গর্ভাবস্থায় যোনিপথে মিউকাস প্লাগ বেরিয়ে আসা

প্রসবের সময় হয়েছে কি না তা বোঝার কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষণ রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো যোনিপথে মিউকাস প্লাগ বেরিয়ে আসা।[১] মিউকাস প্লাগ বেরিয়ে আসা মানেই প্রসব শুরু হয়ে যাচ্ছে এমনটা নয়, তবে এটি চিনতে পারা প্রসবের প্রস্তুতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মিউকাস প্লাগ কী?

মিউকাস প্লাগ বলতে জেলির মতো ঘন স্রাবের একটি থোকাকে বুঝায় যা গর্ভাবস্থায় আপনার জরায়ুমুখে জমা হয় এবং এর বাইরের মুখটিকে বন্ধ করে রাখে।[২] এই স্রাবের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে যা একে স্বাভাবিক স্রাবের চেয়ে আলাদা করে।[৩]

আপনার সন্তান জরায়ুর ভেতর মোটামুটি জীবাণুমুক্ত একটি পরিবেশে বড় হয়। মিউকাস প্লাগের কাজ হলো যোনি বা এর বাইরের জীবাণু ও ইনফেকশন থেকে জরায়ুমুখকে এবং সেই সাথে গর্ভের সন্তানকে সুরক্ষা দেওয়া।[৪]

এই মিউকাস প্লাগ এমনভাবে তৈরি যাতে এটি গর্ভের ভেতরে জীবাণুর বিস্তার প্রতিরোধ করতে পারে এবং জরায়ুমুখ দিয়ে জীবাণু প্রবেশে বাঁধা দিতে পারে। এসব জীবাণু গর্ভে প্রবেশ করলে গর্ভের শিশুর অকাল প্রসবের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। গবেষণায় দেখা যায় প্রায় ২৫ শতাংশ অকাল প্রসবের পেছনে এধরণের ইনফেকশন ভূমিকা রাখে।[৫]

মিউকাস প্লাগ কখন বের হয়?

সন্তান প্রসবের জন্য যখন জরায়ুমুখ প্রসারিত হতে বা বড় হতে শুরু করে তখন আপনার স্রাবের থোকা বা মিউকাস প্লাগ যোনিপথে বের হয়ে আসে। সাধারণত গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহের পর জরায়ুমুখ প্রসারিত হতে শুরু করে। তাই সাধারণত গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহের পর জরায়ুমুখে থাকা মিউকাস প্লাগ প্রসবের রাস্তা দিয়ে বের হয়ে আসে।

তবে মিউকাস প্লাগ বের হওয়ার পর প্রসব প্রক্রিয়া শুরু হতে আরও অনেক সময় লাগতে পারে। আবার কারো ক্ষেত্রে প্রসব প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরও মিউকাস প্লাগ বের হতে পারে। তবে কোনো কারণে ৩৭ সপ্তাহের আগে যোনিপথে মিউকাস প্লাগ বেরিয়ে আসলে তা অকাল প্রসবের লক্ষণ হতে পারে। তাই এমনটা হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

মিউকাস প্লাগ বের হওয়ার কারণ

গর্ভাবস্থায় মিউকাস প্লাগ যেসব কারণে বের হয়ে যেতে পারে তার মধ্যে রয়েছে—

জরায়ুমুখের প্রসারণ: প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসলে জরায়ুমুখ প্রসারিত হতে শুরু করে। জরায়ুমুখের প্রসারণের সাথে সাথে মিউকাস প্লাগ জরায়ুমুখ থেকে নেমে যোনিতে চলে আসে। ফলে যোনিপথে নির্গত স্রাবের পরিমাণ হঠাৎ স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায়। আবার অনেকের ক্ষেত্রে পুরো মিউকাস প্লাগ বা স্রাবের থোকাটি একবারেই বেরিয়ে আসতে পারে।[৬]

জরায়ুমুখের অস্বাভাবিকতা বা সার্ভাইকাল ইনসাফিশিয়েন্সি: আপনার জরায়ু কিংবা জরায়ুমুখে কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা থাকলে তা অনেকসময় জরায়ুর ভেতরে ফিটাস বা শিশুটিকে ধরে রাখতে পারে না। এমন অবস্থায় জরায়ুমুখে থাকা মিউকাস প্লাগ কিংবা জরায়ুর ভেতরে থাকা শিশু অনেকসময় সময়ের আগেই বেরিয়ে আসতে পারে।

সহবাস: গর্ভাবস্থায় সহবাস ক্ষতিকর নয়। তবে গর্ভাবস্থার শেষের দিকে সহবাসের ফলে মিউকাস প্লাগ ছুটে আসার আশঙ্কা থাকে। ৩৭ সপ্তাহের পরে মিউকাস প্লাগ বের হয়ে আসলে সেটি সাধারণত কোনো সমস্যা তৈরি করে না। তবে তার আগে হয়ে থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

জরায়ুমুখের পরীক্ষা:  গর্ভাবস্থায় জরায়ুমুখ পরীক্ষা করার সময় অসাবধানতাবশত কখনো কখনো স্রাবের থোকা বেরিয়ে আসতে পারে। তবে সচরাচর এমনটা হয় না। তাই এ নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। 

মিউকাস প্লাগ দেখতে কেমন হয়?

মিউকাস প্লাগ দেখতে কিছুটা স্বাভাবিক স্রাবের মতো। এর রঙ পানির মতো পরিষ্কার অথবা সাদা কিংবা হলদে হতে পারে। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে এটি হালকা গোলাপিও হতে পারে অথবা সাদার সাথে কিছুটা লালচে ভাব থাকতে পারে। এর কারণ হলো জরায়ুমুখ প্রসারিত হতে শুরু করলে অনেকসময় কিছুটা রক্তপাত হতে পারে যা এর সাথে মিশে যায়।

তবে হালকা লালচে অথবা গোলাপি ভাবের পরিবর্তে যদি স্রাব টকটকে লাল হয়ে থাকে বা বেশি রক্ত মিশ্রিত বলে মনে হয়, সেক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। রক্ত বের হওয়া গুরুতর কোনো সমস্যার (যেমন: গর্ভফুলের অকাল ছুটে আসার বা প্ল্যাসেন্টাল এবরাপশন) লক্ষণ হতে পারে।

কিছু গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে একসাথে পুরো মিউকাস প্লাগ বের হয়ে আসে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে স্রাব সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বের হয়। যার ফলে অনেকে মিউকাস প্লাগ বের হওয়ার বিষয়টা খেয়াল নাও করতে পারেন। তবে এতে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।

মিউকাস প্লাগ ও সাধারণ স্রাবের পার্থক্য

আপনার গর্ভাবস্থার পুরো সময় জুড়েই যোনিপথ দিয়ে কিছু স্রাব বের হওয়াটা স্বাভাবিক। এই স্রাব সাধারণত পাতলা ও সাদা বা হলদে হয়ে থাকে। অন্যদিকে মিউকাস প্লাগ যা প্রসব প্রক্রিয়ায় জরায়ুমুখ বড়ো হওয়ার ফলে বের হয় সেটি অনেক ঘন হবে এবং পরিমাণেও বেশি হবে।

মিউকাস প্লাগ বের হয়ে গেলে করণীয়

যদি গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহের পর স্রাবের থোকা বের হয় তাহলে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। মিউকাস প্লাগ বের হওয়ার কয়েক দিন অথবা সপ্তাহ পরে সক্রিয় প্রসব শুরু হতে পারে। আবার প্রসব প্রক্রিয়ার মধ্যেই মিউকাস প্লাগ বের হয়ে আসতে পারে। তাই শান্ত ও সচেতন থেকে অপেক্ষা করাই শ্রেয়।

মিউকাস প্লাগ বের হয়ে যাওয়ার পরেও আপনার জরায়ুমুখে স্রাব তৈরি হতে থাকে। যা গর্ভের সন্তানের সুরক্ষা অটুট রাখে। তাই এমন অবস্থায় আপনি স্বাভাবিক জীবনযাপন—এমনকি সহবাসও করতে পারেন।

তবে মিউকাস প্লাগের রঙ, গন্ধ ও ঘনত্ব খেয়াল করতে হবে। যদি স্রাবের রঙ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি লাল হয়ে থাকে সেটা যোনিপথে রক্তক্ষরণের লক্ষণ হতে পারে। আবার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলুদ অথবা সবুজ কিংবা দুর্গন্ধযুক্ত হলে সেটি ইনফেকশনের লক্ষণ হতে পারে।

যদি ৩৭ সপ্তাহের আগেই মিউকাস প্লাগ বের হয় এটি অকাল প্রসবের লক্ষণ হতে পারে। এক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন। চিকিৎসক প্রয়োজনে আপনাকে প্রসবের আগ পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিতে পারেন।