ওজন কমানোর চেষ্টায় দ্রুত সাফল্য এনে দিবে এমন ৮টি সকালের অভ্যাস এই আর্টিকেলে তুলে ধরা হয়েছে। এই অভ্যাসগুলো ওজন কমানোর পাশাপাশি আপনার শরীর সুস্থ রাখতেও সহায়তা করবে।
১. খালি পেটে আধা লিটার পানি খাওয়া
সকালে নাস্তা খাওয়ার আগে আধা লিটার বা পূর্ণ দুই গ্লাস পানি খেয়ে নিতে পারেন। এতে পেট কিছুটা ভরে আছে এমন মনে হবে, ফলে নাস্তায় বেশি না খেলেও মনে হবে পেট ভরে গেছে। এছাড়া পানিতে কোন ক্যালরি না থাকায় এটি একেবারেই ওজন বাড়ায় না। তাই নাস্তা খাওয়ার আগে কোন দুশ্চিন্তা ছাড়া আপনি আধা লিটার পানি পান করে নিতে পারবেন।
দিনের অন্যান্য বেলাতেও এই কৌশলটি কাজে লাগানো যায়। খাওয়ার আগে আধা লিটার পানি খেয়ে তারপর খাওয়া শুরু করলে আপনি সাধারণত যতটুকু খাবার খান, তার চেয়ে কম পরিমাণে খেয়েও হয়তো পেট ভরে যাবে। এভাবে এই অভ্যাসটি ওজন কমাতে সাহায্য করবে।
অনেকের ধারণা খাওয়ার আগে পানি পান করতে নেই, করলেও তা খাবার খাওয়ার কমপক্ষে আধা ঘণ্টা আগে পান করতে হবে। তা নাহলে হজমে সমস্যা হবে। এমন ধারণা বা পরামর্শের কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।
তবে আগে থেকে সকালে একসাথে দুই গ্লাস পানি খেয়ে ফেলার অভ্যাস না থাকলে আস্তে আস্তে পরিমাণ বাড়ান। প্রথমদিকে কিছুটা অস্বস্তি লাগলেও এতে চিন্তার কিছু নেই। কয়েকদিনের মধ্যেই এই অস্বস্তি দূর হয়ে যাবে।
২. সারাদিনের স্ন্যাকস বা নাস্তা ঠিক করে ফেলা
বেশি ক্ষুধা লাগলে আমরা অনেক সময় অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে ফেলি, খাবারটি আদৌ স্বাস্থ্যকর কি না সে বিষয়ে চিন্তা করার সময়-সুযোগ পাওয়া যায় না। হয়তো সিঙ্গারা, পুরি, জিলাপি, বা কোক – হাতের নাগালে যা পাওয়া যায় সেটাই খেয়ে ফেলা হয়। এগুলো যে খুব স্বাস্থ্যকর খাবার না প্রায় সবারই জানা, এরপরেও লোভ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে।
এই প্রবণতা প্রতিরোধের একটি কার্যকর উপায় হতে পারে সকালেই সারাদিনের নাস্তা হিসেবে কী কী খাওয়া যায় তা চিন্তা করে রাখা। বাড়ির বাইরে গেলে হয়তো একটা বক্সে ফল, শশা, গাজর বা টমেটো কেটে সাথে নিয়ে যেতে পারেন। বিরতির সময় সেটা খেয়ে নেয়া যাবে।
আবার ৭-৮ টা বাদাম একটা প্যাকেট করে সাথে রাখতে পারেন। এছাড়া নাস্তাটি ঘরে তৈরি কোন স্বাস্থ্যকর ও মুখরোচক খাবারও হতে পারে। সকালে পরিকল্পনা করে রাখলে বা সাথে খাওয়ার মত কিছু থাকলে হয়তো এই অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি আকর্ষণ ঠেকানো একটু সহজ হবে।
৩. সকালে হেঁটে হেঁটে কাজে বা স্কুলে যাওয়া
সকালে কাজে, বাজারে, বা বাচ্চাকে স্কুলে দিতে যাওয়ার সময় হেঁটে যেতে পারেন। দূরত্ব বেশি হলে অল্প অল্প করে শুরু করুন। এরপর আস্তে আস্তে হাঁটার পরিমাণ বাড়াবেন। হাঁটার সময় দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করবেন।
রিক্সায় করে যাওয়ার অভ্যাস থাকলে শেষ ১০ মিনিটের রাস্তাটুকু একটু আগে নেমে হেঁটে যাওয়া যায়। বাসে করে গেলে ১-২ স্টপ আগে নেমে বাকিটুকু হেঁটে যেতে পারেন। গাড়ি ১০ মিনিট আগে কোথাও পার্ক করে বাকি পথ হেঁটে যাওয়ার অভ্যাস করুন। আস্তে আস্তে হাঁটার পরিমাণটা বাড়ালে প্রক্রিয়াটি আপনার জন্য সহজ হবে।
প্রতিদিনের কাজ ও যাতায়াতের মধ্যে যদি একটু একটু করে ব্যায়ামের চর্চা শুরু করা যায়, তাহলে ব্যায়ামের অভ্যাস দৈনন্দিন জীবনের রুটিনের মত আয়ত্তে চলে আসবে। শুধু ওজন কমানোর জন্যই না, ওজন কমার পরে সেই ওজন ধরে রাখার জন্য এবং শরীর সুস্থ রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করা অপরিহার্য।
৪. চিনি ছাড়া চা-কফি খাওয়া
সকালে যদি চা-কফি খাওয়ার অভ্যাস থাকে, তাহলে সেগুলো চিনি ছাড়া খাওয়ার অভ্যাস করুন। চিনি থেকে খুব সহজেই বাড়তি ক্যালরি আসে, যা ওজন বাড়িয়ে দেয়। সুস্থ থাকার জন্য আলাদা করে চিনি খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। শরীর চিনি থেকে কোন বিশেষ পুষ্টিও পায় না। তাই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসে চিনি যতটুকু এড়িয়ে চলা যায়, ততই ভালো।
চা-কফিতে চিনি খাওয়া কমিয়ে দিলে বা চিনি খাওয়ার অভ্যাস বাদ দিলে তা ওজন কমাতে অধিক সহায়ক হবে। অভ্যাস না থাকায় প্রথম প্রথম খেতে একটু খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু আস্তে আস্তে চিনি ছাড়া চা-কফিই ভালো লাগা শুরু করবে।
আবার চায়ের সাথে অনেকের বিস্কুট খাওয়ার অভ্যাস থাকে। বিস্কুট খেতে তেমন মিষ্টি না হলেও এটি বানাতে সাধারণত প্রচুর চিনি, ময়দা ও ফ্যাট ব্যবহার করা হয়। তাই অধিকাংশ বিস্কুটেই প্রচুর ক্যালরি থাকে। তাই ওজন কমাতে চাইলে চায়ের সাথে বিস্কুট খাওয়া এড়িয়ে চলাই ভালো।
৫. সকালে ওজন মাপা
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ওজন মাপে, তারা ওজন কমাতে বেশি সফল হয়। এলোমেলোভাবে বছরে হাতেগোনা কয়েকবার ওজন মাপলে হয়তো সাময়িকভাবে পরদিন থেকে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস তৈরি করার ইচ্ছা জাগে, তবে প্রক্রিয়াটি নিয়মিত চালিয়ে যাওয়ার মত মানসিক অনুপ্রেরণা ও দায়বদ্ধতা থাকে না। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতিদিন সকালে উঠে নিজের ওজন মেপে ফেলুন।
ওজন মাপার নিয়ম হচ্ছে সকালে বাথরুম সেরে খালি পেটে মাপা। প্রতিদিন একই কাপড় বা একই ধরনের কাপড় পরে ওজন মাপার চেষ্টা করা উচিত। এরপর ওজন একটি চার্টে বা ক্যালেন্ডারে টুকে রাখা যায়। তাছাড়া ফোনে বিভিন্ন অ্যাপ পাওয়া যায় যেখানে সাপ্তাহিক, মাসিক ও বাৎসরিক ওজন গ্রাফ আকারে দেখানো হয়। এগুলোতেও ওজন সেইভ করে রাখতে পারেন। এভাবে সহজেই ওজন বাড়ছে না কমছে সেদিকে খেয়াল রাখা যাবে।
যদি স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো মেনে চলার পরেও ওজন না কমে, তাহলে কারণটা খুঁজে বের করলে সেই অনুযায়ী পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। ওজন মাপলেই যে ওজন কমে যাবে না তা সঠিক, কিন্তু প্রতিদিনের শুরুতে ওজন মাপার ফলে আপনার মাথায় অ্যাকশন পয়েন্টগুলো ঘোরাফেরা করবে। এর ফলে হয়তো আপনি একটু বেশি হাঁটার সিদ্ধান্ত নিবেন, বা একদিন ফাস্টফুড খাবেন না বলে ঠিক করবেন। এগুলোই আপনার ওজন কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
প্রতিদিন ওজন মাপলে কারও কারও একটু উদ্বেগের সৃষ্টি হতে পারে। আপনার ক্ষেত্রে যদি এমন হয়, তাহলে প্রতিদিন না মেপে কয়েক দিন পর পর বা সপ্তাহে একটা নির্দিষ্ট দিনে মাপতে পারেন।
৬. সকাল সকাল ব্যায়াম করা
ওজন কমাতে হলে যে ব্যায়াম করতে হবে এটা সবারই জানা। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, দিনের নানা কাজের ব্যস্ততায় সেটা পেছাতে পেছাতে আর করা হয়ে ওঠে না। তাই সকাল সকাল ব্যায়ামটা সেরে ফেললে ভালো।
যে কোন ধরনের ব্যায়াম করা যায়, যেমন দড়িলাফ, দ্রুত হাঁটা, দৌড়, উঠবস ও ভারোত্তোলন। যেটা সুবিধা হয় এবং ভালো লাগে এমন ব্যায়াম বেছে নিয়ে সকাল সকাল ব্যায়াম করে ফেলুন। দিনের শুরুতেই তখন একটি বড় কাজ সম্পন্ন করে ফেলেছেন বলে মনে হবে। এই অনুপ্রেরণা সারাদিন মন ভালো রাখতে এবং স্বাস্থ্যকর খাবার বেছে নিতেও সাহায্য করবে। বিকেলে সময় পেলে আবার ব্যায়াম করতে পারবেন।
৭. পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো
সুস্থ থাকতে প্রতিদিন খাবার ও পানির মতোই ঘুমও দরকার। ঘুম যে কেবল বিশ্রামের জন্য প্রয়োজন তা নয়। ঘুমের মধ্যেই ব্রেইন সচল থাকে এবং অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করে।
ওজন কমানোর সাথে ঘুমের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। অনেকগুলো গবেষণায় দেখা গেছে যে কম ঘুমের সাথে অতিরিক্ত ওজনের সম্পর্ক আছে, যেটা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। কম ঘুম হলে ক্ষুধা বেশি লাগতে পারে, পরিমাণে বেশি খাওয়া হতে পারে, অনেক বেশি ফ্যাট বা কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবারের প্রতি ঝোঁক আসতে পারে। রাত জেগে থাকলে তখন আবার একটা কিছু খেতে ইচ্ছা করতে পারে।
তাছাড়া ঘুম কম হলে দিনে ক্লান্ত লাগতে পারে, যে কারণে হয়তো ব্যায়াম বা সময় নিয়ে ভালো খাবার খাওয়ার আগ্রহ চলে যায়। চটপট ফাস্টফুড বা প্রক্রিয়াজাত খাবার খেতে ইচ্ছা করে। দিনের পর দিন ঘুম কম হলে মানসিক চাপ দেখা দিতে পারে, যেটা অনেকভাবে ওজন বাড়াতে পারে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেটের মেদ কমানোর উপায় আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।
মোট কথা, ওজন কমানোর সময়েও পর্যাপ্ত পরিমাণে ভালো, একটানা ঘুম দরকার। সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। সকালে উঠে হিসাব করে দেখুন কতক্ষণ ঘুমালেন। যদি হিসাবে ঘুম কম হচ্ছে বলে উঠে আসে, তাহলে ঘুমের রুটিনে পরিবর্তন আনতে হবে।
দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে আমাদের ভিডিওটি দেখতে পারেন।
৮. প্রতিদিনের জন্য অ্যাকশন পয়েন্ট ঠিক করা
সকালে ওজন মাপার পরে সেই দিনের জন্য একটি নির্দিষ্ট অ্যাকশন পয়েন্ট ঠিক করে নিতে পারেন। ঠিক মত পালন করলে এই অভ্যাস ওজন কমাতে সহায়ক হবে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় এই অ্যাকশন পয়েন্টের গুরুত্ব উঠে আসে। ১০০ জন অতিরিক্ত ওজনের মানুষকে নিয়ে এই গবেষণাটি করা হয়।
গবেষণায় এই ১০০ জন মানুষকে দুই দলে ভাগ করে এক দলকে প্রতিদিন সকালে ওজন মাপতে বলা হয়। আরেকদলকেও সকালে ওজন মাপতে বলা হয়, তবে এর সাথে সেই দিনের জন্য একটি অ্যাকশন পয়েন্ট বা নির্দিষ্ট কাজ ঠিক করতে বলা হয় যেটি ওজন কমাতে সাহায্য করবে। এমন কাজের মধ্যে ছিলো—
- আজকে আমি টেবিলে বসে, ফোন-টিভি না দেখা ছাড়া কোন খাবার খাবো না
- আজকে বন্ধুদের সাথে বসে আড্ডা না দিয়ে একসাথে হাঁটতে যাব
- রাত ৮টার পর আজকে কিছু খাবো না
- আজকে ১০০০০ কদম হাঁটব
এরকম অনেকগুলো অ্যাকশন পয়েন্টের তালিকা থেকে যেকোনো একটা কাজ তারা সেই দিনের জন্য ঠিক করেন। এভাবে প্রতিদিন তারা যেকোনো একটা বেছে নিতো, এবং সপ্তাহ শেষে চিন্তা করতো কোন কাজটি ওজন কমাতে বেশি সাহায্য করেছে।
৮ সপ্তাহ পরে কোন দলের কতটুকু ওজন কমলো তা পর্যবেক্ষণ করা হয়। যারা প্রথম দলে ছিলো, অর্থাৎ যারা শুধু ওজন মেপেছে, তাদের ওজন কমে গড়ে ১ কেজির মত। আর দ্বিতীয় দল, যারা ওজন মাপার পরে একটা অ্যাকশন পয়েন্ট বেছে নিয়েছিলো, তাদের ওজন কমে গড়ে ৪ কেজিরও বেশি। অর্থাৎ দুই দলেরই ওজন কমে, তবে দ্বিতীয় দল থেকে প্রায় ৩ কেজির মত বেশি ওজন কমেছে!
তাই আজ থেকেই সকালে ওজন মাপার পরে প্রতিদিনের জন্য একটি করে অ্যাকশন পয়েন্ট বাছাই করা শুরু করে দিন। আমাদের পছন্দের কিছু ওজন কমানোর অ্যাকশন পয়েন্ট তুলে ধরা হয়েছে এই আর্টিকেলে।
তবে শুধু একটা পয়েন্ট মেনে চললে, যেমন কোক খাওয়া থেকে বিরত থেকে আবার ২ প্লেট ভাত খেয়ে নিলে নিশ্চয়ই ওজন কমানো সম্ভব হবে না। ওজন কমানোর জন্য স্বাভাবিকভাবেই যা যা করণীয় – যেমন স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়াম – তার সাথে অ্যাকশন পয়েন্টগুলো থেকে একটা কাজ বেছে নিয়ে সেটার ওপর সেই দিন বেশি গুরুত্ব দিবেন।