বুক ও গলা জ্বালা-পোড়া

আমরা যখন খাবার খাই, খাবারের সাথে সাথে পাকস্থলীর অ্যাসিড শরীরের নিচের দিকে নামে। যদি এর উল্টো ঘটে, অর্থাৎ পাকস্থলীর অ্যাসিড নিচে না নেমে বরং ওপরে গলার দিকে উঠে আসে, তখন আমরা বুকে জ্বালাপোড়া অনুভব করি। একে অ্যাসিড রিফ্লাক্স বা হার্টবার্ন বলা হয়। অনেকেই আমরা এটাকে গ্যাস্ট্রিক, গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা বা অ্যাসিডিটি বলে থাকি।

এমন জ্বালাপোড়া যদি বারবার হতে থাকে, তখন এই রোগকে বলা হয় গ্যাস্ট্রো-ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (gastro-oesophageal reflux disease)।

অ্যাসিড রিফ্লাক্সের লক্ষণ

প্রধান লক্ষণগুলো হলো:

  • বুক জ্বালাপোড়া করা। বুকের ঠিক মাঝামাঝি জায়গাটায় জ্বালাপোড়া অনুভব করা।
  • মুখে অপ্রীতিকর টক স্বাদ পাওয়া, পাকস্থলীর অ্যাসিড মুখে চলে আসার কারণে।

এছাড়াও আপনার আরো যেসব লক্ষণ থাকতে পারে:

  • পেট ফাঁপা,
  • বমি ভাব হওয়া,
  • বারবার কাশি বা হেঁচকি হতে থাকা,
  • কণ্ঠ কর্কশ হয়ে যাওয়া,
  • শ্বাসে দুর্গন্ধ আসা।

খাওয়ার পরে, শোবার পরে বা উপুড় হলে লক্ষণগুলো আরো তীব্র রূপ ধারণ করতে পারে।

বুক জ্বালা-পোড়ার কারণ

নির্দিষ্ট কোন কারণ ছাড়াই সময়ে সময়ে অনেকের বুক জ্বালাপোড়া করে। তবে মাঝেমধ্যে কিছু জিনিস এই জ্বালাপোড়ার সূত্রপাত ঘটায় বা তীব্রতা বাড়ায়। যেমন:

  • নির্দিষ্ট কিছু খাবার ও পানীয়- চর্বিযুক্ত বা মসলাদার খাবার, কফি, চকলেট, অ্যালকোহল, ইত্যাদি,
  • ধূমপান,
  • মানসিক চাপ ও উদ্বেগ,
  • ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হওয়া,
  • গর্ভাবস্থা,
  • হায়াটাস হার্নিয়া (hiatus hernia) নামের একটা রোগ যেখানে পাকস্থলীর কিছু অংশ বুকে উঠে আসে,
  • কিছু ওষুধ যেমন আইবুপ্রোফেন (ibuprofen)। আপনি যদি ডাক্তারের পরামর্শে এই ওষুধগুলি খান, তাহলে কোনভাবেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে ওষুধগুলো বন্ধ করবেন না।

বুক জ্বালা-পোড়ার ঘরোয়া চিকিৎসা

দৈনন্দিন জীবনে সহজ কিছু পরিবর্তন আনার মাধ্যমে আপনি অ্যাসিড রিফ্লাক্স সারিয়ে তুলতে বা কমিয়ে আনতে পারবেন। যেমন:

  1. একবারে ভরপেট খেলে এই সমস্যা বেশি হয়। সারা দিনে ভাগ করে অল্প অল্প করে খাবার খাবেন।
  2. যে সকল খাবার কিংবা পানীয় খেলে আপনার সমস্যা বেড়ে যায়, সেগুলো এড়িয়ে চলবেন।
  3. রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ৩-৪ ঘন্টার মধ্যে কিছু খাবেন না।
  4. বিছানায় শোবার সময় আপনার মাথা আর বুক যাতে কোমরের চেয়ে ১০-২০ সেন্টিমিটার উঁচু অবস্থানে থাকে। তাতে পাকস্থলীর অ্যাসিড গলা পর্যন্ত উঠে আসতে পারবে না। বালিশ দিয়ে মাথা উঁচু করবেন না। তোষকের নিচে বা খাটের নিচে কিছু দিয়ে খাটের একটা দিক উঁচু করে নিবেন এবং সেইদিকে মাথা দিবেন।
  5. এমন কাপড় পরবেন না যা কোমরে আঁটসাঁট হয়ে বসে থাকে।
  6. আপনার ওজন অতিরিক্ত হলে তা কমিয়ে ফেলুন।
  7. ধূমপান করবেন না।
  8. মনে প্রশান্তি আনে এমন কিছু কাজ নিয়মিত করুন।
  9. নিজে নিজে আইবুপ্রোফেন (ibuprofen) অথবা অ্যাসপিরিন (aspirin) সেবন করবেন না, কারণ এই ওষুধগুলো বদহজম আরো বাড়ায়। তবে আপনি যদি ডাক্তারের পরামর্শে এই ওষুধগুলি খান, তাহলে কোনভাবেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে ওষুধগুলো বন্ধ করবেন না।

বুক জ্বালা-পোড়া হলে কখন ডাক্তারের সহায়তা নিবেন?

  • যদি জীবনধারায় পরিবর্তন এনেও কোন উপকার না হয়।
  • যদি এই সমস্যা ৩ সপ্তাহ বা তার বেশী সময় ধরে প্রায় প্রতিদিনই দেখা দেয়।
  • যদি তীব্র ব্যথা অনুভব করেন।
  • যদি ৫৫ বছর বা তার বেশী বয়সী হয়ে থাকেন।
  • যদি অন্যান্য লক্ষণ দেখা দেয়, যেমন:
  1. কোন কারণ ছাড়াই শরীরের ওজন কমে যাওয়া,
  2. গলায় খাবার আঁটকে যাওয়া বা খাবার গিলতে কষ্ট হওয়া,
  3. ঘনঘন বমি করা,
  4. বমি বা পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া, পায়খানা কালো হওয়া অথবা বমির মধ্যে কফি দানার মত কালচে বাদামি কিছু থাকা,
  5. পেটে চাকার মত মনে হওয়া,
  6. আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতায় ভোগা।

আপনার লক্ষণগুলো কোন গুরুতর রোগের কারণে কি না, ডাক্তার সেটা যাচাই করবেন এবং আপনাকে যথাযথ চিকিৎসা প্রদান করবেন।

ডাক্তার কীভাবে আপনাকে সহায়তা করতে পারেন?

লক্ষণগুলো কমিয়ে আনতে ডাক্তার আপনাকে অ্যান্টাসিড (antacid) নামক একটি ওষুধ দিতে পারেন। এই ওষুধটি খাবারের সাথে অথবা খাবারের ঠিক পরপর সেবন করা শ্রেয়, কারণ এই সময়েই বুকে জ্বালাপোড়ার সমস্যা বেশি হয়। খাবারের সাথে সেবন করলে ওষুধটির কার্যকারিতার সময়ও বৃদ্ধি পেতে পারে।

ডাক্তার আপনাকে অন্য আরেক প্রকারের ওষুধ সেবন করার পরামর্শও দিতে পারেন, যেগুলো আপনার পাকস্থলীর অ্যাসিড তৈরির পরিমাণ কমিয়ে আনবে। যেমন:

  • ওমিপ্রাজল (omeprazole)
  • ল্যান্সোপ্রাজল (lansoprazole)

আপনার লক্ষণ সেরে উঠছে কি না তা দেখার জন্য এই ওষুধগুলোর একটি আপনাকে মাস দুয়েকের জন্য দেওয়া হতে পারে।

যদি ওষুধ বন্ধ করার পর আপনার উপসর্গ আবার বেড়ে যায়, অবশ্যই ডাক্তারের কাছে ফেরত যাবেন। আপনার হয়ত আরো দীর্ঘ সময় ওষুধ খেতে হতে পারে।

যেসব পরীক্ষা ও অপারেশন করা হয়

আপনার রোগের লক্ষণ যদি বেশী গুরুতর হয় অথবা ওষুধ খেলেও কোন উপকার না হয়, তাহলে আপনাকে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে পাঠানো হতে পারে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যা করতে পারেন, তা হল:

  • সমস্যাগুলোর কারণ জানার জন্য গ্যাস্ট্রোস্কোপি (gastroscopy) নামে একটা পরীক্ষা করতে পারেন, যেখানে ক্যামেরা লাগানো একটি চিকন টিউব গলা দিয়ে প্রবেশ করানো হয়। অনেকে এই পরীক্ষাকে এন্ডোস্কোপি নামে চেনে।
  • অ্যাসিড রিফ্লাক্স থামানোর অপারেশন, যার নাম ল্যাপারোস্কোপিক ফান্ডোপ্লিকেশন (laparoscopic fundoplication)। পেট না কেটে পেট ফুটো করে এই অপারেশন করা হয়।