মাথাব্যথার কারণ ও প্রতিকার

বাড়িঘর পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে দেরিতে ঘুমানো – এমন অনেক কারণেই মাথাব্যথা হতে পারে। আমরা এখানে মাথাব্যথার ১০ টি প্রধান কারণ ও প্রতিকার তুলে ধরবো।

মানসিক চাপের পরে রিল্যাক্স করা

আপনি সারা সপ্তাহে প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে কাজ করেও সুস্থ বোধ করেন। কিন্তু ছুটির দিন ভালো ঘুম দিয়ে উঠে দেখেন তীব্র ব্যথায় আপনার মাথা টনটন করছে। কেন এমন হয়? কারণটার ব্যখ্যা জটিল, তবে সমাধানটা সহজ। আপনি চাইলে কারণ না পড়ে সরাসরি নিচে সমাধানে পড়তে পারেন।

কারণ: পুরো সপ্তাহের মানসিক চাপ শেষ হয়ে যাওয়ার ফলে শরীরের স্ট্রেস হরমোন (শারীরিক ও মানসিক চাপ বেড়ে গেলে নিঃসৃত বিশেষ হরমোন) নিঃসরণের পরিমাণ কমে যায়। এর ফলে দ্রুতই মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটার নামের বার্তা বহনকারী কিছু রাসায়নিক পদার্থের ক্ষরণ বেড়ে যায়। এই পদার্থগুলো রক্তনালীকে প্রথমে সংকুচিত ও পরে প্রসারিত করার নির্দেশ পাঠায়, যার ফলে মাথাব্যথা হয়।

সমাধান:

সপ্তাহ শেষে ছুটির দিনে বেশি ঘুমানোর লোভ সংবরণ করুন। আট ঘন্টার বেশি ঘুমানোর কারণে মাথাব্যথা হতে পারে। সবটুকু বিশ্রাম সপ্তাহের শেষে ছুটির দিনে নেবার জন্য রেখে দিবেন না। মানসিক প্রশান্তি আনে এমন কিছু কাজ, যেমন যোগব্যায়াম, সপ্তাহের মাঝখানেই করার চেষ্টা করুন।

জমে থাকা রাগ

আপনি যখন রেগে যান, তখন আপনার ঘাড়ের পেছনের মাংসপেশি ও মাথার ত্বক টানটান হয়ে মাথার চারিদিকে একটি আঁটসাঁট ব্যান্ড পরে থাকার মত অনুভূতি হয়। এটি দুশ্চিন্তাজনিত মাথাব্যথা বা টেনশন-টাইপ মাথাব্যথার (Tension Headache) একটি লক্ষণ।

প্রতিকার কী?

আপনার রাগ ওঠা শুরু হলে বুক ভরে ধীরে ধীরে শ্বাস নিন। নাক দিয়ে শ্বাস নিন আর মুখ দিয়ে বের করে দিন। এতে আপনার মাথা ও ঘাড়ের পেশি শিথিল হবে।

অস্বাস্থ্যকর দেহভঙ্গি (Poor posture)

অস্বাস্থ্যকর দেহভঙ্গী (যেমন কুঁজো হয়ে বসা) আপনার পিঠের উপরের দিকে, ঘাড়ে ও কাঁধ দুটোতে চাপ সৃষ্টি করে, যা থেকে মাথাব্যথা হতে পারে।

এই মাথাব্যথায় সাধারণত মাথার নিচের দিকে টনটনে ব্যথা করে এবং কখনো কখনো মুখমণ্ডলে, বিশেষ করে কপালের দিকে, ঝলকানির মত করে ব্যথার অনুভূতি হয়।

কীভাবে এর চিকিৎসা করবেন?

  • একই ভঙ্গীতে দীর্ঘ সময় বসে বা দাঁড়িয়ে থাকবেন না। সোজা হয়ে, কোমরে ঠেক বা সাপোর্ট দিয়ে বসুন।
  • আপনার দীর্ঘক্ষণ ফোন ব্যবহার করার প্রয়োজন বা অভ্যাস থাকলে আলাদা হেডসেট বা ইয়ারফোন (Earphones) ব্যবহার করুন, কারণ বেশি সময় ধরে মাথা ও কাঁধের মাঝামাঝি ফোন ধরে রাখলে আপনার মাংসপেশিতে চাপ পড়ে মাথাব্যথা হতে পারে।
  • আপনি একজন ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট (physical therapist) এর পরামর্শও নিতে পারেন। তারা আপনার দেহভঙ্গির সমস্যা বের করে সেটা সংশোধন করতে সাহায্য করতে পারবেন।

পারফিউম

আপনার যদি মনে হয় যে ঘরের কাজ করলে আপনার মাথাব্যথা হয়, তবে আপনার ধারণা সঠিকও হতে পারে। বাসাবাড়ি পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহৃত সাবান বা ডিটারজেন্ট, সেই সাথে পারফিউম এবং সুগন্ধি এয়ার ফ্রেশনার – এগুলোতে নানান ধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা মাথাব্যথার জন্য দায়ী।

কীভাবে এর চিকিৎসা করবেন?

  • কোন বিশেষ ঘ্রাণে যদি আপনার মাথাব্যথা শুরু হয়, তবে তীব্র ঘ্রাণযুক্ত পারফিউম বা সাবান, শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
  • বাড়িতে ঘ্রাণহীন সাবান, ডিটারজেন্ট ও এয়ার ফ্রেশনার ব্যবহার করুন ।
  • ঘরের দরজা-জানালা যতক্ষণ সম্ভব খুলে রাখুন।
  • কর্মস্থলে কোন সহকর্মীর পারফিউমে আপনার সমস্যা হলে নিজের ডেস্কে একটি ছোট ফ্যান চালাতে পারেন।

খারাপ আবহাওয়া

আপনার যদি প্রায়ই মাথাব্যথা হয়, তাহলে খেয়াল করুন যে আপনার নিচের সময়গুলোতে মাথাব্যথা শুরু হয় কি না:

  • আকাশ মেঘলা হলে
  • বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকলে
  • গরম পরলে বা তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে
  • ঝড় হলে

বায়ুচাপের পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তন মস্তিষ্কে রাসায়নিক ও বৈদ্যুতিক পরিবর্তন ঘটায়, যার ফলে স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে মাথাব্যথা হয়।

কীভাবে এর চিকিৎসা করবেন?

আমরা তো আর আবহাওয়া পরিবর্তন করতে পারি না! তবে আপনি আবহাওয়ার পূর্বাভাস জেনে আপনার মাথাব্যথা হবে কি না সেটা ধারণা করতে পারেন, আর সেই অনুযায়ী মাথাব্যথা রোধে ২-১ দিন আগেই একটি ব্যথানাশক ওষুধ বা পেইনকিলার খেয়ে নিতে পারেন।

দাঁতে দাঁত ঘষা

রাতে ঘুমের মধ্যে কেউ কেউ দাঁতে দাঁত ঘষেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ব্রাক্সিজম (bruxism)। এর ফলে চোয়ালের পেশির সংকোচন হয়, ফলে একটা ভোঁতা ধরনের মাথাব্যথা হয়।

কিভাবে এর চিকিৎসা করবেন?

দাঁতের ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঘুমের মধ্যে দাঁতকে সুরক্ষিত রাখার জন্য আপনাকে সঠিক মাপের মাউথ গার্ড (mouth guard) বানিয়ে নিতে হবে।

উজ্জ্বল আলো

উজ্জ্বল ও ঝলমলে আলো – বিশেষ করে তা যদি দ্রুত জ্বলতে আর নিভতে থাকে, তাহলে মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হতে পারে। এর কারণ হল, উজ্জ্বল ও মিটমিট করতে থাকা আলো মস্তিষ্কে বিশেষ কিছু রাসায়নিক পদার্থের ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে মস্তিষ্কের মাইগ্রেনের কেন্দ্রটি সচল হয়ে যায়।

কীভাবে এর চিকিৎসা করবেন?

  • চোখে আলোর তীব্রতা কমাতে সানগ্লাসের ব্যবহার খুবই কার্যকর। আপনি ঘরে-বাইরে সব জায়গায় এটি পরতে পারেন। পোলারাইজড লেন্সও ঝলমলে আলোর তীব্রতা কমাতে সাহায্য করে।
  • কর্মস্থলে আপনার মনিটরের উজ্জ্বলতার মাত্রা ঠিক করে নিন অথবা ঝলমলে আলো কমায় এমন গ্লেয়ার স্ক্রিন (glare screen) ব্যবহার করুন।
  • অফিসে কিছু লাইট বন্ধ করে দিতে পারেন বা সেগুলোকে অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলতে পারেন। যদি সেটা সম্ভব না হয়, তাহলে অফিসে আপনার বসার জায়গাটি বদলে ফেলুন।
  • টিউবলাইট ও ফ্লু্রোসেন্ট লাইট (fluorescent lighting) বেশি মিটমিট করে, তাই সম্ভব হলে এগুলোর বদলে অন্য ধরনের লাইট ব্যবহার করুন।

খাবার থেকে মাথাব্যথা

চিজ কিংবা ডার্ক চকলেট এর মত লোভনীয় খাবার হতে পারে আপনার মাথাব্যথার কারণ! এই ব্যাপারে খেয়াল রাখুন। এসব খাবারে কিছু রাসায়নিক পদার্থ থাকে যার কারণে মাইগ্রেন অ্যাটাক শুরু হয়। এগুলো ছাড়া আরও যেসব খাবারের কারণে মাইগ্রেন হয় তার মধ্যে রয়েছে:

  • প্রক্রিয়াজাত মাছ ও মাংস
  • ডায়েট কোমল পানীয়

কীভাবে এর চিকিৎসা করবেন?

  • মাইগ্রেনের কারণগুলো লিখে রাখার জন্য একটি ডায়েরি রাখুন।
  • কোনো খাবারের কারণে মাথাব্যথা হচ্ছে সন্দেহ হলে তা কয়েক মাসের জন্য খাওয়া বন্ধ রেখে দেখুন মাথাব্যথা আগের চেয়ে কমে কি না। কোন বিশেষ খাবার বন্ধ করার ব্যপারে আপনার মনে সন্দেহ থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন বা একজন রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ানের কাছে যান।
  • নিয়মিত খাবার খান, কারণ কোন বেলার খাবার বাদ পড়লেও মাথাব্যথা শুরু হতে পারে।

যৌন সহবাস থেকে মাথাব্যথা

অনেক পুরুষ ও নারীর জন্য যৌনমিলনের সময় প্রচণ্ড উত্তেজনার কারণে হওয়া মাথাব্যথা একটি চরম বাস্তব ও পীড়াদায়ক সমস্যা।

ডাক্তাররা ধারণা করেন যে এই মাথাব্যথার কারণ হল মাথা ও ঘাড়ের মাংসপেশিতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হওয়া। এটা যৌন মিলনের যেকোন পর্যায়ে হতে পারে, এবং কয়েক মিনিট থেকে এক ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

কীভাবে এর চিকিৎসা করবেন?

এই মাথাব্যথা অস্বস্তিকর হলেও তেমন ক্ষতিকর নয়, আর এমনটাও নয় যে এটি থাকলে আপনাকে যৌন সহবাস এড়িয়ে চলতে হবে। মাথাব্যথা রোধ করতে কয়েক ঘন্টা আগে একটি ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে নিন।

আইসক্রিম

আইসক্রিমে কামড় দেওয়ার সাথে সাথে কি আপনি কপালে তীক্ষ্ণ, ছুরির আঘাতের মত ব্যথা অনুভব করেন? উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে আপনার আইসক্রিম থেকে মাথাব্যথা (Ice-cream Headache) হয়, যার কারণ হল মুখের ভেতরে উপরের তালু ও গলার ভেতরের দিক দিয়ে ঠাণ্ডা খাবারের চলাচল। বরফ-ঠাণ্ডা পানীয় থেকেও একই রকম সমস্যা হতে পারে।

কীভাবে এর চিকিৎসা করবেন?

এই ব্যথার জন্য কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না, বরং এই ব্যথা এক থেকে দুই মিনিট থাকার পর বিদ্যুৎগতিতে সেরে যায়।