। শীতকালে রুমের বাতাসকে আর্দ্র রাখতে হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করতে পারেন।[৮]

২. নাকের আবরণকে আঘাত থেকে রক্ষা করুন: নাকের ভেতর হালকা আঘাত থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যেতে পারে। তাই যত্নের সাথে ছোটোখাটো আঘাত থেকে নাককে রক্ষা করুন। যেমন—

  • নাক ঝাড়ার সময় খুব জোরে না ঝেড়ে আলতোভাবে ঝাড়ুন
  • প্রয়োজন ছাড়া বার বার নাক ঝাড়ার অভ্যাস থাকলে তা পরিত্যাগ করুন
  • নাক খুঁটানো থেকে বিরত থাকুন

৩. নাকের ভেতর চাপ কমানোর জন্য মুখ খুলে হাঁচি দিন: হাঁচি দেওয়ার সময় মুখ খোলা রাখলে নাকের ওপর কম চাপ পড়ে। এটা রক্ত পড়ার প্রবণতা কমাতে সাহায্য করতে পারে।

৪. ঠাণ্ডা-সর্দি অথবা অ্যালার্জির জন্য চিকিৎসা নিন: সর্দি অথবা অ্যালার্জি থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। সঠিক চিকিৎসা নিলে নাক বন্ধ থাকা ও রক্ত পড়ার সম্ভাবনা কমে আসবে।

কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?

সাধারণত গর্ভাবস্থায় কখনো কখনো নাক থেকে সামান্য রক্ত পড়া স্বাভাবিক এবং ঘরোয়াভাবেই এর সমাধান করা যায়। তবে কোনো কোনো পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। যেমন—

  • যদি ১০–১৫ মিনিটের বেশি সময় ধরে নাক দিয়ে রক্তপাত হয়
  • যদি ঘন ঘন নাক থেকে রক্তপাত হয়
  • যদি ভারী রক্তপাত হয়[৯]
  • যদি এত বেশি রক্ত গিলে ফেলেন যে বমির উদ্রেক হয়
  • যদি মাথায় আঘাত পাওয়ার পর থেকে নাক দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে
  • যদি মাথা ঘুরায় অথবা দুর্বল লাগে
  • যদি বুকে ব্যথা অথবা শ্বাসকষ্ট হয়
  • যদি উচ্চ রক্তচাপ থাকে

এ ছাড়া নাক দিয়ে রক্ত পড়ার সাথে অন্য কোনো লক্ষণ (যেমন: নাকে ব্যথা অথবা মাথা ব্যথা) থাকা স্বাভাবিক নয়। সুতরাং নাক দিয়ে রক্ত পড়ার পাশাপাশি যদি আপনার এই লক্ষণগুলো থাকে তাহলেও দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

গর্ভাবস্থার যেকোনো সময়ে আপনার নাক থেকে রক্ত পড়ার অভিজ্ঞতা হয়ে থাকলে পরবর্তী গর্ভকালীন চেকআপে বিষয়টি ডাক্তারকে জানাবেন। সাধারণত গর্ভাবস্থায় নাক দিয়ে রক্ত পড়া তেমন শঙ্কার কারণ না হলেও কখনো কখনো তা কিছু গর্ভকালীন জটিলতার লক্ষণ হতে পারে। ডাক্তারকে বিষয়টি জানিয়ে রাখলে তিনি আপনাকে পর্যবেক্ষণ করে উপযুক্ত পরামর্শ দিতে পারবেন।

গর্ভাবস্থায় নাক থেকে রক্ত পড়া কেমন হয়?

গর্ভবতী অবস্থায় কোনো একদিন হঠাৎ করেই আপনার নাক থেকে রক্ত পড়া শুরু হতে পারে এবং এতে আপনি খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়তে পারেন, এটাই স্বাভাবিক। নাক দিয়ে রক্ত পড়ার স্থান, সময় ও পরিমাণে ব্যাপক ভিন্নতা থাকতে পারে। যেমন—

  • নাকের যেকোনো এক পাশের ছিদ্র দিয়ে রক্ত পড়তে পারে অথবা একসাথে দুই পাশের ছিদ্র দিয়েও পড়তে পারে।
  • রক্তপাত হালকা অথবা ভারী হতে পারে।
  • কয়েক সেকেন্ড রক্ত পড়ার পর রক্তপাত থেমে যেতে পারে। আবার ১০ মিনিট বা তার বেশি সময় ধরেও রক্ত পড়তে পারে।
  • ঘুমন্ত অবস্থায় নাক দিয়ে রক্ত পরতে পারে। শুয়ে থাকা অবস্থাতে নাক থেকে রক্ত পড়লে প্রথমে গলার পেছনের দিকে রক্ত জমা হওয়ায় তরল কিছুর অনুভূতি পেতে পারেন।