গর্ভাবস্থায় তীব্র ঘ্রাণশক্তি

সাধারণত তীব্র ঘ্রাণের এই সমস্যাটি গর্ভাবস্থার প্রথমদিকেই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। গর্ভাবস্থার শেষের দিকে এটি সাধারণত কমে আসে।

রান্নাঘরে ঢোকার আগেই কি আপনি বুঝে যাচ্ছেন কী রান্না হয়েছে? মাছের গন্ধে কি আপনার পেট মোচড় দিয়ে উঠছে? 

গর্ভধারণ করার পরে অনেক নারীর ঘ্রাণশক্তি আগের চেয়ে তীব্র হয়ে পড়ে।[১] যেই গন্ধগুলো হয়তো আগে তেমন বোঝা যেত না কিংবা খেয়াল হতো না, সেগুলোও নাকে এসে লাগে।[২] ডাক্তারি ভাষায় একে ‘হাইপারঅসমিয়া’ বলা হয়।

গর্ভধারণ করলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন ঘটে এবং বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা যায়। ঘ্রাণশক্তি আগের চেয়ে তীব্র হয়ে পড়াও এমনই একটি উপসর্গ।

গর্ভাবস্থায় ঘ্রাণশক্তি কখন তীব্র হতে শুরু করে?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে নারীরা ঘ্রাণশক্তি তীব্র হয়ে ওঠার বিষয়টি লক্ষ করেন।[৩][৪] আপনি এসময়ে ঘ্রাণশক্তি তীব্র হয়ে ওঠার পাশাপাশি কখনো কখনো অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছেন বলে মনে হতে পারে। আবার কখনো কখনো কোনো উৎস ছাড়াই নাকে গন্ধ লাগতে পারে।

ঘ্রাণশক্তির এসব পরিবর্তন গর্ভাবস্থার পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে অনেকটাই কমে আসে।[৫] আর সন্তান জন্মদানের পরে প্রায় একেবারেই চলে যায়।[৬]

ঘ্রাণশক্তি তীব্র হয়ে যাওয়ার ফলে গর্ভাবস্থায় আপনার মুখের স্বাদেও পরিবর্তন আসতে পারে। মুখের ভেতরে টক টক কিংবা তেতো লাগতে পারে। আবার কোনো খাবারই সুস্বাদু লাগছে না—এমনও হতে পারে।

এ ছাড়া গর্ভাবস্থায় ঘ্রাণশক্তি তীব্র মনে হওয়ার সাথে বমি বমি ভাব বেড়ে যাওয়ার একটি সম্পর্ক থাকতে পারে।[৭][৮] গর্ভধারণের কারণে হওয়া বমি বমি ভাব এবং গর্ভবতী মায়েদের ঘ্রাণশক্তি বেড়ে গিয়েছে বলে মনে হওয়া—দুটোই গর্ভাবস্থার প্রথম সপ্তাহগুলোতে ঘটে।

কী কারণে ঘ্রাণের তীব্রতা তৈরি হয়?

গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন জিনিসের স্বাভাবিক গন্ধও মায়েদের কাছে তীব্র মনে হতে পারে। গর্ভাবস্থায় নারীদের ঘ্রাণশক্তি আক্ষরিক অর্থেই তীব্র হয়ে যাওয়ার পক্ষে তেমন জোরালো প্রমাণ পাওয়া না গেলেও অনেকেই গর্ভাবস্থায় নিজেদের ঘ্রাণশক্তি আগের চেয়ে তীব্র হয়েছে এমন অনুভব করেন।[৯]

ঘ্রাণশক্তির এমন পরিবর্তনের পেছনে এখনো কোনো স্পষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে গর্ভকালীন হরমোনগুলোর প্রভাবে এমন পরিবর্তন হতে পারে।[১০] হরমোনগুলো একদিকে আপনার ঘ্রাণশক্তির তীব্রতা বাড়িয়ে দিতে পারে। আবার নির্দিষ্ট কিছু গন্ধ—যেগুলো হয়তো আগে নাকে তেমন লাগত না—সেগুলো হয়তো এখন সহজেই ধরতে পারবেন।

ঘ্রাণের তীব্রতার সমস্যায় ঘরোয়া সমাধান

গর্ভধারণের আগে কখনোই সমস্যা হয়নি—এমন খাবারের কিংবা জিনিসের গন্ধেও গর্ভাবস্থায় নতুন করে বমি বমি লাগা শুরু হতে পারে। তাই আপনার কোন ধরনের গন্ধে সমস্যা হয় সেটি খেয়াল করুন। এরপর সেগুলো যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন।

তীব্র ঘ্রাণের অনুভূতি মোকাবেলায় কিছু সহজ ও ঘরোয়া উপায় এখানে তুলে ধরা হয়েছে—

১. সুগন্ধি সামগ্রী হাতের কাছে রাখা

যেসব জিনিসের ঘ্রাণ আপনার ভালো লাগে, সেসব জিনিস আশেপাশে রাখার চেষ্টা করুন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, লেবুর খোসার সুগন্ধ কিংবা আদার গন্ধ বমি বমি ভাব কমাতে সাহায্য করে।[১১][১২]

আবার কারও কারও হয়তো পুদিনা পাতা কিংবা দারুচিনির গন্ধে বমি বমি ভাব কমে আসে বলে মনে হয়। তাই এগুলো দিয়েও চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

২. মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার জন্য হাতে কিছু রাখা

ঘ্রাণ থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিলে অস্বস্তি কমতে পারে। মনোযোগ সরানোর জন্য চুইং গাম চিবাতে পারেন কিংবা লজেন্স চুষতে পারেন। এসময়ে অন্য কিছুর কথা ভাবার চেষ্টা করুন। নিজের পছন্দের কোনো গান কিংবা কবিতার কথা ভাবতে পারেন।

এ ছাড়া ছোটোখাটো কোনো কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারেন। হয়তো আলমারির একটা তাক অনেকদিন ধরে গোছানো হচ্ছে না, কিংবা টেবিলের ওপরে বইখাতা এলোমেলো হয়ে আছে। এগুলো একটু একটু করে গোছানোর চেষ্টা করতে পারেন।

৩. ফ্যান ছেড়ে দেওয়া এবং জানালা খুলে দেওয়া

আপনি যেখানে আছেন সেখানে বাতাস চলাচল করলে ঘ্রাণের তীব্রতা কমে আসতে পারে। তাই কোনো কিছুর গন্ধে অস্বস্তি লাগা শুরু করলে ফ্যান ছেড়ে দিন। ঘর থেকে গন্ধটা বের করে দিতে জানালা খুলে দিন।

৪. সাবান, শ্যাম্পু ও সুগন্ধি পরিবর্তন করা

অনেক নারীর গর্ভাবস্থায় কিছু কিছু সাবান, শ্যাম্পু্‌, সুগন্ধি, এমনকি টুথপেস্টের গন্ধ খারাপ লাগে। যে জিনিসে সমস্যা হচ্ছে সেটা এড়িয়ে চলুন। বিকল্প হিসেবে যে পণ্যের ঘ্রাণে আপনার সমস্যা হয় না সেটি ব্যবহার করুন। বাজারে এমন সাবান, শ্যাম্পু ও ডিওডোরেন্ট পাওয়া যায় যাতে গন্ধ নেই। সেগুলোও ব্যবহার করতে পারেন।

৫. রান্নার সময়ে সতর্কতা

গর্ভবতী নারীদের যেসব জিনিসের গন্ধে বেশি সমস্যা হয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো খাবার।[১৩]

খেয়াল করুন গর্ভাবস্থায় কোন খাবারগুলোর গন্ধ আপনার কাছে খারাপ লাগছে। সেগুলো রান্না করা এবং খাওয়া এড়িয়ে চলতে পারেন।

তবে একটি বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ রাখবেন—বেছে বেছে খাবার খাওয়ার কারণে নিজেকে যেন অল্প কয়েকটি খাবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে না ফেলেন। এতে করে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব দেখা দিতে পারে। তাই চেষ্টা করবেন ঘ্রাণের সমস্যা হলেও সুষম ও বৈচিত্র্যময় খাবার খেতে।

এ ছাড়া রান্নার সময়ে জানালা খোলা রেখে ফ্যান (বৈদ্যুতিক পাখা) ব্যবহার করতে পারেন, যাতে করে খাবারের গন্ধ বাতাস চলাচলের মাধ্যমে ঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে যায়। এই পরামর্শগুলো গন্ধে সংবেদনশীলতা সমাধানের পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব ঠেকাতেও কার্যকর।

৬. গরম খাবার এড়িয়ে চলা

গরম গরম খাবার থেকে সাধারণত ঘ্রাণ বেশি পাওয়া যায়।[১৪] তাই গরম খাবার না খেয়ে কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা করে খাবারটা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এলে খেতে পারেন। এতে গন্ধ কম লাগতে পারে।

৭. কাছের মানুষদের সাহায্য নেওয়া

আপনার যে ঘ্রাণে অস্বস্তি হয় সেটি আপনার আশেপাশের মানুষ না-ও জানতে পারে। তাদের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলুন। তাহলে প্রয়োজনে তারা আপনাকে সাহায্য করতে পারবে।

যেমন, ময়লার গন্ধে যদি আপনার অসুবিধা হয়, তাহলে তারা ময়লা ফেলার দায়িত্ব নিতে পারে। কিংবা তারা যদি এমন কোনো সুগন্ধি ব্যবহার করে যাতে আপনার অসুবিধা হচ্ছে, আপনি তাদের জানালে তারা হয়তো সেটা পাল্টে ফেলতে পারেন। বাড়ির ময়লাগুলো যে পাত্রে জমা করা হয়, সেটি খালি করতে পরিবারের সদস্যদের অনুরোধ করতে পারেন।

৮. জামা-কাপড় পরিচ্ছন্ন রাখা

কাপড়চোপড় ময়লা হলে সেখান থেকে ঘ্রাণে অস্বস্তি হতে পারে।[১৫] এমন হলে পরিষ্কার জামা-কাপড় পড়ুন। জামা-কাপড় নিয়মিত ধুয়ে রাখতে কারও সাহায্য নিতে পারেন।

৯. মাস্ক ব্যবহার

গন্ধযুক্ত কোনো স্থানে যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন। তাতে গন্ধ কিছুটা কম লাগতে পারে।

সাধারণ জিজ্ঞাসা

ঘ্রাণের তীব্র অনুভূতি কীভাবে প্রতিরোধ করা যাবে?

ঘ্রাণের তীব্র অনুভূতি প্রতিরোধ করার জন্য ওপরের ঘরোয়া উপায়গুলো অনুসরণ করতে পারেন। এতে বিভিন্ন জিনিসের গন্ধের সাথে মানিয়ে নেওয়া সহজ হতে পারে।

কখন ঘ্রাণশক্তি স্বাভাবিক হয়ে যাবে?

সাধারণত তীব্র ঘ্রাণের এই সমস্যাটি গর্ভাবস্থার প্রথমদিকেই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। গর্ভাবস্থার শেষের দিকে এটি সাধারণত কমে আসে।[১৬] তবে এরপরেও যদি ঘ্রাণশক্তি তীব্র মনে হয় অথবা বিভিন্ন জিনিসের গন্ধে সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হয় তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এতে ঘ্রাণশক্তির এমন পরিবর্তন অন্য কোনো রোগের লক্ষণ কি না সেটি নিশ্চিত হওয়া যাবে।