১২ সপ্তাহে ওজন কমানোর উপায়: দ্বিতীয় সপ্তাহ

ওজন কমানোর ২য় সপ্তাহে পৌঁছাতে পারায় আপনাকে অভিনন্দন। সামনের সপ্তাহগুলোতেও ওজন কমানোর ১ম সপ্তাহের উপদেশ অনুযায়ী স্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাস গড়ে তোলা চালিয়ে যেতে হবে। এই সপ্তাহ থেকে খাবারের পাশাপাশি শারীরিক পরিশ্রম এবং ব্যায়ামের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। এই দুইয়ের ভারসাম্য আপনার ওজন কমিয়ে আনতে সহায়তা করবে।

আপনি প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু না করে থাকলে, ১২ সপ্তাহে ওজন কমানোর উপায় এর প্রথম সপ্তাহের কার্যক্রম দেখুন।

এ সপ্তাহে যে অভ্যাসগুলো রপ্ত করবেন

১. এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট করে ব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। আপনার যদি একেবারেই শারীরিক পরিশ্রম করার অভ্যাস না থাকে, তাহলে আস্তে আস্তে প্রতিদিনের ব্যায়ামের পরিমাণ বাড়ান। এভাবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সাপ্তাহিক ১৫০ মিনিটের লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

২. সপ্তাহের সাতদিনের মধ্যে কোন দিনগুলোতে ব্যায়াম করবেন, দিনের কোন সময়ে কোন ধরনের ব্যায়াম করবেন, বাড়িতে ব্যায়াম করবেন নাকি পার্কে বা জিমে গিয়ে ব্যায়াম করবেন — এগুলো আগেভাগেই ঠিক করে রাখুন। যদি বিশেষ জুতা, ম্যাট বা অন্যান্য সামগ্রী প্রয়োজন হয়, তাহলে সেগুলো আগেই জোগাড় করে রাখুন। তাহলে ব্যায়াম না করার জন্য অজুহাত দেওয়ার উপায় থাকবে না।

৩. ব্যায়ামের পরে ২ গ্লাস পানি পান করে ফেলুন। এতে শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া পানির অভাব পূরণ হবে। অন্যদিকে ক্ষুধা নিবারণ হবে, ফলে ব্যায়ামের পরপর বেশি খাবার খেয়ে ফেলার সম্ভাবনা কমে যাবে।

৪. খাবার তৈরি করার সময় ভেজে খাওয়ার বদলে সেদ্ধ, ভাপে সেদ্ধ, গ্রিল বা পানিতে পোঁচ করে খাওয়ার অভ্যাস করুন। ডিম, মাছ, মাংস বা সবজি — সবই এভাবে খাওয়া যাবে। ভেজে খাওয়া খাবারে প্রচুর পরিমাণে তেল ব্যবহৃত হয়, যা অত্যন্ত ক্যালরিবহুল। অন্যদিকে গ্রিল, স্টিম বা সেদ্ধ করে খাওয়ার প্রক্রিয়ায় তেলের অতিরিক্ত ক্যালরি যুক্ত হয় না।

ওজন কমানোর ব্যায়াম

যেসকল ব্যায়াম ও শারীরিক কসরতের মাধ্যমে ওজন কমানো যেতে পারে তার কয়েকটি হচ্ছে—

  • হাঁটা
  • সাইকেল চালানো
  • বাগান করা
  • সাঁতার
  • নাচ
  • ব্যাডমিন্টন, ফুটবল, ইত্যাদি খেলাধুলা
  • ভারোত্তোলন
  • ইয়োগা বা যোগব্যায়াম এবং অন্যান্য স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ
  • জিমে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম করা

আপনার কোনো শারীরিক অসুস্থতা থাকলে কিংবা আগে থেকে হাত-পা, হাঁটু, মেরুদণ্ড বা কোমরে আঘাত অথবা কোনো সমস্যার ইতিহাস থাকলে ব্যায়ামের পরিকল্পনা করার সময় ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিন।

ওজন নিয়ন্ত্রণে যেভাবে ব্যায়াম করতে পারেন

গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে, যারা স্বাস্থ্যসম্মত ডায়েট মেনে চলার পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম করেন, তারা ওজন কমাতে বেশি সফল হন। কমানো ওজন ফেরত আসা প্রতিরোধ করতেও এই দুইয়ের সমন্বয় অধিক কার্যকর।

তবে অনেকেরই ব্যায়াম করার অভ্যাস থাকে না। তাই নতুন করে ব্যায়াম শুরু করাটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। ধীরে ধীরে দৈনিক পরিশ্রমের মাত্রা বাড়াতে হবে। প্রতিদিনের রুটিনে একটু একটু করে শারীরিক পরিশ্রম অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এর উদাহরণ হতে পারে লিফটের বদলে সিঁড়ির ব্যবহার, কম দূরত্বের পথ রিক্সায় চড়ার বদলে হেঁটে অতিক্রম করা, বাসে যাতায়াত করলে এক স্টপ আগে নেমে বাকি পথ হেঁটে যাওয়া, ইত্যাদি। এভাবে কিছুটা অভ্যাস হয়ে গেলে নিয়ম করে ব্যায়াম শুরু করা যায়। এক্ষেত্রে সাপ্তাহিক লক্ষ্য হলো কমপক্ষে ১৫০ মিনিট মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম করা।

মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম বলতে কী বোঝায়?

মাঝারি তীব্রতার শারীরিক কর্মকাণ্ডের সময় হৃৎস্পন্দন বা হার্টবিট বেড়ে যায়। একই সাথে শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুততর হয় এবং শরীর গরম হয়ে ওঠে। নিজে নিজে ব্যায়াম করার সময় মাঝারি তীব্রতায় পৌঁছেছেন কি না তা বোঝার একটা উপায় হলো, এরকম ব্যায়ামের সময় কথা বলা যাবে, কিন্তু গান গাওয়া সম্ভব হবে না।

মাঝারি তীব্রতার ব্যায়ামের উদাহরণের মধ্যে রয়েছে দ্রুত হাঁটা, সাঁতার কাটা এবং সাইকেল চালানো।  এছাড়া নতুন করে যারা শারীরিক পরিশ্রম শুরু করছেন, তাদের জন্য নিচের দুটি পদ্ধতি বেশ কার্যকর।

১. নির্দিষ্ট নিয়মমাফিক দৌড়ানো যেতে পারে। দৌড়ানোর জন্য আমাদের ৯ সপ্তাহে দৌড়ানোর অভ্যাস তৈরি করার উপায় অনুসরণ করতে পারেন। এই গাইডে জীবনে কখনও দৌড়ায় নি এমন পূর্ণবয়স্ক মানুষ কীভাবে নয় সপ্তাহের মধ্যে পাঁচ কিলোমিটার দৌড়ানোর অভ্যাস করতে পারেন তা সহজে তুলে ধরা হয়েছে। 

২. বাড়িতে বসে কোন আলাদা যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করতে পারেন। ইউটিউব বা গুগলে নিচের শব্দগুলো লিখে খুঁজলেই এ জাতীয় ব্যায়ামের নির্দেশনাযুক্ত অনেক ভিডিও পেয়ে যাবেন। এমন কিছু শব্দ হলো—

  • Pushup
  • Pullup
  • Plank
  • Squat

তবে যে পদ্ধতিই বেছে নেওয়া হোক, তা যেন উপভোগ করার মত হয়। উপভোগ্য না হলে এগুলো দীর্ঘমেয়াদি অভ্যাসে পরিণত করা সম্ভব হবে না। ব্যায়ামের সবগুলো অপশনের মধ্যে যেগুলো ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ হয়, সেগুলো ঘুরেফিরে করা যেতে পারে। এতে একঘেয়েমি আসবে না।

নতুন করে ব্যায়াম করা শুরু করলে বা শারীরিক পরিশ্রমের পরিমাণ বাড়িয়ে দিলে ক্ষুধা কিছুটা বেড়ে যেতে পারে। এমনটা হওয়া স্বাভাবিক, এতে চিন্তার কিছু নেই। ব্যায়ামের কারণে শরীর স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ক্যালরি খরচ করে, তাই সেই ঘাটতি পূরণ করতে হবে।

তবে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে যেন ব্যায়ামের পর ক্যালরিবহুল খাবার (চিনি দেওয়া জুস,শরবত, মিল্কশেক, ভাজাপোড়া, কেক-বিস্কুট, ইত্যাদি) খাওয়া না হয়। এগুলো খেলে ওজন কমার বদলে উল্টো বেড়ে যেতে পারে। তাই ক্যালরির পরিমাণ কম থাকলেও সহজে পেট ভরায় এমন খাবার বেছে নিতে হবে। এসব খাবারের উদাহরণ হলো: ফল (যেমন আপেল বা কলা), টক দই, সেদ্ধ ডিম, সামান্য টক দই দিয়ে লাল আটার তৈরি একটি ছোট রুটি, ইত্যাদি।

যেভাবে দৈনন্দিন জীবনে ব্যায়াম অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন

শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে ক্যালরি খরচ হয়, আর যথেষ্ট পরিমাণ ক্যালরি খরচ করার মাধ্যমে ওজন কমিয়ে আনা যায়। কীভাবে দৈনিক শারীরিক পরিশ্রমের পরিমাণ বাড়িয়ে সহজেই ওজন কমানো যায়, তা নিয়ে ৯টি টিপস নিচে তুলে ধরা হলো—

১) আরও হাঁটুন: শারীরিক পরিশ্রমের পরিমাণ বাড়ানোর সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর উপায়গুলোর মধ্যে একটি হলো হাঁটা। হাঁটাহাঁটিকে নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। এজন্য কোন গ্রুপের সাথে মিলে হাঁটতে পারেন। কোন সঙ্গীকে নিয়ে হাঁটলে তা যেমন উপভোগ্য হবে, তেমনি একজন আরেকজনকে নিয়মিত হাঁটার অনুপ্রেরণা দিতে পারবেন। বাড়িতে, ছাদে, বা বাইরে ফুটপাথ বা মাঠে একা একা গান শুনতে শুনতে হাঁটতে পারেন।

২) সিঁড়ি ব্যবহার করুন: লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করুন। বিল্ডিং অনেক লম্বা হলে গন্তব্যের কয়েক তলা আগে নেমে পড়ে সিঁড়ি দিয়ে বাকিটুকু অতিক্রম করা যায়।

৩) দৌড়ানো শুরু করুন: দৌড়ানোর জন্যও কোন সঙ্গীকে নিয়ে দৌড়ানো যেতে পারে। সঙ্গী একাধিক হলে প্রতিযোগিতা করে দৌড়ানো যায়। এক্ষেত্রে ‘কাউচ টু ফাইভ কে’ প্রোগ্রামটি অনুসরণ করে আগামী নয় সপ্তাহের মধ্যে একটানা পাঁচ কিলোমিটার দৌড়ানোর অভ্যাস করতে পারবেন।

৪) পার্কে বা ছাদে ব্যায়াম করুন: খালি হাতে বা ব্যায়াম করার উপকরণসহ কোনো পার্কে গিয়ে, এমনকি বাসার ছাদেও ব্যায়াম করতে পারেন। পরিবেশে পরিবর্তন এলে পুরো প্রক্রিয়ায় নতুন করে আগ্রহ বাড়তে পারে।

৫) যাতায়াতের মাঝেও ব্যায়াম করুন: বাসে বা গনপরিবহনে যাতায়াত করলে এক স্টপ আগে নেমে বাকি পথ হেঁটে যাওয়া যায়। কম দূরত্বের পথ রিক্সায় চড়ার বদলে হেঁটে অতিক্রম করুন। সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করলে সাপ্তাহিক ব্যায়ামের লক্ষ্যের সিংহভাগই পূরণ করা সম্ভব।

৬) গাড়ি পার্কিং-এ কৌশলী হোন: গাড়ি ব্যবহার করে যাতায়াতে অভ্যস্ত হলে গাড়ি পার্ক করার সময় খানিকটা দূরে পার্ক করা যেতে পারে। এভাবে বাকি রাস্তা হেঁটে অতিক্রম করার সুযোগ ও অভ্যাস তৈরি হবে।

৭) অফিসেও ব্যায়াম করুন: অফিসে যদি বসে কাজ করতে হয়, তাহলে ১ ঘণ্টা পরপর কাজের রুম বা ফ্লোরের চারিদিকে কয়েকবার ঘুরে আসুন। কাছাকাছি করিডোর থাকলে সেখানে কয়েক মিনিট হেঁটে আসা যায়। ৫০০ মিলি বা ১ লিটারের পানিসহ বোতল ডাম্বেল হিসেবে ব্যবহার করে হাত ও শরীরের উপরের অংশের ব্যায়ামও করা যেতে পারে। এছাড়া লাঞ্চের বিরতির সময়ও কিছুক্ষণ হেঁটে বা ব্যায়াম করে এরপর খাবার খেতে পারেন।

৮) পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করুন: পরিবারের সবাইকে নিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের অভ্যাস করলে তা অধিক উপভোগ্য হয়, একে অপরকে নিয়মিত শরীরচর্চা করার জন্য উৎসাহ দেওয়া যায়। নিয়মিত ব্যায়াম করছেন কি না সে ব্যাপারে জবাবদিহিতার জন্য পরিবারের একজন সদস্যকে দায়িত্ব দিন। এটি মেনে চললে ব্যায়াম করা ছেড়ে দেওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে। সবাই একসাথে সাঁতার কাটতে পারেন, পার্কে যেতে পারেন বা বাগান করতে পারেন। শিশুদেরকেও এভাবে ব্যায়ামের অভ্যাস করানো যায়।

৯) বাগান করুন: বাড়ির পাশে জায়গা থাকলে সেখানে বাগান করুন। বাগানের কাজে বেশ ক্যালরি খরচ হয়। জায়গা না থাকলে ছাদে কিংবা বাড়ির বারান্দায় টবে গাছ লাগিয়ে সেগুলোর যত্ন নিতে পারেন।

এই সপ্তাহের কাজগুলো শেষ হলে আপনি ওজন কমানোর ৩য় সপ্তাহের কার্যক্রম শুরু করতে পারেন।

ওজন নিয়ন্ত্রণে যা জেনে রাখা ভালো

ব্যায়ামের বহুমুখী উপকারিতা

শারীরিক পরিশ্রম করা হয়ে ওঠে না এমন ব্যক্তিদের জন্য ব্যায়ামের অপ্রত্যাশিত উপকারিতা রয়েছে। নতুন করে ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তোলার ফলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে, আত্মমর্যাদাবোধ উন্নত হয়। এই সাফল্য আপনাকে মানসিকভাবে চাঙ্গা করবে এবং ওজন কমানো সহ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে সাফল্য আনার প্রেরণা যোগাবে। এভাবে ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের যত্নের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে।

পেডোমিটারের ব্যবহার

স্মার্টফোন এবং স্মার্টওয়াচ ব্যবহারকারীরা ‘পেডোমিটার’ ব্যবহার করতে পারেন। এটি অ্যাপ হিসেবে ডাউনলোড করা যায়, আবার স্বতন্ত্র যন্ত্র হিসেবেও পাওয়া যায়। পেডোমিটারের মাধ্যমে প্রতিদিন কী পরিমাণ হাঁটা বা শারীরিক পরিশ্রম হচ্ছে তার একটি হিসাব পাওয়া যায়। গড় হিসাব বের করে শারীরিক পরিশ্রমের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে প্রতিদিনের শরীরচর্চার লক্ষ্য নির্ধারণ করা যায়।