মাসিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ: রোগ নির্ণয়

যদি মনে হয় মাসিক বা পিরিয়ডের সময় স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হচ্ছে অথবা আগের তুলনায় রক্তক্ষরণ বেড়ে গেছে তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। তিনি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণ অনুসন্ধান করে সেই অনুযায়ী উপযুক্ত চিকিৎসা নির্ধারণ করবেন।

অতিরিক্ত মাসিকে ডাক্তারের সাক্ষাৎ

পিরিয়ডের সময়ে কেন ভারী রক্তপাত হচ্ছে তা খুঁজে বের করতে ডাক্তার কিছু বিষয়ে প্রশ্ন করবেন। সুনির্দিষ্ট কারণটি খুঁজে বের করা সম্ভব হলে দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করা যাবে। তাই যথাসম্ভব সঠিকভাবে তথ্যগুলো জানানো প্রয়োজন।

এসব প্রশ্নের পর ডাক্তার আপনাকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। প্রয়োজনবোধে কিছু বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর পরামর্শও দিতে পারেন।

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণ খুঁজে বের করতে ডাক্তার নিচের বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন করবেন—

  • পূর্বের চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য (মেডিক্যাল হিস্ট্রি)
  • মাসিক চক্র সংক্রান্ত তথ্য। যেমন: মাসিক সাধারণত কত দিন স্থায়ী হয়, কী পরিমাণে রক্তক্ষরণ হয় ও কতক্ষণ পর পর স্যানিটারি পণ্য (প্যাড/স্যানিটারি ন্যাপকিন বা ট্যাম্পন) পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়ে ইত্যাদি
  • মাসিক সম্পর্কিত অন্যান্য তথ্য। যেমন: মাসিকের সময়ে পেটে ব্যথা হয় কি না অথবা দুই মাসিকের মাঝে রক্তক্ষরণ হয় কি না
  • দৈনন্দিন জীবনের ওপর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের প্রভাব

এসব তথ্য মনে রাখা সম্ভব না হলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে একটি কাগজে লিখে নিয়ে যেতে পারেন। অনেকদিন ধরে পিরিয়ডের সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে একটি পিরিয়ড ডায়েরি তৈরি করতে পারেন। সেখানে বিগত কয়েক মাসের পিরিয়ড সংক্রান্ত তথ্য একত্রে সংরক্ষণ করা যাবে।

এই প্রশ্নগুলো ছাড়াও ডাক্তার আপনাকে আরও কিছু প্রশ্ন করতে পারেন। যেমন—

  • আপনি কোন ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন
  • ভবিষ্যতে সন্তান জন্মদানের পরিকল্পনা আছে কি না
  • সর্বশেষ কবে জরায়ুমুখের স্ক্রিনিং পরীক্ষা করানো হয়েছে
  • পরিবারের কারও রক্ত জমাট বাঁধা সংক্রান্ত কোনো রোগ বা এরূপ স্বাস্থ্য সমস্যার ইতিহাস আছে কি না

জরায়ুমুখের ক্যান্সার বা সার্ভাইকাল ক্যান্সারের ঝুঁকি নির্ধারণে বিভিন্ন স্ক্রিনিং পরীক্ষা করা হয়। ভায়া (VIA – Visual Inspection with Acetic acid) নামের স্ক্রিনিং পরীক্ষাটি বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনামূল্যে করানো যায়।

অনেকের রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা দেয়, যা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ঘটাতে পারে। এসব সমস্যার পেছনে পারিবারিক সূত্রে হওয়া কিছু রোগের ভূমিকা থাকতে পারে।

এমন একটি রোগ হলো ভন উইলিব্র্যান্ড ডিজিজ (Von Willebrand Disease), যা পারিবারিক সূত্রে বিস্তার লাভ করে এবং রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।

এই রোগের কারণে মাসিকের সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হচ্ছে কি না তা বোঝার সুবিধার্থে পারিবারিক চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য জিজ্ঞেস করা হয়ে থাকে। 

অতিরিক্ত মাসিকে শারীরিক পরীক্ষা 

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণ নির্ণয় করার জন্য ডাক্তার নিচের শারীরিক পরীক্ষাগুলো করে দেখতে পারেন—

১. বাহ্যিক পরীক্ষা: পেটে চাপ দিয়ে অস্বাভাবিক কিছু আছে কি না তা অনুভব করা

২. জরায়ুমুখ পর্যবেক্ষণ: পর্যবেক্ষণের সুবিধার্থে যোনিপথের ভেতরের অংশটি উন্মুক্ত করতে হয়। এই উদ্দেশ্যে স্পেকুলাম (Speculum) নামক একটি যন্ত্র যোনিপথের ভেতরে ঢুকিয়ে এরপর জরায়ুমুখ দেখা হয়।

৩. যোনিপথের ভেতরে পরীক্ষা: একে ডাক্তারি ভাষায় পেলভিক এক্সামিনেশন বলা হয়। যোনিপথ দিয়ে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ডাক্তার এই পরীক্ষাটি করবেন। এভাবে জরায়ু বা ডিম্বাশয়ে স্পর্শ করলে ব্যথা হয় কি না অথবা সেগুলো বড় হয়ে গিয়েছে কি না তা বোঝা যায়।

২ ও ৩ নং পরীক্ষাটি আপনার জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে। তবে এসব পরীক্ষায় সাধারণত সাময়িক অস্বস্তি ছাড়া তেমন ব্যথা বা অন্য কোনো সমস্যা হয় না।

সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়ের জন্য এই পরীক্ষাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। তাই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকলে প্রক্রিয়াটি তুলনামূলকভাবে সহজ হবে। এ সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন থাকলে বা প্রক্রিয়াটি নিয়ে মনে অনিশ্চয়তা কাজ করলে ডাক্তারের সাথে আগেই কথা বলে নিন।

অতিরিক্ত মাসিকে রক্ত পরীক্ষা 

মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয় এমন সব রোগীরই রক্ত পরীক্ষা করানো উচিত। রক্ত পরীক্ষাটির নাম ফুল ব্লাড কাউন্ট বা কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট। তবে পরীক্ষাটি সাধারণ মানুষের কাছে সিবিসি নামে অধিক পরিচিত।

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে অনেকের আয়রনের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা হয়ে থাকে, যা এই পরীক্ষার মাধ্যমে সনাক্ত করা যায়। আয়রনের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা থাকলে আয়রন ট্যাবলেট সেবনের পরামর্শ দেওয়া হবে।

কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস, থাইয়রয়েডের সমস্যা-সহ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের অন্যান্য কারণ নির্ণয়ে কিছু রক্ত পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়।

বিশেষ দ্রষ্টব্য

মাসিকের সময়ে অতিরিক্ত রক্তপাতের কারণ খুঁজে বের করতে ক্ষেত্রবিশেষে ডিএনসি নামের একটি ছোট অপারেশনের পরামর্শ দেওয়া হতে পারে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, রোগ নির্ণয়ে ও অতিরিক্ত রক্তপাতের চিকিৎসায় এই পদ্ধতির ভূমিকা একেবারেই সীমিত। তাই আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলে আপনার জন্যে সঠিক পদক্ষেপটি বেছে নিন।

এছাড়া রক্ত জমাট বাঁধাজনিত সমস্যা নির্ণয়ের জন্য কিছু রোগীকে আরও রক্ত পরীক্ষা করতে দেওয়া হতে পারে।

এসব পরীক্ষা করানোর পরেও পিরিয়ড চলাকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণ বের করা সম্ভব না হলে আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর প্রয়োজন হতে পারে। পরীক্ষাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আলট্রাসনোগ্রাফি এবং হিস্টেরোস্কোপি।

এসব পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের বিভিন্ন রোগ (যেমন ফাইব্রয়েড ও এডেনোমায়োসিস) নির্ণয় করা যায়। সাধারণত বড় বড় হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এসব পরীক্ষা করানো হয়।

আলট্রাসনোগ্রাফি 

শারীরিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে দুই ধরনের আলট্রাসনোগ্রাফি করার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে:

১. পেলভিক আলট্রাসাউন্ড: এক্ষেত্রে তলপেটের বাইরে থেকে প্রোবের সাহায্যে জরায়ু, ডিম্বাশয়সহ অন্যান্য অঙ্গের পরীক্ষা করা হয়।

২. ট্রান্সভ্যাজাইনাল আলট্রাসাউন্ড: এক্ষেত্রে যোনিপথের ভেতর দিয়ে একটি ছোট প্রোব প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষা করা হয়। জরায়ুর আরও কাছে থেকে ও আরও স্পষ্ট ছবি তোলার জন্য এই পরীক্ষাটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

হিস্টেরোস্কোপি

এটি জরায়ুর ভেতরের অংশ পরীক্ষা করার একটি পদ্ধতি। এই পরীক্ষায় আলোর উৎস ও ক্যামেরাসহ একটি সরু টেলিস্কোপ যোনিপথ দিয়ে জরায়ুতে প্রবেশ করানো হয়। 

টেলিস্কোপের মাধ্যমে ছবিগুলো একটি মনিটরে পাঠানো হয়, যেন ডাক্তার জরায়ুর ভেতরের অংশ ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।

প্রক্রিয়াটি চলাকালীন সময়ে প্রয়োজনে একই সাথে জরায়ুর ভেতরের প্রাচীর থেকে ছোট একটি নমুনা সংগ্রহ করা হতে পারে। একে এন্ডোমেট্রিয়াল বায়োপসি বলে। জরায়ুতে কোনো টিউমার, পলিপ জাতীয় কোনো প্রবৃদ্ধি থাকলে সেখান থেকেও নমুনা সংগ্রহ করা হয়। 

নমুনাটি পরে ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে আরও কাছ থেকে পরীক্ষা করে জরায়ুর সমস্যা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়।