মাসিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ

নারীদের মাসিক বা পিরিয়ডের সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ঘটনাটি বেশ কমন, তাই অনেকেই বিষয়টি স্বাভাবিক ধরে নেন। কিন্তু এই সমস্যাটি দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে। দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত রক্তপাতের চিকিৎসা না নিলে তা স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ব্যাহত করতে পারে।

এছাড়াও এটি অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা সৃষ্টি করতে পারে। রক্তশূন্যতার কারণে দুর্বলতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে, যা ভবিষ্যতে জটিল আকার ধারণ করতে পারে। তাই পিরিয়ড চলাকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের সমস্যা থাকলে সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা জরুরি।

মাসিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের পেছনে সবসময় নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু ফাইব্রয়েড বা এন্ডোমেট্রিয়োসিসের মতো জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের কিছু রোগের কারণে এই সমস্যা হতে পারে। তাই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের লক্ষণ থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে চিকিৎসা শুরু করা উচিত। চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে ঔষধ, জন্মনিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত কিছু পদ্ধতি ও বিভিন্ন অপারেশন।

মাসিকে কতটুকু রক্তক্ষরণ হলে তা অতিরিক্ত ধরা হয়

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণকে নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন, কারণ একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম লক্ষণ দেখা দেয়। একজনের জন্য যা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বলে মনে হয় তা হয়তো আরেকজনের জন্য স্বাভাবিক।

মাসিক সাধারণত ২-৭ দিন বা গড়ে ৫ দিন স্থায়ী হয়। বেশিরভাগ নারীর ক্ষেত্রে মাসিক চলাকালে গড়ে ৬-৮ চা চামচের কাছাকাছি রক্তক্ষরণ হয়। ১৬ চা চামচ বা ৮০ মিলিলিটার পর্যন্ত রক্তপাতকে স্বাভাবিক ধরা হয়।

মাসিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের লক্ষণ

প্রতি মাসিকে যদি—

  • ৮০ মিলিলিটার বা এর অধিক রক্তক্ষরণ হয় অথবা
  • মাসিক ৭ দিনের বেশি স্থায়ী হয় অথবা
  • দুটো ঘটনাই ঘটে

তাহলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হচ্ছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

তবে সাধারণত রক্তপাতের পরিমাণ মেপে দেখার প্রয়োজন পড়ে না। বেশিরভাগ নারীরই মাসিকের সময় কতটুকু রক্তপাত তাদের জন্য স্বাভাবিক সেই বিষয়ে ধারণা থাকে। রক্তক্ষরণের পরিমাণে কোনো পরিবর্তন হলে তারা বিষয়টি খেয়াল করতে পারেন।

সহজে বোঝার সুবিধার্থে নিচের চারটি ব্যাপার ঘটছে কি না সেদিকে খেয়াল রাখুন—

  • ১) প্রত্যেক ১-২ ঘণ্টার মধ্যে স্যানিটারি পণ্য (ট্যাম্পন, প্যাড) পরিবর্তনের প্রয়োজন হওয়া
  • ২) ১ ইঞ্চির চেয়ে বড় বা কালচে রক্তের চাকা যাওয়া
  • ৩) রক্ত গড়িয়ে বিছানায় বা কাপড়ে লেগে থাকা, বিশেষ করে রাতে ঘুমের মধ্যে প্যাড ভিজে গিয়ে জামাকাপড় বা বিছানায় দাগ লাগা
  • ৪) দুটি স্যানিটারি পণ্য একত্রে ব্যবহারের প্রয়োজন হওয়া। যেমন: ২টি প্যাড বা ১টি ট্যাম্পন ও ১টি প্যাড।

মনে রাখার সুবিধার্থে নিচের তালিকাটি ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রয়োজনে ডাক্তারের সাথে সাক্ষাতের সময়ে সাথে করে নিয়ে যেতে পারবেন।

বাম দিকের কলামের তথ্যগুলোর সাথে মিলিয়ে মাসিকের কোন দিন কয়টি প্যাড বা ট্যাম্পন ব্যবহার করছেন তা লিখে রাখুন। এক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ শুরুর দিনটিকে মাসিকের ১ম দিন ধরা হয়েছে।

প্যাড বা ট্যাম্পন১মদিন২য়দিন৩য়দিন৪র্থদিন৫মদিন৬ষ্ঠদিন৭মদিন৮মদিন৯মদিন১০মদিন
সামান্য ভেজা
আংশিকভাবে ভেজা
পুরোপুরি ভেজা
রক্তের চাকা (হ্যাঁ/না)
সামান্য ভেজা
আংশিকভাবে ভেজা
পুরোপুরি ভেজা

কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে

যদি—

  • রক্তক্ষরণের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা হয়
  • রক্তক্ষরণের পরিমাণ বেড়ে যায়
  • মাসিক সংক্রান্ত অন্যান্য সমস্যা হয়, যেমন পেট ব্যথা বা দুই মাসিকের মাঝে রক্তক্ষরণ

তাহলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ডাক্তার আপনার রোগ ও স্বাস্থ্যের সামগ্রিক তথ্য জেনে কিছু শারীরিক পরীক্ষা করবেন। প্রয়োজনে তিনি রক্ত পরীক্ষাসহ অন্যান্য পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিবেন।

অতিরিক্ত মাসিক হওয়ার কারণ

পিরিয়ডের সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয় এমন নারীদের অর্ধেকের ক্ষেত্রেই সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে বেশ কয়েকটি রোগ ও কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি এই সমস্যার পেছনে দায়ী হতে পারে।

জরায়ুর ভেতরের প্রাচীরকে এন্ডোমেট্রিয়াম বলা হয়। মাসিক চলাকালীন সময়ে যোনিপথ দিয়ে এই স্তরটি নির্গত হয়, যা রক্তপাত হিসেবে দেখা যায়। পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যে আবার নতুন স্তর তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়াটি চক্রাকারে চলতে থাকে।

ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন নামক দুটি হরমোনের ভারসাম্য এই চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো কারণে এই ভারসাম্য নষ্ট হলে এন্ডোমেট্রিয়াম মোটা হয়ে যেতে পারে। তখন রক্তক্ষরণের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। বিভিন্ন রোগ ও চিকিৎসার ফলে মাসিক ভারী হয়ে যাওয়ার পেছনে এই হরমোন দুটির অসামঞ্জস্যতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অতিরিক্ত মাসিকের পেছনে দায়ী কিছু রোগ ও চিকিৎসা পদ্ধতি হলো—

জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের রোগ

  • ফাইব্রয়েড (Fibroid): এগুলো জরায়ুতে বেড়ে ওঠা এক ধরনের টিউমার। এসব টিউমার সাধারণত ক্যান্সারে রূপ নেয় না। ফাইব্রয়েড থাকলে মাসিকের সময়ে পেট ব্যথা, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণসহ বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।
  • এন্ডোমেট্রিয়োসিস (Endometriosis): এই রোগে জরায়ুর ভেতরের স্তরের মতো টিস্যু জরায়ুর বাইরে (যেমন: ডিম্বনালী বা ডিম্বাশয়ে) প্রতিস্থাপিত হয়। যদিও ব্যথাই এ রোগের প্রধান লক্ষণ, তবে সাথে সাথে পিরিয়ডে ভারী রক্তপাতও হতে পারে।
  • এডেনোমায়োসিস: এক্ষেত্রে এন্ডোমেট্রিয়ামের মতো টিস্যু জরায়ুর দেয়ালের ভেতরে ঢুকে যায়। এর কারণে মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের পাশাপাশি পেট ব্যথাও হতে পারে।
  • পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ (PID): প্রজননতন্ত্রের ইনফেকশন থেকে জরায়ু, ডিম্বনালী ও ডিম্বাশয়ে প্রদাহ হয়। এই রোগে তলপেটে ব্যথা, যৌন সহবাসের পরে কিংবা দুই মাসিকের মাঝে রক্তক্ষরণ, যোনিপথে দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব এবং উচ্চ শারীরিক তাপমাত্রার মতো লক্ষণ থাকতে পারে।
  • এন্ডোমেট্রিয়াল পলিপ: এটি জরায়ুর ভেতর অথবা জরায়ুমুখের এক ধরনের প্রবৃদ্ধি। এসব প্রবৃদ্ধি সাধারণত ক্যান্সারে রূপ নেয় না, কিন্তু ভারী রক্তপাতের পেছনে দায়ী হতে পারে।
  • জরায়ুর ক্যান্সার: একে এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সারও বলা হয়। লক্ষণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কমন হলো মাসিকের রাস্তা বা যোনিপথ দিয়ে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ। বিশেষত মেনোপজ বা মাসিক স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে এটি বেশি দেখা যায়।
  • পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS): এটি একটি পরিচিত রোগ। এই রোগে ডিম্বাশয়ের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয়। ফলে মাসিক অনিয়মিত হয় এবং মাসিক পুনরায় শুরু হওয়ার পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে বিশেষ সতর্কতা

গর্ভবতী অবস্থায় যোনিপথ দিয়ে রক্তক্ষরণ শঙ্কার কারণ হতে পারে। এক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

অন্যান্য অসুস্থতা

  • রক্ত জমাট বাঁধা সংক্রান্ত রোগ। যেমন: ভন উইলিব্র্যান্ড ডিজিজ (Von Willebrand disease)।
  • থাইরয়েডের রোগ। হাইপোথাইরয়েডিজম হলো থাইরয়েড গ্রন্থির একটি রোগ, যেখানে গ্রন্থিটি পর্যাপ্ত হরমোন নিঃসরণ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে ক্লান্তি, ওজন বৃদ্ধি, ডিপ্রেশন ও মাসিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের মতো সমস্যা দেখা দেয়।
  • ডায়াবেটিস

ঔষধ ও চিকিৎসা পদ্ধতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

কিছু ঔষধ ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় পিরিয়ডে ভারী রক্তপাত হয়। যেমন—

  • আইইউডি (Intrauterine Contraceptive Device) বা কপার টি: এটি একটি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। জরায়ুতে কপার টি প্রবেশ করানোর পরে প্রথম তিন থেকে ছয় মাস পিরিয়ডের সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে।
  • রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধের ঔষধ:  এ জাতীয় ঔষধের মধ্যে রয়েছে লো ডোজ অ্যাসপিরিন, ওয়ারফারিন, হেপারিন ও রিভারক্সাবান।
  • ক্যান্সারের চিকিৎসা: কেমোথেরাপিতে ব্যবহৃত কিছু ঔষধ।
  • বিভিন্ন হারবাল ঔষধ: জিনসেং (Ginseng), জিংগো (Ginkgo) ও সয়ার মতো হারবাল সাপ্লিমেন্ট মূলত দেহের হরমোনগুলোকে প্রভাবিত করে। ফলস্বরূপ মাসিকও প্রভাবিত হয়ে অতিরিক্ত রক্তপাত ঘটতে পারে।

বিস্তারিত জানতে পড়ুন: অতিরিক্ত মাসিক কেন হয়

মাসিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের চিকিৎসা

মাসিকের সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বন্ধ করার বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণ, রোগীর স্বাস্থ্যের সার্বিক অবস্থা ও পছন্দসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে ডাক্তার সবচেয়ে উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করবেন।

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে অনেকের আয়রনের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা হয়ে থাকে। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এটি সনাক্ত করা যায়। আয়রনের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা থাকলে আয়রন ট্যাবলেট সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়।

পিরিয়ডে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে—

ঔষধ ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি

  • ইন্ট্রাইউটেরাইন সিস্টেম (IUS): এটি ছোট, প্লাস্টিকের তৈরি একটি যন্ত্র যা জরায়ুতে প্রবেশ করানো হয়। এটি প্রজেস্টোজেন নামক হরমোন নিঃসৃত করার মাধ্যমে পিরিয়ডের সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের পরিমাণ কমিয়ে আনে।
  • হরমোনযুক্ত ঔষধ: কম্বাইন্ড ওরাল কন্ট্রাসেপটিভ পিল (জন্মনিয়ন্ত্রক বড়ি) ও সাইক্লিকাল প্রোজেস্টোজেন পিল।
  • অন্যান্য ঔষধ: ট্রানেক্সামিক এসিড ও নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগ (NSAIDs)

অপারেশন

  • এন্ডোমেট্রিয়াল অ্যাব্লেশন: এক্ষেত্রে জরায়ুর ভেতরের এন্ডোমেট্রিয়াম নামক প্রাচীরকে পাতলা করা, সরিয়ে ফেলা বা নষ্ট করে ফেলা হয়।
  • মায়োমেকটমি: এক্ষেত্রে জরায়ুর প্রাচীর থেকে ফাইব্রয়েড সরিয়ে ফেলা হয়।
  • ইউটেরাইন আর্টারি এম্বোলাইজেশন: এক্ষেত্রে ফাইব্রয়েডে রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালী আটকে দেওয়া হয়, ফলে ফাইব্রয়েড সংকুচিত হয়ে যায়।
  • হিস্টেরেকটমি: এই অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ু ফেলে দেওয়া হয়।

বিস্তারিত জানতে পড়ুন: অতিরিক্ত মাসিকের চিকিৎসা