বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চ রক্তচাপের নির্দিষ্ট কারণটি চিহ্নিত করা যায় না। তবে বিভিন্ন কারণে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। সুস্থ জীবনধারা মেনে চলার মাধ্যমে এমন বেশ কিছু ঝুঁকি কমিয়ে আনা যায়। এভাবে উচ্চ রক্তচাপ হওয়া প্রতিরোধ করা যায় এবং ইতোমধ্যে উচ্চ রক্তচাপে ভুগলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়।
কখন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়?
নিচের কোনো তথ্য আপনার ক্ষেত্রে সঠিক হলে আপনার উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি অধিকাংশের তুলনায় বেশী—
১. ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হওয়া: বিএমআই হিসাব করে আপনি অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী কি না তা বের করা যায়।
২. অতিরিক্ত লবণ খাওয়া: প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের সারাদিনে ৬ গ্রাম বা ১ চা চামচের বেশি লবণ খাওয়া একেবারেই ঠিক নয়। রান্না করা খাবার বা পাতে কাঁচা অবস্থায়—যেভাবেই খাওয়া হোক, এই সীমা অতিক্রম করলে হাই ব্লাড প্রেসারসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৩. অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: খাবারের তালিকায় যথেষ্ট পরিমাণে শাকসবজি ও ফলমূল না থাকলে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এ ছাড়াও অতিরিক্ত পরিমাণে মদ পান করা, অতিরিক্ত চা-কফি, কোমল পানীয় ও অন্যান্য ক্যাফেইন-জাতীয় পানীয় খাওয়ার অভ্যাস উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
৪. পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করা: বিশেষ করে যারা সারাদিন এক জায়গায় বসে থেকে কাজ করেন তাদের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা বেড়ে যায়। সুস্থ থাকতে সপ্তাহে ১৫০ মিনিট শরীরচর্চা করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
৫. ক্ষতিকর জীবনধারা: ধূমপান করা ও রাতে একটানা ৬-৮ ঘণ্টার চেয়ে কম ঘুমানো।
৬. পারিবারিক ও বয়সজনিত কারণ: বয়স পঁয়ষট্টি বছরের ঊর্ধ্বে হলে হাই প্রেসারে সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে। এ ছাড়াও কোন ব্যক্তির পরিবারে নিকট আত্মীয়দের (যেমন: পিতা-মাতা, ভাই-বোনের) হাই ব্লাড প্রেসার থাকলে সেই ব্যক্তিরও এই জটিলতা তৈরি হতে পারে।
বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ২০ জন রোগীর মধ্যে একজনের অন্তর্নিহিত কোনো রোগের কারণে কিংবা নির্দিষ্ট কোনো ঔষধ সেবনের ফলে উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হয়।
উচ্চ রক্তচাপ ঘটাতে পারে এমন কিছু রোগগুলো
ডায়াবেটিস ও কিডনির বিভিন্ন সমস্যা
কিডনির সমস্যার সাথে উচ্চ রক্তচাপের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। রক্তে চর্বির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ও কিডনির ইনফেকশনসহ যেকোনো কারণে কিডনির ভেতরের রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, ফলাফল হিসেবে রক্তচাপ বাড়তে পারে। এছাড়া কিডনিতে রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালীগুলো সরু হয়ে গেলেও তা উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে।
আমাদের কিডনিতে অসংখ্য সরু ছাঁকনি থাকে। ছাঁকনিগুলো রক্তের প্রয়োজনীয় উপাদান শরীরে ধরে রাখে এবং বর্জ্য পদার্থগুলোকে বের করে দেয়। কোনো কোনো রোগে (যেমন Glomerulonephritis) এই ছাঁকনিগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলেও উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে।
স্লিপ অ্যাপনিয়া
স্লিপ অ্যাপনিয়া (Obstructive Sleep Apnea) ঘুমের সময় হয়। এর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে রাতে ঘুমের মধ্যে বার বার দম বন্ধ হয়ে আসা, নাক ডাকা এবং এই কারণে রাতে বার বার ঘুম ভেঙে যাওয়া। দীর্ঘদিন ধরে এই সমস্যায় ভুগলে তা রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে।
হরমোন জনিত সমস্যা
মানুষের শরীরে হরমোন প্রস্তুতকারী বিভিন্ন গ্রন্থি থাকে, যেমন থাইরয়েড, পিটুইটারি গ্রন্থি ও অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি। এই গ্রন্থিগুলো হতে নিঃসৃত বিভিন্ন হরমোন শরীরে নানা ধরনের কাজে নিয়োজিত থাকে।
অনেকের থাইরয়েড গ্রন্থি স্বাভাবিকের তুলনায় কম কাজ করে (হাইপো থাইরয়েড রোগ), আবার অনেকের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি কাজ করে (হাইপার থাইরয়েড রোগ)। উভয় ক্ষেত্রেই রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
থাইরয়েড ছাড়াও শরীরের অন্যান্য গ্রন্থি, যেমন পিটুইটারি ও অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির সমস্যা (Cushing Syndrome, Acromegaly) থেকেও রক্তচাপ বাড়তে পারে। আবার অনেক সময় শরীরে কিছু টিউমার দেখা দেয়, যেগুলো হরমোন তৈরি করে রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়, যেমন Pheochromocytoma।
অটোইমিউন রোগ
অনেকের ক্ষেত্রে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজের শরীরের বিভিন্ন অংশকেই আক্রমণ করে। এমনটা দেখা যায় বিভিন্ন অটোইমিউন রোগে (Autoimmune Disorders)। এ ধরনের কিছু রোগে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।
এমন দুটি রোগ হলো লুপাস এবং স্ক্লেরোডার্মা। লুপাস বা SLE এমন একটি রোগ যা ত্বক, হাড়ের জয়েন্ট, কিডনি ইত্যাদি বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে কোনো কারণ ছাড়াই আক্রমণ করে। Scleroderma রোগে ত্বক পুরু ও শক্ত হয়ে যায়, সাথে কখনও কখনও রক্তনালী ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সমস্যা সৃষ্টি করে। এসব রোগে ব্লাড প্রেসার বেড়ে যেতে পারে।
যেসব ঔষধ রক্তচাপ বাড়ায়
- জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল
- স্টেরয়েড-জাতীয় ঔষধ
অ্যাজমা, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, লুপাস ও চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগে এ জাতীয় ঔষধ ব্যবহৃত হয়। - ব্যথার ঔষধ বা Non-Steroidal Anti Inflammatory Drugs-NSAIDs
এ জাতীয় ঔষধের মধ্যে রয়েছে আইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোক্সেন, এসিক্লোফেনাক ও ডাইক্লোফেনাক। - ঠান্ডা-কাশির কিছু ঔষধ
- বিভিন্ন হারবাল ও ভেষজ ঔষধ, বিশেষ করে যষ্টিমধু বা লিকোরিশ নির্যাস থেকে তৈরি ঔষধ
- কোকেইন ও অ্যাম্ফেটামিনের মতো নেশাজাতীয় দ্রব্য
- ডিপ্রেশনের চিকিৎসায় ব্যবহৃত SNRI গ্রুপের কিছু ঔষধ। যেমন: ভেনলাফেক্সিন
এসব ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী ঔষধটি খাওয়া বন্ধ করলে, রক্তচাপ আবার স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে।