চোখ ওঠা খুব পরিচিত একটি সমস্যা। একে ডাক্তারি ভাষায় কনজাঙ্কটিভাইটিস বলা হয়। চোখ ওঠার সমস্যা সাধারণত বিশেষ কোনো চিকিৎসা ছাড়াই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। চোখ ওঠার সমস্যা একজন থেকে আরেকজনে দ্রুত ছড়িয়ে যেতে পারে। তাই চোখ ওঠা প্রতিরোধের সহজ ও কার্যকর উপায়গুলো জেনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
চোখ ওঠার লক্ষণ
চোখ ওঠার কারণের ওপর নির্ভর করে ভিন্ন ভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে।[১] চোখ উঠলে সাধারণত দুই চোখই আক্রান্ত হয়। চোখ ওঠার প্রধান লক্ষণ হলো চোখের সাদা অংশ লাল অথবা গোলাপি রঙের হয়ে যাওয়া। অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে রয়েছে—
- চোখের পাতা ফুলে যাওয়া
- চোখের সাদা অংশের ওপরের পাতলা স্বচ্ছ পর্দা ফুলে যাওয়া[২]
- চোখ চুলকানো, খচখচ করা কিংবা জ্বালাপোড়া করা। চোখ ওঠার কারণে চোখ লাল হয়ে খচখচ করলে সেটা সাধারণত ছোঁয়াচে হয়
- চোখের মধ্যে কিছু ঢুকেছে এমন মনে হওয়া অথবা চোখ চুলকানোর তাড়না হওয়া
- চোখ দিয়ে পানি পড়া
- চোখে মিউকাস জাতীয় তরল অথবা পুঁজ জমা। পুঁজ শুকিয়ে চটচটে হয়ে চোখের পাতা অথবা পাপড়ি সাময়িকভাবে জোড়া লেগে যেতে পারে। বিশেষ করে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে এমন হয়। এই লক্ষণ থাকলে চোখ ওঠা ছোঁয়াচে হয়
- কনট্যাক্ট লেন্স পড়লে অস্বস্তি হওয়া অথবা লেন্স চোখে ঠিকমতো না বসা[৩]
চোখ ওঠার কারণ শনাক্ত করা
চোখ ওঠার পেছনের প্রকৃত কারণটি খুঁজে বের করা বেশ কঠিন। বিভিন্ন কারণে চোখ উঠলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষণগুলো প্রায় একই ধরনের হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট লক্ষণের ওপরে ভিত্তি করে চোখ ওঠার কারণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। চোখ ওঠার পেছনে মূলত দুটি কারণ দায়ী—
১. ভাইরাস অথবা ব্যাকটেরিয়া ইনফেকশন
সাধারণত ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া জাতীয় জীবাণু দিয়ে ইনফেকশন হলে চোখ ওঠে।[৪] এর মধ্যে কিছু ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া একজন থেকে আরেকজনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমন ইনফেকশনের কারণে চোখ উঠলে সেটি সাধারণত খুব ছোঁয়াচে হয়।[৫]
ভাইরাস জনিত চোখ ওঠার লক্ষণ
- এক্ষেত্রে সর্দি-কাশি অথবা ফ্লুর মতো লক্ষণ থাকতে পারে
- প্রথমে সাধারণত এক চোখে লক্ষণ দেখা দেয়। কয়েকদিনের মধ্যে অপর চোখও আক্রান্ত হতে পারে[৬]
- চোখ দিয়ে সাধারণত পাতলা ধরনের তরল বা পানি বের হয়
ব্যাকটেরিয়া জনিত চোখ ওঠার লক্ষণ
- এক্ষেত্রে সাধারণত চোখে পুঁজ জমে। ফলে চোখের পাতা একে অপরের সাথে সাময়িকভাবে জোড়া লেগে যেতে পারে[৭]
- এটি কখনো কখনো কানের ইনফেকশনের সাথে একই সময়ে দেখা দিতে পারে
২. এলার্জি
এলার্জির কারণে সর্দি ও চুলকানির পাশাপাশি চোখ ওঠার মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।[৮] তবে এলার্জিজনিত চোখ ওঠা ছোঁয়াচে নয়।[৯]
এলার্জি জনিত চোখ ওঠার লক্ষণ
- এক্ষেত্রে সাধারণত দুই চোখেই লক্ষণ দেখা দেয়[১০]
- চোখে প্রচণ্ড চুলকানি হতে পারে। সেই সাথে পানি পড়া ও চোখ ফুলে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে
- এলার্জিজনিত অন্যান্য রোগ-লক্ষণ থাকতে পারে। যেমন: নাকের ভেতরে চুলকানো, হাঁচি, গলা খুসখুস করা, এলার্জিক রাইনাইটিস, একজিমা নামক চর্মরোগ অথবা অ্যাজমা/হাঁপানি
৩. অন্যান্য কারণ
এসব ছাড়া অন্যান্য যে কারণে চোখ উঠতে পারে—
- কেমিক্যাল বা রাসায়নিক পদার্থ
- কনট্যাক্ট লেন্স[১১]
- বাইরে থেকে চোখের ভেতরে কিছু ঢুকে যাওয়া। যেমন: ঝরে পড়া চোখের পাপড়ি[১২]
- বাড়ির ভেতর ও বাইরের বায়ু দূষক। যেমন: ধোঁয়া, ধুলাবালি ও রাসায়নিক বাষ্প[১৩]
- যৌনবাহিত সংক্রমণ। যেমন: গনোরিয়া ও ক্ল্যামিডিয়া ইনফেকশন
- ছত্রাক বা ফাঙ্গাস, অ্যামিবা ও অন্যান্য পরজীবী
চোখ ওঠার চিকিৎসা
চোখ ওঠার জন্য সাধারণত ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন হয় না। এটি বিশেষ কোনো চিকিৎসা ছাড়া কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নিজে নিজেই সেরে ওঠে। সহজ কিছু ঘরোয়া পরামর্শ মেনেই আপনি সাধারণত চোখ ওঠার লক্ষণ উপশম করতে পারবেন। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়তে পারে।
উল্লেখ্য, চোখ ওঠা অনেক ক্ষেত্রেই খুব ছোঁয়াচে হতে পারে। তাই এটি ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সতর্কতা অবলম্বন করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর্টিকেলের পরের অংশে চোখ ওঠা প্রতিরোধ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।
চোখ ওঠার ঘরোয়া চিকিৎসা
- চোখে ঠান্ডা পানির সেঁক নিতে পারেন। এতে চোখ ফোলা ও জ্বালাপোড়া কমে আসতে পারে। এজন্য একটা হালকা ঠান্ডা ফ্লানেলের কাপড় কয়েক মিনিট চোখে আলতোভাবে ধরে রাখবেন। এটি চোখ ঠান্ডা করে, ফলে আরাম লাগতে পারে।
- চোখ পরিষ্কার করার জন্য পানি ফুটিয়ে জীবাণুমুক্ত করে ঠান্ডা করে নিন। এবার এক টুকরো পরিষ্কার সুতি কাপড় সেই পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে আলতোভাবে চোখের পাপড়িগুলো মুছে নিন। এভাবে চোখে জমে শক্ত হয়ে যাওয়া পুঁজ ও ময়লা সহজে পরিষ্কার করা যায়। এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রতি চোখের জন্য আলাদা আলাদা কাপড় ব্যবহার করবেন। যাতে এক চোখের জীবাণু অন্য চোখে না ছড়িয়ে পড়ে। কাপড়ের টুকরোর বদলে কটন প্যাডও ব্যবহার করতে পারেন।
চোখ পুরোপুরি সেরে ওঠার আগ পর্যন্ত চোখের ভেতরে কোনো ধরনের কনট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করবেন না। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
চোখ ওঠার ঔষধ
চোখ উঠলে বিভিন্ন চোখ ওঠার ড্রপের সাহায্যে চিকিৎসা করা যায়। যেমন—
আর্টিফিশিয়াল টিয়ার: এটি চোখের শুষ্ক ও খচখচে ভাব কমাতে সাহায্য করে। যেকোনো ধরনের চোখ ওঠায় এই ধরনের ড্রপ ব্যবহার করা যায়। ফার্মেসিতে এগুলো লুবজেল, ড্রাইলাইফ, অ্যাকুয়াফ্রেশ ও টিয়ারফ্রেশসহ বিভিন্ন নামে পাওয়া যায়। ব্যবহারের আগে সাথে থাকা নির্দেশিকা ভালোমতো পড়ে সেই অনুযায়ী ব্যবহার করবেন।
অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ: ব্যাকটেরিয়ার কারণে চোখ উঠলে এই ধরনের ড্রপ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। অ্যান্টিবায়োটিক দ্রুত ইনফেকশন সারাতে, জটিলতা কমাতে ও চোখ ওঠা ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সাহায্য করতে পারে।[১৪]
ব্যাকটেরিয়াজনিত চোখ ওঠার চিকিৎসায় সাধারণত নিচের ক্ষেত্রগুলোতে চোখে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়—
- চোখে পুঁজের মতো তরল জমলে
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল এমন কারও চোখ উঠলে
- কিছু বিশেষ ব্যাকটেরিয়া দিয়ে ইনফেকশন হয়েছে ধারণা করলে। যেমন: গনোরিয়া ও ক্ল্যামিডিয়া
ব্যাকটেরিয়া ছাড়া অন্য কোনো কারণে (যেমন: ভাইরাস ও এলার্জি) চোখ উঠলে এই ধরনের ড্রপ কোনো কাজে আসে না।
ব্যাকটেরিয়াজনিত চোখ ওঠার চিকিৎসায় অনেকসময় ‘ক্লোরামফেনিকল’ নামক অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ অথবা অয়েন্টমেন্ট ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। এগুলো দুই বছরের বেশি বয়সী শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রযোজ্য। তবে ব্যবহারের আগে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এই ঔষধ ব্যবহার করা নিষেধ।
অ্যান্টিহিস্টামিন ড্রপ: সাধারণত এলার্জির কারণে চোখ উঠলে কিংবা অতিরিক্ত চুলকানি হলে চোখে এই ধরনের ড্রপ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়।
চোখের ড্রপ ও অয়েন্টমেন্টের পাশাপাশি ডাক্তার কখনো কখনো মুখে খাওয়ার ঔষধ সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন।
কখন স্কুলে ও অফিসে যাওয়া যাবে?
আপনি অথবা আপনার শিশু খুব অসুস্থ বোধ না করলে স্কুলে কিংবা কর্মক্ষেত্রে যেতে পারেন। তবে জ্বর কিংবা অন্যান্য লক্ষণ থাকলে অথবা বাইরের কাজের মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তির নিকট সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা থাকলে সেই ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত।[১৫]
কখন দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাবেন
চোখ ওঠার সমস্যা সাধারণত ঘরোয়া চিকিৎসায় ভালো হয়ে যায়। তবে চোখ ওঠার সাথে নিচের যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে[১৬]—
- চোখে ব্যথা হওয়া
- চোখ আলোর প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়া। যেমন, লাইট অথবা রোদের আলোতে চোখে কোনো সমস্যা হওয়া
- চোখে আলোর ঝলকানি, কাঁপা কাঁপা দৃষ্টি অথবা আঁকাবাঁকা রেখা দেখতে পাওয়া
- দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া এবং চোখ পরিষ্কার করার পরেও ঝাপসা ভাব থেকে যাওয়া
- শরীরে র্যাশ বা ফুসকুড়ি ওঠা
- এক অথবা উভয় চোখ তীব্র লাল হয়ে যাওয়া
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়া। যেমন: ডায়াবেটিস অথবা এইচআইভি আক্রান্ত রোগী, ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছেন এমন, অর্থাৎ কেমোথেরাপি অথবা রেডিওথেরাপির রোগী ও স্টেরয়েড সেবনকারী ব্যক্তি
- ব্যাকটেরিয়াজনিত চোখ ওঠার ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ২৪ ঘণ্টা পরেও অবস্থার উন্নতি না হওয়া[১৭]
- সময়ের সাথে চোখ ওঠার লক্ষণের অবনতি হওয়া কিংবা কোনো ধরনের উন্নতি না হওয়া। বিশেষ করে দুই সপ্তাহ পরেও লক্ষণগুলো পুরোপুরি সেরে না ওঠা
- কনট্যাক্ট লেন্স পরার পর পরই চোখ ওঠার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া। পাশাপাশি চোখের পাতায় কোনো দাগ দেখা দেওয়া। লেন্সের প্রতি এলার্জিক প্রতিক্রিয়ার কারণে এমন হতে পারে
এগুলো চোখের কোনো গুরুতর সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। তাই দেরি না করে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল এমন ব্যক্তিদের সাধারণ চোখ ওঠার ক্ষেত্রেও ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
বাচ্চাদের চোখ ওঠায় করণীয়
শিশুদের ক্ষেত্রে নিচের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন—
- দুই দিনের বেশি সময় ধরে এক অথবা উভয় চোখ লাল হয়ে থাকা
- দুই দিনের বেশি সময় ধরে চোখে ব্যথা কিংবা অস্বস্তি হওয়া
- দুই সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে চোখ দিয়ে আঠালো তরল বের হওয়া কিংবা চোখ আটকে আটকে থাকা
- চোখ ওঠার লক্ষণের কারণে কষ্ট হওয়া
২৮ দিনের কম বয়সী নবজাতকের চোখ ওঠার যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে সাথে সাথে ডাক্তার দেখানো জরুরি।
চোখ ওঠা যেভাবে ছড়ায়
চোখ ওঠা কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে সেটা জেনে রাখলে চোখ ওঠা প্রতিরোধ করা সহজ হয়। অনেক ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের আক্রমণে চোখ উঠতে পারে। এদের মধ্যে কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসজনিত চোখ ওঠা খুবই ছোঁয়াচে। এসব জীবাণু সাধারণত যেসব উপায়ে সুস্থ ব্যক্তিতে ছড়ায়—
- আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শ থেকে। যেমন: স্পর্শ ও হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে
- আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকে বাতাসের মাধ্যমে
- আক্রান্ত ব্যক্তির অনেক কাছাকাছি অবস্থান করলে।
- জীবাণু সংক্রমিত যেকোনো জিনিস হাত দিয়ে ধরার পরে সেই হাত না ধুয়েই চোখে লাগালে। যেমন: দরজার হাতল, বই, টিস্যু কিংবা চোখ মোছার কাপড়
ভ্রান্ত ধারণা: চোখ ওঠা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দিকে তাকালে সুস্থ ব্যক্তির চোখও আক্রান্ত হয়
আক্রান্ত ব্যক্তির চোখের দিকে তাকালেই কোনো সুস্থ ব্যক্তির চোখ আক্রান্ত হয় না। এটি সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ধারণা। তবে কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসজনিত চোখ ওঠা খুবই ছোঁয়াচে। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির স্পর্শ অথবা হাঁচি-কাশির মাধ্যমে কিংবা খুব কাছাকাছি অবস্থান করলে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে একজন সুস্থ ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারেন।
চোখ ওঠা প্রতিরোধ
চোখ ওঠা আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে সুস্থ ব্যক্তিতে সহজেই ছড়াতে পারে। তবে কিছু সহজ উপায় মেনে চললেই চোখ ওঠা ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করা যায়।
যা করবেন
১. নিয়মিত হাত ধোয়া
নিয়মিত কুসুম গরম পানি এবং সাবান দিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোবেন। বিশেষ করে খাওয়ার আগে, চোখে ড্রপ অথবা মলম লাগানোর আগে ও পরে এবং চোখ পরিষ্কার করার পরে হাত ধোয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যদি হাতের কাছে সাবান না থাকে তাহলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬০% অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার বেছে নিবেন।[১৮] তবে হ্যান্ড স্যানিটাইজার পুরোপুরি শুকিয়ে যাওয়ার আগে চোখে হাত দিবেন না। নাহলে চোখে জ্বালাপোড়া হতে পারে।
এ ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিস (যেমন: রুমাল, কাপড় অথবা বিছানার চাদর) হাত দিয়ে ধরলে এবং আক্রান্ত ব্যক্তি অথবা শিশুর চোখে ঔষধ দিয়ে দেওয়ার পরে অবশ্যই সাবান ও কুসুম গরম পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলবেন।
২. হাঁচি-কাশির সময়ে মুখ ঢেকে রাখা
হাঁচি-কাশির সময়ে টিস্যু অথবা রুমাল দিয়ে মুখ ঢাকবেন। ব্যবহারের পর টিস্যুটি ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলে দিবেন। রুমাল ব্যবহার করলে সেটি সাবান অথবা ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে ফেলবেন। এরপর হাত সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে নিবেন।
৩. চোখ পরিষ্কার করা
চোখ থেকে কোনো পানি অথবা পুঁজ বের হলে দিনে কয়েকবার করে তা পরিষ্কার ভেজা কাপড় অথবা তুলা দিয়ে তা মুছে ফেলবেন।[১৯] চোখে হাত দেওয়ার আগে অবশ্যই হাত পরিষ্কার করে নিবেন। চোখ পরিষ্কার করা হয়ে গেলে ব্যবহৃত তুলা ফেলে দিতে হবে। তবে কাপড় ব্যবহার করলে গরম পানি ও ডিটারজেন্ট দিয়ে কাপড় ধুয়ে ফেলবেন। সবশেষে আবার নিজের হাত সাবান ও গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলবেন।
৪. ব্যবহৃত কাপড় পরিষ্কার করা
বালিশের কভার, বিছানার চাদর, গামছা, তোয়ালে ও মুখে ব্যবহার করা কোনো কাপড় (যেমন: নিকাব, রুমাল ও মাস্ক) সাবান অথবা ডিটারজেন্ট ও গরম পানি দিয়ে নিয়মিত ধুয়ে ফেলবেন। এসব ধরার পরে, অর্থাৎ কাজ শেষে ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলবেন।
৫. চশমা ও ব্যবহার্য জিনিস পরিষ্কার রাখা
চশমা ব্যবহারের প্রয়োজন হলে তা পরিষ্কার করে ব্যবহার করবেন। নিজের ব্যবহৃত চশমা, চশমার বক্স অথবা অন্য যেকোনো জিনিস (যেমন: তোয়ালে ও রুমাল) পরিষ্কার করে এবং সতর্কতার সাথে ব্যবহার করতে হবে, যাতে অন্য কেউ একই জিনিস ব্যবহার না করে।
৬. কনট্যাক্ট লেন্স পরিষ্কার রাখা
ডাক্তার কনট্যাক্ট লেন্স পড়া চালিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিলে চোখের ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কনট্যাক্ট লেন্স পরিষ্কার ও সংরক্ষণ করবেন।[২০] এ ছাড়া নির্দেশিত সময় পর পর পুরনো লেন্স পাল্টে নতুন লেন্স ব্যবহার করবেন।
যা করবেন না
চোখ পুরোপুরি সেরে ওঠার আগে নিচের কাজগুলো করা যাবে না—
- চোখে হাত দেওয়া, চুলকানো অথবা ঘষাঘষি করা যাবে না। এসব কাজ চোখের অবস্থা আরও খারাপ করে ফেলতে পারে। এ ছাড়া এক চোখ থেকে আরেক চোখে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়তে পারে[২১]
- হাত না ধুয়ে কখনোই চোখে হাত দেওয়া যাবে না
- আক্রান্ত ও সুস্থ চোখের জন্য একই চোখের ড্রপের বোতল ব্যবহার করা যাবে না।[২২] আলাদা আলাদা ড্রপ ব্যবহার করতে হবে। নাহলে সুস্থ চোখও সংক্রমিত হতে পারে
- আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার্য জিনিস অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করা যাবে না। যেমন: তোয়ালে, গামছা, রুমাল, বালিশের কাভার, চোখের ড্রপ, মেকআপ সামগ্রী ও মেকআপ ব্রাশ, চশমা, কনট্যাক্ট লেন্স ও এগুলোর বক্স
- চোখ সেরে না ওঠা পর্যন্ত কনট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করা যাবে না। তবে চোখের অবস্থা ভালো হয়ে গেলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে পুনরায় কনট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করা যেতে পারে
- সুইমিং পুল ব্যবহার করা যাবে না
এ ছাড়া চোখ ওঠা সেরে যাওয়ার পরে পুনরায় চোখ ওঠা প্রতিরোধে—
সাধারণ জিজ্ঞাসা
চোখ ওঠা করোনার লক্ষণ হতে পারে।[২৫] করোনা ভাইরাস চোখকে আক্রান্ত করে থাকলে এই ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। তবে সচরাচর অন্যান্য ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও এলার্জির কারণে চোখ ওঠার সমস্যা হতে দেখা যায়।
সব ধরনের চোখ ওঠা ছোঁয়াচে নয়। কিছু ভাইরাস অথবা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে চোখ উঠলে সেটি ছোঁয়াচে হয়। তবে অন্যান্য কারণে (যেমন: এলার্জি) চোখ উঠলে তা ছোঁয়াচে নয়।
সাধারণত ব্যাকটেরিয়ার কারণে চোখ উঠলে তা পুরোপুরি সেরে উঠতে ২ সপ্তাহ সময় লাগে।[২৬] ভাইরাসের কারণে চোখ উঠলে সেটা সাধারণত ৭–১৪ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়।[২৭] তবে কিছু ক্ষেত্রে আরও বেশি সময় লাগতে পারে। এ ছাড়া যৌনবাহিত সংক্রমণের কারণে চোখ উঠলে তা সেরে উঠতে তুলনামূলকভাবে বেশি সময় লাগতে পারে।
চোখ উঠলে চোখে পানি দেওয়া যাবে। এক্ষেত্রে ফুটিয়ে ঠাণ্ডা করা পানিতে পরিষ্কার নরম কাপড় ভিজিয়ে চোখ মুছতে পারেন। অতিরিক্ত গরম অথবা ঠান্ডা পানি সরাসরি চোখে না দেওয়াই ভালো। চোখ-মুখ ধোয়ার পরে হাত ভালোমতো সাবান ও পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
কারও সাথে নিজের ব্যবহৃত জিনিস ভাগাভাগি করে ব্যবহার করা যাবে না। যেমন: তোয়ালে, গামছা, বালিশ, চোখের ড্রপ, মেকআপ করার জিনিসপত্র, চশমা ও কনট্যাক্ট লেন্স। এ ছাড়া হাত দিয়ে আক্রান্ত চোখ চুলকানো অথবা ঘষাঘষি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। নতুবা চোখের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে।
চোখ উঠলে চশমা পড়ে থাকতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। তবে আপনি আগে থেকে চশমা পরলে আপনার চশমা ও চশমার বক্স নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
আপনি এলার্জি জনিত চোখ ওঠায় ভুগলে সানগ্লাস ব্যবহার করতে পারেন। সানগ্লাস এলার্জিক উপাদানের সংস্পর্শ কমায়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এটি এলার্জিজনিত চোখ ওঠার লক্ষণ উপশমে সাহায্য করে।[২৮]
উল্লেখ্য, আপনি সাধারণ অবস্থায় কনট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করলে চোখ পুরোপুরি সেরে ওঠার আগ পর্যন্ত অথবা ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার আগ পর্যন্ত তা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবেন।
এলার্জিজনিত কারণে চোখ উঠলে আপনার যেসব খাবারে এলার্জি হয় সেগুলো এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। এ ছাড়া সাধারণত সব ধরনের খাবারই খাওয়া যায়। সবসময় একটি পুষ্টিকর ও সুষম খাবার তালিকা মেনে চলার চেষ্টা করা উচিত।
চোখ উঠলে বাইরে বের হতে সাধারণত কোনো বাধা নেই। তবে চোখ ওঠা যেন অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে না পড়ে সেই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সেজন্য চোখ ওঠা প্রতিরোধের উপায়গুলো গুরুত্ব দিয়ে মেনে চলতে হবে।
সব ধরনের চোখ ওঠা প্রতিরোধের টিকা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে কিছু ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ প্রতিরোধের টিকা দেওয়া যেতে পারে। এসব রোগের টিকা দিলে রোগ থেকে মুক্ত থাকার পাশাপাশি এসব রোগের জীবাণুর মাধ্যমে সৃষ্ট চোখ ওঠাও প্রতিরোধ করা যায়। এমন টিকার মধ্যে রয়েছে—
– হাম-রুবেলা
– চিকেন পক্স ও শিঙ্গেলস
– নিউমোনিয়ার টিকা (নিউমোকক্কাল)
– হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি
এসব টিকার মধ্যে চিকেন পক্স ও শিঙ্গেলস ছাড়া বাকি টিকাগুলো শিশুর জন্মের পরে সরকারি ইপিআই শিডিউল অনুযায়ী বিনামূল্যে দেওয়া হয়।[২৯][৩০] চিকেন পক্স ও শিঙ্গেলস-এর টিকা নির্দিষ্ট বয়সে ডাক্তারি পরামর্শ অনুযায়ী ব্যক্তিগতভাবে কিনে নিতে হয়। এই বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন।