ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা

সাধারণত জীবাণু পেটে ঢোকার কারণে ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা হয়ে থাকে। আর সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কয়েকদিনের মাঝেই সেরে যায়। তবে ডায়রিয়া থেকে যদি মারাত্মক পানিশূন্যতা হয়, তবে তা মৃত্যুর কারণও হতে পারে। পানিশূন্যতা প্রতিরোধ করার উপায় ও পাতলা পায়খানা হলে কী করণীয় তা এই লেখায় থাকছে।

ডায়রিয়ার লক্ষণ

আমরা সাধারণত ‘ডায়রিয়া’ ও ‘পাতলা পায়খানা’ শব্দ দুটি একই অর্থে ব্যবহার করি। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় আপনার পায়খানা নরম বা পাতলা হওয়া মানেই যে আপনার ডায়রিয়া হয়েছে, এমনটি নয়। সারাদিনে তিনবার বা তার বেশি নরম বা পাতলা পায়খানা হলে তাকেই সাধারণত ডায়রিয়া বলা হয়। এছাড়া কারও যদি স্বাভাবিকের তুলনায় ঘনঘন পাতলা পায়খানা হয় সেটাকেও ডায়রিয়া হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।

যে শিশুরা বুকের দুধ পান করে, তাদের পায়খানা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা নরম আর আঠালো হয়। সেটা ডায়রিয়া নয়।

পানিশূন্যতার লক্ষণ

ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে প্রচুর পানি ও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন লবণ বেরিয়ে যায়। যখন এই ঘাটতি পূরণ করা হয় না, তখনই পানিশূন্যতা দেখা দেয়। আর এই পানিশূন্যতা মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে চলে গেলে তা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই ডায়রিয়ার প্রথম চিকিৎসা হলো পানিশূন্যতা পূরণ করা। পানিশূন্যতার প্রধান লক্ষণগুলো হচ্ছে—

  • মুখ শুকিয়ে আসা
  • পিপাসা লাগা
  • চোখ শুকনো লাগা বা খচখচ করা
  • গাঢ়, তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত প্রস্রাব হওয়া
  • প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া

পাতলা পায়খানার ঘরোয়া চিকিৎসা

সাধারণত আপনি ঘরোয়াভাবেই পাতলা পায়খানার চিকিৎসা করতে পারবেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো পানিশূণ্যতা এড়াতে প্রচুর পরিমাণে তরল পানীয় ও খাবার খাওয়া।

১. পাতলা পায়খানা হলে কী খাবার খেতে হবে?

ডায়রিয়া চিকিৎসায় মূল করণীয় হলো শরীরের পানি ও লবনের ঘাটতি মেটানো। এজন্য ডায়রিয়া হলে প্রচুর পরিমাণে খাবার স্যালাইন, তরল পানীয় ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। সাধারণত প্রতিবার পাতলা পায়খানা হওয়ার পর এক প্যাকেট বা আধা লিটার করে খাবার স্যালাইন খাওয়ার উপদেশ দেয়া হয়। তরল পানীয়ের মধ্যে চিড়ার পানি, ভাতের মাড়, কিংবা ডাবের পানি খাওয়া যেতে পারে। ভাতের মাড়ে সামান্য লবণ দিতে পারেন।

যখনই মনে হবে খেতে পারবেন, তখনই খেয়ে নিবেন। শিশুদের ক্ষেত্রে অবশ্যই বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে হবে।

ডায়রিয়া হলে যা খাবেন না

নির্দিষ্ট কোন খাবার খেলেই ডায়রিয়া সেরে যাবে, এমন কথার ভিত্তি নেই। যেমন, এমন ধারণা প্রচলিত আছে যে ডায়রিয়ার রোগী সাদা ভাত আর কাঁচকলা ছাড়া আর কিছুই খেতে পারবে না। এই ধারণা টা সঠিক নয়। পাতলা পায়খানা হলেও পরিচ্ছন্ন পরিবেশে তৈরি সব ধরনের পুষ্টিকর খাবারই খাওয়া উচিত। তবে ডায়রিয়া হলে বাজার থেকে কেনা ফলের জুস, কোমল পানীয়, কফি, চিনি দেয়া চা পরিহার করবেন। কারণ এসব খেলে ডায়রিয়া আরো খারাপ হয়ে যেতে পারে।

২. ডায়রিয়ার ঔষধ

ডায়রিয়া সাধারণত ৫-৭ দিনের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তবে ডায়রিয়ার কারণে সৃষ্ট পানিশূন্যতার দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাড়িতে বসেই চিকিৎসার মাধ্যমে ডায়রিয়া থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। নিচে ডায়রিয়ার ওষুধগুলো উল্লেখ করা হলো—

১। খাবার স্যালাইন: সাধারণত প্রতিবার পাতলা পায়খানা হওয়ার পর এক প্যাকেট বা আধা লিটার করে খাবার স্যালাইন খাওয়ার উপদেশ দেয়া হয়। ঘরে খাবার স্যালাইন না থাকলেও ঘরোয়া উপায়ে খাবার স্যালাইন তৈরি করে নিতে পারেন। এছাড়া চিড়ার পানি, ভাতের মাড়, কিংবা ডাবের পানিও খাওয়া যেতে পারে। ভাতের মাড়ে সামান্য লবণ দিতে পারেন। বমি ভাব হলে ছোট ছোট চুমুকে খাওয়ার চেষ্টা করবেন।

২। জিংক ট্যাবলেট: গবেষণায় দেখা গেছে, জিংক ট্যাবলেট ওষুধটি পাতলা পায়খানা হবার সময়কাল এক-চতুর্থাংশ কমিয়ে আনতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ১০-১৪ দিনের জন্য ২০ মিলিগ্রাম করে জিংক ট্যাবলেট কিংবা সিরাপ খাওয়াতে পারেন।

৩। প্যারাসিটামল: পেটে অস্বস্তি বোধ করলে প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে। শিশুকে ওষুধ দেওয়ার আগে ওষুধের সাথে থাকা নির্দেশিকা ভালো মত পড়ে নিবেন, আর অবশ্যই বয়স অনুযায়ী সঠিক পরিমাণে ওষুধ খাওয়াতে হবে।

৪। লোপেরামাইড-জাতীয় ওষুধ: জরুরি প্রয়োজনে কয়েক ঘণ্টার জন্য পাতলা পায়খানা বন্ধ করতে ডাক্তার আপনাকে লোপেরামাইড-জাতীয় ওষুধ সেবনের পরামর্শ দিতে পারে। তবে ওষুধটি কখনই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এবং ১২ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে না। এতে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে।

ডায়রিয়ার ওষুধের সাথে পুষ্টিকর খাবারও খেতে হবে। পুষ্টিহীনতা থেকে ডায়রিয়া হয়, আবার ডায়রিয়ার কারণে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। তাই ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের বুকের দুধ এবং সবার জন্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়া চালিয়ে যেতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, মারাত্মক পানিশূন্যতা হলে হাসপাতালে ভর্তি করে ইনজেকশনের মাধ্যমে শিরায় স্যালাইন দিতে হতে পারে।

ডায়রিয়া হলে যেসব ওষুধ খাওয়া যাবে না

  • ১২ বছরের কম বয়সী শিশুদের ডায়রিয়া বন্ধ করার ওষুধ খাওয়া যাবে না। 
  • ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের অ্যাস্পিরিন আছে এমন ওষুধ দিবেন না। খেয়াল করে দেখবেন ওষুধের নামের নিচে ছোট করে ASPIRIN শব্দটি লেখা আছে কি না।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন অ্যান্টিবায়োটিক বা দ্রুত পাতলা পায়খানা বন্ধ করার ওষুধ খাবেন না।

৩. পরিবারে ডায়রিয়ার বিস্তার রোধে করণীয়

পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়া হলে রোগীর পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। এটি একদিকে আপনাকে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করবে, অন্যদিকে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

ডায়রিয়া সেরে যাওয়ার পরেও কমপক্ষে দুই দিন বাসায় থাকবেন। বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাবেন না বা নিজে কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাবেন না। নাহলে অন্যদের মাঝেও এই পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়া ছড়িয়ে যেতে পারে।

ডায়রিয়া বিস্তার ঠেকাতে যা করবেন

  • বারবার সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধুবেন।
  • পায়খানা কিংবা বমির সংস্পর্শে এসেছে এমন কাপড় বা বিছানার চাদর গরম পানি দিয়ে আলাদাভাবে ধুয়ে ফেলবেন।
  • পানির কল, দরজার হাতল, টয়লেট সিট, ফ্লাশের হাতল, জীবাণুর সংস্পর্শে আসতে পারে এমন জায়গা প্রতিদিন পরিষ্কার করবেন।

ডায়রিয়া হলে যা যা করবেন না

  • যদি সম্ভব হয়, অন্যদের জন্য রান্না করা থেকে বিরত থাকুন।
  • আপনার থালা-বাসন, ছুরি-চামচ, গামছা-তোয়ালে, জামা-কাপড় কারো সাথে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করবেন না।
  • লক্ষণগুলো চলে যাবার পর ২ সপ্তাহ পার হওয়ার আগে পুকুর বা সুইমিং পুলে নামবেন না।

ডায়রিয়ার চিকিৎসায় কখন দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাবেন?

ডায়রিয়া হলে যদি নিচের লক্ষণগুলোর কোনটি দেখা দেয়, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। ডায়রিয়ার গুরুতর লক্ষণগুলো হলো—

  • পায়খানার সাথে রক্ত বা আঠালো মিউকাস যাওয়া
  • প্রচণ্ড পেটব্যথা
  • ডায়রিয়ার অবস্থার উন্নতি না হওয়া
  • পানিশূন্যতা পূরণ না হওয়া
  • ডায়রিয়ার সাথে ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে জ্বর, অর্থাৎ শরীরের তাপমাত্রা ১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি থাকা

এগুলো গুরুতর অবস্থা নির্দেশ করে, তাই ঘরোয়া চিকিৎসার সাথে সাথে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। 

ডায়রিয়ার কারণ

যে সকল কারণে সবচেয়ে বেশি ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানার দেখা যায়, তার মধ্যে রয়েছে—

  • পেটে জীবাণুর আক্রমণ বা ইনফেকশন হওয়া। একে গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস ও বলা হয়। এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কয়েকদিনের মাঝে সেরে ওঠে।
  • নরোভাইরাস নামের ভাইরাসের আক্রমণ।
  • ফুড পয়জোনিং বা খাদ্যে বিষক্রিয়াও পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়ার একটি কমন কারণ। এ নিয়ে বিস্তারিত জানতে আমাদের খাদ্যে বিষক্রিয়া সংক্রান্ত আর্টিকেলটি পড়ুন।

এছাড়াও যেসব কারণে ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা হতে পারে সেগুলো হলো—

  • ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া – যে কোন ওষুধের সাথে দেওয়া নির্দেশিকা পড়ে দেখবেন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো কী
  • নির্দিষ্ট কোন খাবারে এলার্জি বা বিশেষ কোন খাবার সহ্য না হওয়া
  • ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম বা IBS
  • ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজিজ
  • সিলিয়াক ডিজিজ
  • ডাইভার্টিকুলার ডিজিজ
  • কোভিড-১৯