উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উপায়

জীবনধারায় কিছু পরিবর্তন এনে সহজেই হাই প্রেসার কমানো ও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তবে এটি সম্ভব না হলে রক্তচাপ কমানোর জন্য ঔষধ সেবনের প্রয়োজন হতে পারে। আপনার জন্য রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে ভালো উপায় কোনটি—এ বিষয়ে ডাক্তারের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিন। 

কখন উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা নেওয়া উচিত?

উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত সবাইকে জীবনধারায় স্বাস্থ্যকর কিছু পরিবর্তন আনার পরামর্শ দেওয়া হয়। সেই সাথে কিছু বিষয় বিবেচনা করে ডাক্তার ঔষধ সেবনের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করেন।

বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ রক্তচাপের মাত্রা এবং দীর্ঘমেয়াদী কিছু মারাত্মক রোগের ঝুঁকি (যেমন: হার্ট অ্যাটাক ও ব্রেইন স্ট্রোক)। নিচের ছকে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার সাথে এই দুটি বিষয়ের সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে—

ডাক্তারের কাছে মাপা প্রেসারবাড়িতে মাপা প্রেসারদীর্ঘমেয়াদী ও মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকিচিকিৎসা
১৪০/৯০ বা এর বেশি১৩৫/৮৫ বা এর বেশিকমজীবনধারায় স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন আনাই যথেষ্ট
১৪০/৯০ বা এর বেশি১৩৫/৮৫ বা এর বেশিবেশিজীবনধারা পরিবর্তনের পাশাপাশি ঔষধ খাওয়া উচিত
১৬০/১০০ বা এর বেশি১৬০/১০০ বা এর বেশিবেশি কিংবা কমজীবনধারা পরিবর্তনের পাশাপাশি ঔষধ খাওয়া জরুরি

দীর্ঘমেয়াদী নানান স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে রোগীর রক্ত ও প্রস্রাব নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। সেই সাথে রোগীর স্বাস্থ্যের অবস্থা সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করে চিকিৎসা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। 

বয়স্কদের উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা

যাদের বয়স ৮০ বছরের বেশি তাদের ক্ষেত্রে রক্তচাপের লক্ষ্যমাত্রা—

  • বাড়িতে: ১৪৫/৮৫ এর নিচে ধরা হয়
  • ক্লিনিকে বা হাসপাতালে: ১৫০/৯০ এর নিচে ধরা হয়

৮০ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে রক্তচাপ কমানোর ঔষধগুলো বেশ কার্যকর হলেও এই বয়সের পরে ঔষধের কার্যকারিতার ব্যাপারে স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তাই ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত একজন রোগী যদি—

  • তেমন কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়া ঔষধ সেবন করে থাকেন এবং
  • ঔষধ সেবনের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন

তাহলে ঔষধটি বাকি জীবন চালিয়ে যাওয়া তার জন্য নিরাপদ বলেই ধরে নেওয়া হয়। তবে যদি ৮০ বছর বয়সের পরে প্রথমবারের মতো উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে, তাহলে অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনা করার পরই ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হবে।

জীবনধারার পরিবর্তন

রক্তচাপ কমানোর জন্য দৈনন্দিন জীবনধারায় স্বাস্থ্যকর কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। এর মাঝে কিছু পরিবর্তন কয়েক সপ্তাহের মাঝেই রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করবে। তবে কিছু পরিবর্তনের প্রভাব দেখা দিতে আরো বেশি সময় লেগে যেতে পারে।

  • খাবারে লবণের পরিমাণ দৈনিক ৬ গ্রাম (প্রায় এক চা-চামচ)-এর মধ্যে সীমিত রাখার অভ্যাস করুন। রান্না করা খাবারে ব্যবহৃত লবণ ও পাতের কাঁচা লবণ মিলিয়ে এই পরিমাণের মধ্যে রাখতে হবে।
  • স্বাস্থ্যসম্মত ও সুষম খাবার খান। খাবারের তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে তাজা ফল ও শাকসবজি রাখার চেষ্টা করুন। ফ্যাট ও ক্যালোরিবহুল খাবার খাওয়া একেবারে কমিয়ে দিন।
  • ব্যয়ামের অভ্যাস গড়ে তুলুন। ধীরে ধীরে দৈনিক শারীরিক পরিশ্রমের পরিমাণ বাড়ান। (পড়ুন: ৯ সপ্তাহের মধ্যে দৌড়ানোর অভ্যাস গড়ে তোলার উপায়)
  • ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হলে তা কমিয়ে ফেলুন। আদর্শ ওজন কত জানতে বিএমআই ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে পারেন।
  • চা, কফি, ও কোকের মতো ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় পান করা কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করুন।
  • ধূমপান ছেড়ে দিন।
  • মদ পানের অভ্যাস থাকলে তা কমিয়ে ফেলুন।

ইতোমধ্যে উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ সেবন করলেও এই অভ্যাসগুলো মেনে চলা উচিত। সময় থাকতে এসব অভ্যাস গড়ে তুললে ঔষধ সেবনের প্রয়োজনীয়তা কমে আসতে পারে। তাই আজ থেকেই এই অভ্যাসগুলো চর্চা করুন। 

উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন ধরনের ঔষধ ব্যবহার করা হয়। ঔষধগুলো সাধারণত ট্যাবলেট আকারে পাওয়া যায় এবং দিনে একবার সেবন করতে হয়। তবে প্রয়োজনবোধে দিনে দুইবার করে খাওয়ার পরামর্শও দেওয়া হতে পারে।

সাধারণত—

  • ৫৫ বছরের কম বয়সী রোগীকে এসিই ইনহিবিটর অথবা অ্যানজিওটেনসিন ২ রিসেপ্টর ব্লকার গ্রুপের ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়।
  • রোগীর বয়স ৫৫ বছর বা এর বেশি হলে সাধারণত ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার গ্রুপের ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়।

একজন উচ্চ রক্তচাপের রোগীকে সারাজীবন এই ঔষধগুলো খেতে হতে পারে। প্রয়োজনবোধে ডাক্তার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য ঔষধ যোগ করতে পারেন। আবার একটি ঔষধ কাজ না করলে সেটি বদলে আরেকটি ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হতে পারে।

তবে রক্তচাপ একটানা কয়েক বছর ধরে নিয়ন্ত্রণে থাকলে ডাক্তার ঔষধের ডোজ কমিয়ে দিতে পারেন। প্রয়োজনে তিনি ঔষধ সেবন বন্ধ করে দিয়ে কেবল সুস্থ জীবনধারা মেনে চলার পরামর্শ দিতে পারেন।

ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঔষধের ডোজ পরিবর্তন করা অথবা বন্ধ করা উচিত নয়। নির্দেশনা অনুযায়ী সঠিকভাবে ঔষধ সেবন করা খুব জরুরী। দিনের নির্ধারিত ঔষধের ডোজটি বাদ পড়লে ঔষধের কার্যকারিতা কমে যাবে।

ঔষধ খাওয়ার পরে আপনি খুব একটা পার্থক্য অনুভব নাও করতে পারেন। তবে এর অর্থ এই না যে ঔষধটি কাজ করছে না।

রক্তচাপ অত্যধিক বেড়ে গেলে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে দুই বা ততোধিক ঔষধ সমন্বয় করে সেবনের প্রয়োজন হতে পারে। 

যে কাজটি কখনই করবেন না

শারীরিকভাবে সুস্থ বোধ করলে অনেকে ঔষধ খাওয়া ছেড়ে দেন, বা নিজে নিজে ডোজ কমিয়ে ফেলেন। এই কাজটি একেবারেই অনুচিত। এর ফলে প্রেসার বেড়ে গিয়ে স্ট্রোক, কিডনির রোগ, অন্ধত্বসহ বিভিন্ন জটিল ও জীবনঘাতী স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে।তাই নিয়মিত সঠিক ডোজে ঔষধ সেবন করা উচিত। ঔষধ সেবনের পাশাপাশি জীবনধারায় সুষম ও পরিমিত খাবার, ব্যায়ামের অভ্যাস, ধূমপান ত্যাগ—এসব স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন আনলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা অনেকটাই সহজ হয়ে আসবে।

উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ কীভাবে কাজ করে?

উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধগুলোর কার্যপদ্ধতি এবং কমন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা করা হয়েছে।

এসিই ইনহিবিটর

(ACE Inhibitor=Angiotensin Converting Enzyme Inhibitor)

এই গ্রুপের ঔষধগুলো—

  • শরীরের রক্তনালীগুলোকে শিথিল করে রক্তচাপ কমায়
  • সর্বাধিক ব্যবহৃত হলো: এনালাপ্রিল (Enalapril), লিসিনোপ্রিল (Lisinopril), পেরিন্ডোপ্রিল (Perindopril) ও র‍্যামিপ্রিল (Ramipril)

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া: সবচেয়ে কমন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াটি হল দীর্ঘদিন ধরে শুকনো কাশি হওয়া। অন্যান্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে—মাথাব্যথা, মাথা ঘোরানো, শরীরে লালচে চাকা বা র‍্যাশ হওয়া।

অ্যানজিওটেনসিন ২ রিসেপ্টর ব্লকার

(Angiotensin 2 receptor Blocker)

এই গ্রুপের ঔষধগুলো—

  • শরীরের রক্তনালীগুলোকে শিথিল করে রক্তচাপ কমায়—অর্থাৎ এসিই ইনহিবিটর গ্রুপের মতোই কাজ করে। এসিই ইনহিবিটর গ্রুপের ঔষধ সেবনের ফলে কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে এই গ্রুপের ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। 
  • সর্বাধিক ব্যবহৃত হলো: ক্যান্ডেসারটান (Candesartan), ইরবেসারটান (Irbesartan), ভ্যালসারটান (Valsartan) ও ওলমিসারটান (Olmesartan)

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া: কমন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে—মাথাব্যথা, মাথা ঘোরানো, সর্দিজ্বর, ফ্লু-এর মতো লক্ষণ। 

ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার

(Calcium Channel Blocker)

এই গ্রুপের ঔষধগুলো—

  • শরীরের রক্তনালীগুলোকে সম্প্রসারিত করে রক্তচাপ কমিয়ে আনে
  • সর্বাধিক ব্যবহৃত হলো: অ্যামলোডিপিন (Amlodipine), ফেলোডিপিন (Felodipine) ও নিফেডিপিন (Nifedipine), ডিল্টিয়াজেম (Diltiazem) ও ভেরাপামিল (Verapamil)

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া: কমন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে—মাথাব্যথা, গোড়ালি ফুলে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য

ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার সেবনের সময়ে অতিরিক্ত পরিমাণে জাম্বুরা বা জাম্বুরার রস খেলে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বেড়ে যেতে পারে।

ডাইউরেটিক্স

(Diuretics)

এই গ্রুপের ঔষধগুলো—

  • শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি ও লবণ প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়।

ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার সেবনের পরে কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তখন ডাইউরেটিক্স ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়।

  • সর্বাধিক ব্যবহৃত হলো:  ইন্ডাপামাইড (Indapamide) ও বেন্ড্রোফ্লুমেথায়াজাইড (Bendroflumethiazide)

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া: কমন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে—হঠাৎ উঠে দাঁড়ানোর সময়ে মাথা ঘোরানো, অতিরিক্ত তৃষ্ণা পাওয়া, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, গায়ে লালচে চাকা বা র‍্যাশ দেখা দেওয়া

দীর্ঘদিন ধরে এ জাতীয় ঔষধ সেবন করলে শরীরে পটাসিয়াম ও সোডিয়াম নামক গুরুত্বপূর্ণ লবনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

বেটা ব্লকার

(Beta Blocker)

কিছুদিন আগেও উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔষধ ছিল বেটা ব্লকার। তবে বর্তমানে অন্যান্য ঔষধ সেবনে কাজ না হলে কেবল তখনই এই গ্রুপের ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। কারণ বেটা ব্লকার রক্তচাপ কমানোর অন্যান্য ঔষধের তুলনায় কম কার্যকর।

এই গ্রুপের ঔষধগুলো—

  • হৃৎস্পন্দনের গতি ও তীব্রতা কমিয়ে আনার মাধ্যমে রক্তচাপ কমায়
  • সর্বাধিক ব্যবহৃত হলো: এটেনোলল (Atenolol), বিসোপ্রোলল (Bisoprolol), মেটোপ্রোলল (Metoprolol), ল্যাবেটালল (Labetalol), কার্ভেডিলল (Carvedilol)

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া: কমন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে—মাথাব্যথা, মাথা ঘোরানো, ক্লান্ত অনুভব করা, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া